৫ আগস্ট ২০২৪ গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশ একটি দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা পায়। সেই সময়ে অর্থনীতির একাধিক সূচকের নেতিবাচক পারফরম্যান্সের ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্বল ছিল। কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দুর্বল রাজস্ব আহরণ, নিম্নমুখী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রবাসী আয়, স্থবির বিনিয়োগে এবং দুর্বল ব্যাংক খাত নিয়ে অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা ছিল। এ বাস্তবতার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গিয়ে বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এসব দুর্বলতার মূল কারণ ছিল দীর্ঘদিনের কাঠামোগত সমস্যা, যা রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল।
৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল গগনচুম্বী। জনগণ আশা করেছিল নতুন অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করবে, অর্থনীতিকে গতিশীল করবে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া ছিল একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়া এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়া।
এক বছর পর যদিও কয়েকটা অর্থনৈতিক সূচক কিছুটা উন্নতি করেছে, অধিকাংশ সূচকই এখনো আগের দুর্বল অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের ফলে অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হারে বিধিনিষেধ শিথিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং সরকারি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়ে, দৈনন্দিন পণ্যের ক্ষেত্রে এলসি-বিষয়ক বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়ে এবং খাদ্য ও সার আমদানিকারকদের জন্য ঋণের সুবিধা দিয়ে সরবরাহজনিত সমস্যা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছে যাতে মূল্যস্ফীতি না বাড়ে। প্রথম দিকে তেমন ফলাফল দেখা না গেলেও মূল্যস্ফীতি এখন কমার দিকে। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি দুই অংকে থাকার পর তা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। জুলাই ২০২৪-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের জুনে এসে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এই কম প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিনিয়োগের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সরবরাহ ব্যবস্থা-সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা, চাহিদার হ্রাস এবং সঠিক আর্থিক প্রণোদনার অভাবের মতো সমস্যা।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে আলোচিত দিক ছিল বিভিন্ন খাতে সংস্কার উদ্যোগ। যদিও সরাসরি অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি, পরিকল্পনা উপদেষ্টা একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সমতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল তৈরি করা। এই টাস্কফোর্স রিপোর্টে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হলেও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো স্বল্পমেয়াদে কিছু সুপারিশের বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করতে পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরো একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন যাতে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া উন্নত হয়। আশা করা যায়, এখান থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনটি টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে। মোটা দাগে এগুলোর মূল কাজ হলো ব্যাংক খাতের সম্পদের গুণগত মান পর্যালোচনা করা, বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং ব্যাংক থেকে চুরি যাওয়া সম্পদ উদ্ধার ও খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। সরকার ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’ অনুমোদন করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থান উন্নয়নে করণীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছে। এখন অনেক কাজ চলছে, এসব উদ্যোগের কার্যকারিতা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের ওপর—তারা সংস্কার চালিয়ে যেতে আগ্রহী কিনা সেটাই হবে মূল বিষয়।
আলোচিত আরেকটি সংস্কার হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর পুনর্গঠন। গত ১২ মে সরকার ‘রেভিনিউ পলিসি অ্যান্ড রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুটি আলাদা বিভাগে ভাগ করার ঘোষণা দেয়—‘রেভিনিউ পলিসি বিভাগ’ এবং ‘রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ’। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত ছিল। তবে কর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির জন্য বহুদিন ধরেই অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা এ ধরনের বিভাজনের সুপারিশ করে আসছিলেন। তবে এটি এনবিআর সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে, কারণ অর্থ মন্ত্রণালয় এখানে কিছু সংশোধন আনার কথা বলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কথা অনুযায়ী ২০২৬ সালের প্রথম ভাগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে সংস্কার উদ্যোগের আশা নেই। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরে সংস্কার করতে পারেনি। সংস্কারের ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা এবং অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে।
আগামীর নির্বাচিত সরকারকে অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোকে সুসংহত করতে হবে এবং অর্থনীতির ভেতরকার দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা জরুরি। সুদের হারের ক্ষেত্রে সতর্ক নীতি অব্যাহত রাখা দরকার যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। একই সঙ্গে উৎপাদন খাত যাতে ঋণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। রফতানি আয়, প্রবাসী আয় ও বিনিয়োগ আকর্ষণে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ এটি কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। দুর্ভাগ্যবশত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে বিনিয়োগকারীদের আস্থা খুব কম ছিল। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, নীতির অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, চাঁদাবাজি, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং সীমিত প্রযুক্তি ব্যবহার এ আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ। এসব কাঠামোগত সমস্যার সমাধান ছাড়া বিনিয়োগ হবে না।
তৃতীয়ত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার প্রক্রিয়া কোনো অজুহাতে আটকে রাখা যাবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্বিন্যাস কার্যক্রম ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এ প্রক্রিয়া সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আহরণে গতি আসবে।
চতুর্থত, দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগণের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি এবং আয় সে তুলনায় বাড়েনি। তাই নগদ সহায়তা ও খাদ্য সহায়তার পরিমাণ ও আওতা বাড়াতে হবে। খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির পরিধি বাড়াতে হবে।
পঞ্চমত, রফতানি খাতের ঝুঁকি কমাতে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপ এবং ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের প্রেক্ষাপটে রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য এবং নতুন বাজারে প্রবেশ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারকে এক্ষেত্রে রফতানিকারকদের, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসার জন্য যথাযথ নীতিগত সহায়তা দিতে হবে এবং ব্যবসা পরিবেশ উন্নত করতে হবে যাতে তারা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে।
ষষ্ঠত, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বাড়াতে হবে। ব্যাংক খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম, যেমন খেলাপি ঋণ হ্রাস, দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ এবং সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির উদ্যোগগুলো আরো দ্রুত বাস্তবায়ন এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে চালিয়ে যেতে হবে। স্বাধীন অডিট ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে যাতে ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ে। এতে তরুণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তবে এখন সবার আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা শুরু করতে হবে। নির্বাচনের সময় ঘোষণার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বাধীন অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ সময়কালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বৃদ্ধি করে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন ঠেকানোর মাধ্যমে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি, বিনিয়োগ বাড়ছে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। কিন্তু সরকারের ঋণ পরিশোধ বাড়ছে।
বিগত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অনেক কম। অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বজায় রয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রাথমিক উৎসাহ ছিল তা ধীরে ধীরে কমে গেছে। তাদের জীবনের গুণগত পরিবর্তন হয়নি, হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সরকার থেকে যা বলা হয়েছিল তা বাস্তব রূপ পায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে, যা মানুষকে আশাহত করেছে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দেয়ার বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)