কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা কতটুকু

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি [সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৮ মে ২০২৫]

পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা কতটুকু

কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। এ জগতে সৎকর্মের পুরস্কার স্বরূপ পরজনমে স্বর্গবাসের কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে। সেই স্বর্গের সৌন্দর্যেরও কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় ধর্মগ্রন্থগুলোতে। সেই বর্ণনার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় কাশ্মীরের সৌন্দর্য। গোটা কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে একাধিক পর্যটন আকর্ষণ, যা সারা বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে টানে। তেমনই একটি পর্যটন আকর্ষণ পেহেলগাম। বিভিন্ন ভাষায় চিত্রায়িত বহু সিনেমার দৃশ্য ও রোমান্টিক গানের চিত্রায়ণ হয়েছে এই পেহেলগামে।

 

 

সিনেমায় যেমন অবাঞ্ছিত ভিলেন এসে বিপত্তি ঘটায়, ঠিক তেমনিভাবে পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে দেশবিদেশের একদল পর্যটকের ওপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ২৫ জন এবং পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের একজন নাগরিক প্রাণ হারান। আর আহত হন আরও ২০ জন। এ আক্রমণের দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট (টিআরএফ), যাদের নেপথ্যে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের সূত্রে গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা দাবি করেছেন। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী মনে করছে এ আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড সাইফুল্লাহ কামুরী ওরফে খালিদ। ফলে নানা প্রকার কূটনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারত ও পাকিস্তান আজ যুদ্ধের মুখোমুখি।

 

 

পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে সোজা বা আকাশপথে পেহেলগামের দূরত্ব ২১৫ কিলোমিটার। আর গাড়ি চালিয়ে যেতে হলে ৮১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) নামে ব্যাপক পরিচিত ভারত- পাকিস্তান সীমান্তরেখা থেকে বাহার গ্রামের দূরত্ব ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। এ এলাকা পাহাড়, ঘনজঙ্গল, খরস্রোতা নদী ও সরু পাহাড়ি পায়েচলা পথ পরিবেষ্টিত, যা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও নাশকতার প্রস্তুতি ও নাশকতার পর পালিয়ে থাকার জন্য আদর্শ ভূমি। এমন আদর্শ ভূমিতে লুকিয়ে থেকে সুযোগ ও পরিকল্পনা মোতাবেক নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস বা অভিযান পরিচালনা সহজ বলেই পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট জঙ্গিরা এ নাশকতা চালিয়েছে বলে ভাবছে ভারত।

 

 

 

অন্যদিকে পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে এত দূরে এমন সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে ভারতের সাজানো নাটক বলছে পাকিস্তান। বরাবর পাকিস্তান বলে থাকে যে, ভারত সরকার রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়লেই একটি জঙ্গি হামলা বা সীমান্ত সংঘাতের নাটক করে। তারই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে পেহেলগামের এ নৃশংস ঘটনা। পাল্টা জবাবে ভারত দাবি করে যে,  ১৯৪৭ সাল থেকেই দেশের প্রকৃত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর গুরুত্ব প্রমাণের জন্য কদিন পর পর অঘটন ঘটায়।

 

 

এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পাশাপাশি উভয় দেশের সীমান্তে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রভাব দুই দেশের সীমানা পেরিয়ে আঘাত হেনেছে উপসাগরীয় অঞ্চল ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে। একদিকে ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু নদীর পানিপ্রবাহ-সংক্রান্ত ১৯৬২ সালের চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় করা এ চুক্তি ১৯৬৫ সাল ও ১৯৭১ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও কার্যকর ছিল। কারণ এ নদীর ৮০ শতাংশ পানি পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং সে দেশের অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক অবদান রাখে। ভারতীয় অনলাইন বার্তা সংস্থা ইন্ডিয়া ডটকম পরিবেশিত খবরে দাবি করা হয়েছে- এ পানিপ্রবাহ বন্ধ করার ফলে পাকিস্তানের ২০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

 

পাল্টা জবাব হিসেবে ভারতের সব বিমানের জন্য আকাশপথ বন্ধ করেছে পাকিস্তান। এতে বিমান পরিবহন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের গমন ও পশ্চিমা অনেক দেশে বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিপদে পড়েছে ভারত। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তান আরোপিত আকাশ অবরোধের কারণে শুধু ভারতীয় বিমান সংস্থা ইন্ডিগোরই শেয়ার মূল্য ৪ শতাংশ কমে যায়, যার ফলে ৮ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এমন অর্থনৈতিক সংকট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একান্ত অনভিপ্রেত।

 

 

এমনই এক পরিস্থিতিতে স্পর্শকাতর কাশ্মীর সীমান্তে স্বল্পপাল্লার অস্ত্রের গোলাগুলি শুরু করেছে উভয় পক্ষ। সাগর ও আকাশপথে নানারকম কসরত করছে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর হরেক রকমের যুদ্ধজাহাজ ও জঙ্গিবিমান। ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল। কারণ নিরাপত্তাশাস্ত্রে বহু প্রচলিত কথা হলো- বিশ্বযুদ্ধের মতো মহাযুদ্ধও শুরু হয় মাত্র একটি বুলেট বা কামানের একটি মাত্র গোলা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। ইতোমধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা হলেও নানা কারণে সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা কম বলেই মনে করেন একশ্রেণির নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং রণকৌশল বিশেষজ্ঞ।

 

 

এসব কারণের অন্যতম হলো- ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা। ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি থাকা ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের সীমান্ত এলাকায় পারমাণবিক ধ্বংসলীলা পরিচালনা করলে উভয় দেশের মানুষ, ফসল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, যা কোনো দেশের রাজনৈতিক শক্তি বরদাশত করবে না। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা পৃথিবীর বুকে সব যুদ্ধের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ার মাধ্যমে অস্ত্রবাণিজ্য প্রসারের জন্য কুখ্যাত। সেই আমেরিকা এখন ট্রাম্প ঘোষিত এবং সাময়িকভাবে স্থগিত শুল্কনীতির কারণে নিজেই বেকায়দায় পড়েছে। এ শুল্কনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন।

 

 

চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য অনেকটাই ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের ওপর নির্ভরশীল। পাক-ভারত যুদ্ধের সূত্র ধরে কোনো সাগর-মহাসাগর অশান্ত হলে বা সমুদ্রে কোনো কারণে অবরোধ হলে বাধাগ্রস্ত হবে চীনের বাণিজ্য, যা চীন কখনোই চাইবে না। চীনের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই সীমান্ত রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে চীনকে পাশে চাইবে উভয় দেশ এবং প্রতিপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগের অনুরোধ জানাবে। এমন অনুরোধ মানা বা না মানা উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীনের বাণিজ্যিক স্বার্থ। এমন সব সমীকরণের পরেও বর্তমান পরিস্থিতিতে চমক সৃষ্টি করে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু অসম্ভবও কিছু নয়।

 

 

পাক-ভারত যুদ্ধ হলে বাংলাদেশ কেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে সে বিষয়ে আগাম ধারণা এবং সম্ভাব্য সমস্যা মোকাবিলার কৌশল প্রণয়ন করে রাখা জরুরি। উভয় পক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হলে পাকিস্তান চাইবে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সার্বিক নজর কেবল পাকিস্তান সীমান্তের দিকে যেন নিবিষ্ট না থাকে। আর এজন্য বাংলাদেশ, মিয়ানমার বা চীন সীমান্তে উত্তেজনা, এমনকি সীমান্ত সংঘাত সৃষ্টির জন্য পাকিস্তান ও তার মিত্ররা চাপ সৃষ্টি করবে। ভারতীয় আকাশপথ যদি বাংলাদেশের বিমানের জন্য অনিরাপদ বা নিষিদ্ধ হয় তবে মহাসংকটে পড়বে বাংলাদেশ। একই সংকট হবে সমুদ্রপথ অবরুদ্ধ বা যুদ্ধসংকুল হয়ে উঠলে।

 

 

 

ভারত বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। নেপাল ও মালদ্বীপের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে অনেক আগেই। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গেও চলছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। নিজ দেশে ওয়াক্ফ বিলসহ নানা ইস্যু নিয়ে বিপাকে রয়েছে মোদি সরকার। আবার অন্যদিকে আমেরিকা থেকে হাত বেঁধে ফেরত পাঠানো হচ্ছে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের। কানাডার সঙ্গেও চরম বৈরী সময় কাটছে ভারতের। থেমে থেমে জ্বলে উঠছে মিজোরাম। হুঙ্কার ছেড়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি। এরই মধ্যে এত নিয়ন্ত্রণ এবং গোয়েন্দাসহ বিপুল সেনা নিয়োজিত থাকা অবস্থায় পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলা একদিকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, অন্যদিকে এটি সাজানো নাটক বলে প্রচারণাকে স্থায়িত্ব দিচ্ছে। ভারতের এমন নাজুক পরিস্থিতি অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে সুযোগও সৃষ্টি করেছে। সংশ্লিষ্ট সবার সতর্কতা ও সুযোগ বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

 

 

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট