অভিমত : এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়
মো. মহিউদ্দিন রুবেল [সূত্র : বণিক বার্তা, ২২ মে ২০২৫]

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ তার উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিভিন্ন চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে বর্তমানে একটি সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। দেশটি ২০১৮ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সব মানদণ্ড পূরণ করেছে। যদিও গ্র্যাজুয়েশন একটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, সমৃদ্ধি ও পরিপক্বতার প্রতীক, তার পরও বাংলাদেশের জন্য এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা দুটিই আছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফল হিসেবে বাণিজ্যে অগ্রাধিকার হারানোসহ বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়া, স্থবির রফতানি, প্রণোদনা হ্রাস এবং সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হওয়ার মতো বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এ সিদ্ধান্তকে আরো জটিল করে তুলেছে।
নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার দেশটির দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার জন্য ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদিও সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিরিয়ড তিন বছর পেছানোর জন্য ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন। তাদের অভিমত ছিল যে খুব তাড়াহুড়ো করে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়ার জন্যও পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন।
তবে যেহেতু ২০২৬ সালেই আমরা গ্র্যাজুয়েট হতে চলেছি, তাই গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে কীভাবে বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে পারি, সেদিকে এখন নজর দেয়া জরুরি।
বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন উত্তরণের পথে থাকা অন্য দেশগুলোর মতো মসৃণ নয়। বাংলাদেশে পোশাক শিল্প খাত একাই রফতানিতে ৮৪ শতাংশ অবদান রাখে। এলডিসি উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পটি শুল্কমুক্ত ও বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা হারানোর কারণে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে। স্মরণ করা যেতে পারে যে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় থাকা অন্য দেশগুলোর রফতানি চিত্র কিন্তু আমাদের দেশ থেকে আলাদা, তাদের রফতানি ঝুড়িতে অনেক বেশি পণ্য। সে কারণে বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে দেশটির প্রধান রফতানি খাতকে সুরক্ষিত রাখতে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও বাজার বহুমুখীকরণের ওপর জোরালোভাবে নজর দিতে হবে। এ রকম বাস্তবতায় ব্যতিক্রমধর্মী প্রস্তুতি ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উত্তরণ-পরবর্তী বাণিজ্য চিত্রপট: এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ রফতানি বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্মুখীন হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইইউ আমাদের পোশাক রফতানিতে দ্বি-স্তর রূপান্তর (ডাবল ট্রান্সফরমেশন রুলস অব অরিজিন) এবং স্বয়ংক্রিয় সেফগার্ড ক্লজগুলোর মতো কঠোর বাণিজ্য বিধিগুলো প্রয়োগ করবে। যদিও আমাদের সামনে জিএসপি প্লাস একটি বিকল্প হিসেবে রয়েছে এবং তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তবে এর জন্য ৩২টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন সমন্বিত কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন করা প্রয়োজন এবং রফতানি ৩৭ শতাংশ সীমা (থ্রেশহোল্ড) অতিক্রম করার কারণে বাংলাদেশ সে যোগ্যতা অর্জন করার সামর্থ্য নাও রাখতে পারে। ইইউ বাজারে জিএসপি সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকবে, তবে কানাডা, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সাফটাভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক কী রকম হবে, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।
অন্যদিকে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া দেশ দুটি এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অনুকূল আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে। বাংলাদেশকেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ করতে হবে। এর জন্য তার বাণিজ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরো জোরালো ও শক্তিশালী করতে হবে।
রফতানি বাড়াতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চৌকস অর্থনৈতিক কূটনীতির কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক সক্ষমতা জোরদার করা: উত্তরণের সিদ্ধান্তটি যখন এসেছে, এরই মধ্যে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে, রফতানি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং রফতানি প্রণোদনাগুলো ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ সুবিধাগুলোর ওপর নির্ভরশীল অনেক ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানা ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে কারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারকে অবশ্যই প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রোগ্রাম নিতে হবে, সাশ্রয়ী মূল্যে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে কারখানাগুলো রফতানিতে প্রণোদনা ও অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা হারানোর ক্ষতি সামলে নিয়ে ধাতস্থ হতে পারে, ব্যবসায় টিকে থাকতে পারে।
পোশাক খাতকে সুরক্ষা প্রদান: বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প খাত সুরক্ষার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। ডব্লিউটিও ও আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে ৫ শতাংশ পতনের কথা বলা হয়েছে, যা আসলে আগামী দিনগুলো কঠিনতর হওয়ার কথাই বলে। যদিও চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে, তবে দুই বছরের তুলনাচিত্র রফতানিতে স্থবিরতাই প্রদর্শন করে।
পোশাক শিল্পের সুরক্ষার জন্য প্রযুক্তির মানোন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন ও পণ্য বৈচিত্র্যের মাধ্যমে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। রফতানি পণ্যের দরপতন রোধ এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয় মোকাবেলায় সরকার এবং শিল্পের অংশীজনদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
অবকাঠামোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা: ২০১৮ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের মানদণ্ড পূরণ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বন্দর ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি সরবরাহ এবং কাস্টমস ব্যবস্থাপনা দক্ষতায় সীমিত অগ্রগতি অর্জন করেছে। এখানে এখনো ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় অনেক বেশি এবং পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।
আসন্ন গ্র্যাজুয়েশনের পাশাপাশি এসব অবকাঠামোগত এবং নীতিগত বাধা জরুরিভাবে সমাধান করতে হবে। রফতানি প্রতিযোগী সক্ষমতার ওপর যে বিষয়গুলো সরাসরি প্রভাব রাখে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং বন্দর সুবিধা বৃদ্ধির মতো প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে দিতে পারে।
বিদেশী প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে আমদানি-রফতানি-করনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক ও সবুজ অর্থনীতি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এ উদ্যোগগুলো অর্থনীতিকে সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণও করবে।
কৌশলগত বাণিজ্য চুক্তি: যেহেতু জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে গেলে বাংলাদেশকে বেশ ক’টি শর্ত পূরণ করতে হবে, কঠিন টেকনিক্যাল বা কারিগরি ইস্যুগুলো ছাড়াও আরো অনেক জটিল ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বা টেকসই উন্নয়ন এবং ‘সুশাসন’ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, তাই আমাদের জন্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। এ চুক্তিগুলো পারস্পরিক সুবিধা নিশ্চিত করে, উদাহরণস্বরূপ ভিয়েতনাম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগে (এফডিআই) অনেক এগিয়ে আছে। দেশটির রফতানির ৭২ শতাংশই করছে বিদেশী কোম্পানিগুলো।
এ ধরনের চুক্তির জন্য নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। এর জন্য বিনিয়োগ নীতি, মেধাস্বত্ব সুরক্ষা, শুল্ক পদ্ধতি ও ডিজিটাল বাণিজ্য কাঠামোয় সংস্কার সাধন প্রয়োজন। এ চুক্তিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্বসহ একটি নেগোসিয়েশন টিম গঠন করা প্রয়োজন। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে অনেক জোর দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাও সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে মসৃণ রাখার জন্য দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। উপযুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এতে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে, আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতারও বিকাশ ঘটবে। বাংলাদেশের রফতানি প্রধানত পোশাক শিল্পনির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরণ অন্যান্য দেশের থেকে স্বতন্ত্র। তাই এক্ষেত্রে বিশেষ কৌশল ও সতর্কতা গ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশ টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সুযোগগুলো গ্রহণে যথাযথভাবে সমর্থ হবে, এটা সবার প্রত্যাশা।
মো. মহিউদ্দিন রুবেল: বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক