কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ : বয়ানে বিবর্তন

ড. হাসান মাহমুদ [প্রকাশ : যুগান্তর, ১৭ আগস্ট ২০২৫]

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ : বয়ানে বিবর্তন

বর্তমানে মূলধারা বাংলাদেশে ‘পাকিস্তান’ শব্দটা জাতীয় শত্রু হিসাবে পরিচিত হলেও এ শব্দের অর্থ ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অন্যরকম ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা আদায়ের প্রেক্ষাপটে ১৯৪০-৪৭ সালে পাকিস্তান ছিল বাঙালি মুসলমানের জন্য মুক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের এক প্রতিশ্রুতিময় ধারণা। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এসে সেই একই শব্দ হয়ে ওঠে দমন, বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নের প্রতীক। মাত্র ২৪ বছরের মধ্যেই পাকিস্তান শব্দের অর্থের পালাবদল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও বিচ্ছিন্নতার এক অনন্য উদাহরণ।

 

১৯৪০-৪৭ : বাঙালি কল্পনায় পাকিস্তান

 

সাধারণভাবে একাডেমিয়াতে পাকিস্তানের ইতিহাসের আলাপগুলো প্রধানত স্থান হিসাবে পাঞ্জাব এবং নেতৃত্বের ভূমিকায় জিন্নাহর মতো নেতাদের ওপর আলোকপাত করে। আর তা একইসঙ্গে এরই মধ্যে বাংলার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানকে উপেক্ষা করে। আবার বাংলাদেশে পাকিস্তান সম্পর্কিত ইতিহাসের আলাপগুলোতে মনোযোগের কেন্দ্রে থাকেন ফজলুল হক বা সোহরাওয়ার্দীর মতো ব্যক্তিত্বরা, আর অবহেলিত থেকে যান বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত লেখকরা, যেমন-আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। ঐতিহাসিক নীলেশ বোস নানা ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, বাঙালি মুসলমানের এসব চিন্তক পাকিস্তানের ধারণাকে বাঙালি সাহিত্যিক ঐতিহ্য, ভূগোল এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ‘পাক-বাংলা’ নাম দিয়ে নিজেদের জন্য একটা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন নির্মাণ করেছিলেন। আবুল মনসুর আহমদের রচিত ‘পাক-বাংলার সংস্কৃতি’ বইতে এ চিন্তার পূর্ণ বিকাশ দেখা গেছে।

তারা পাকিস্তানকে শুধু ধর্মীয় ভিত্তিতে গঠিত একটি রাষ্ট্র হিসাবে ভাবেননি। তাদের কল্পনায় ছিল এমন এক ‘পূর্ব পাকিস্তান’, যেখানে বাংলা ভাষা, বাঙালি মুসলমানের লোকসংস্কৃতি, পুথি সাহিত্য, গ্রামীণ গান ও মুসলিম শব্দভান্ডারের মর্যাদা থাকবে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু ভদ্রলোক-আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি মুসলিমের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিকশিত করা। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির এক নবজাগরণ। তাদের এ সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নের কেন্দ্রে ছিল, একইসঙ্গে হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি এবং এবং অ-বাঙালি মুসলিম শ্রেণির প্রভাব থেকে মুক্তির বাসনা।

 

 

পূর্ব বাংলার সেসব চিন্তক বাঙালি মুসলমানের যে পাকিস্তান ভাবনা তৈরি করেন, তা ছিল সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক দর্শনে প্রভাবিত। কেন্দ্রীয় (দিল্লিকেন্দ্রিক) শাসনব্যবস্থার বিপরীতে প্রতিটি জাতির আলাদা মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। পাকিস্তানকে দেখা হয়েছিল ফেডারেল কাঠামোয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও স্থানীয় ক্ষমতায়নের পথ হিসাবে। পূর্ব বাংলার কৃষি, নদীনির্ভর জীবন এবং বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্যকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে উন্নত করার স্বপ্ন ছিল। শিল্পোন্নয়ন, কৃষির আধুনিকায়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জন করা ছিল এ কল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

 

বাঙালি মুসলমানের এ পাকিস্তানপন্থাকে কবি ও লেখকরা বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় তুলে ধরেন। নদী, নৌকা, ভাটিয়ালি গানের সুর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় ইসলামি প্রতীক, যেমন সুজলা-সুফলা, সবুজ গ্রামবাংলার নদী-খালে-বিলে ভেসে চলা পাল তোলা নৌকা বা সকাল-সন্ধ্যায় ভেসে আসা আজানের ধ্বনি। পাকিস্তান হয়ে ওঠে মুক্তি, ন্যায়বিচার ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, যেখানে ইসলামি নৈতিকতা ও বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিলন ঘটে।

 

 

একাত্তরের পর : চেতনার বয়ানে পাকিস্তান

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বাংলাদেশের জনমনে দমনমূলক সামরিক শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় না বসিয়ে সশস্ত্র দমন অভিযান চালায়। তাদের সমর্থন জোগায় পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচিত আঞ্চলিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামন্ত ও উচ্চশ্রেণির মুসলমানদের অনেকে। বাঙালি মুসলমানের কাছে পাকিস্তান হয়ে দাঁড়ায় উর্দুভাষী, অবাঙালি প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতীক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে অস্বীকারকারী শক্তি হিসাবে পাকিস্তানবিরোধী সাংস্কৃতিক বয়ান গড়ে ওঠে।

 

 

এ বয়ানে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক শোষণের কেন্দ্র। পূর্ব বাংলার কৃষি ও শিল্প থেকে অর্জিত সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় হতো। প্রশাসনিক ক্ষমতা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা আর সামরিক নেতৃত্বের হাতে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বয়ানে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের এ অসম সম্পর্ককে ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ’-এর উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পাকিস্তান হয়ে ওঠে গণহত্যা, ধর্ষণ, শরণার্থী স্রোত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক। একাত্তরের চেতনায় পাকিস্তান মানে স্বাধীনতা ও মর্যাদার সরাসরি বিপরীত শক্তি, তথা স্বাধীনতাবিরোধী।

 

 

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান শব্দের অর্থে মিল-অমিল

 

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪০-৪৭ : মুসলিম সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান ভাবনার কেন্দ্রে। আর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক আর বেসামরিক শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি সংখ্যাগুরুর আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন জন্ম দেয় বাংলাদেশ। এ দুই স্বাধিকার আন্দোলনেই মূল লক্ষ্যে ছিল বাংলার বাইরে অবস্থিত রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আধিপত্যবিরোধিতা-১৯৪০-৪৭ : কংগ্রেস ও দিল্লির বিরুদ্ধে অবস্থান আর ১৯৭১ সালে রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান। অর্থাৎ, উভয় সময়েই ‘কেন্দ্র’ বনাম ‘প্রান্ত’বিরোধী রাজনীতি একটি সাধারণ সূত্রে যুক্ত ছিল।

 

 

কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আধিপত্যবাদীবিরোধী পক্ষ বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান শব্দেরও পার্থক্য ঘটেছে : ১৯৪০-৪৭ : পাকিস্তান ছিল রাজনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক। কিন্তু ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে সেই পাকিস্তানই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দমন, আর্থিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের প্রতীক। ১৯৪০-৪৭ সময়ে একটা ফেডারেল কাঠামোর পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব-এ বিশ্বাস ছিল প্রবল। কিন্তু ২৪ বছরের যুক্ত পাকিস্তানের সময়ে সেই বিশ্বাস প্রতিস্থাপিত হয়, ঠিক বিপরীত আরেকটা বিশ্বাস দিয়ে যে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রই বাঙালি মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য প্রধান হুমকি। ফলে দেখা যায়, বাঙালি মুসলমান ১৯৪০-৪৭ সময়কালে ভারতের সব মুসলমানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে মুসলিম ঐক্য ও বাঙালি মুসলিম স্বাতন্ত্র্য, একইসঙ্গে ধারণ করার প্রচেষ্টা। সেই তারাই আবার মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।

 

 

পাকিস্তান নিয়ে এ দুই ভিন্ন বয়ান আমাদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক শিক্ষা হাজির করে। রাজনৈতিক প্রতীকের অর্থ ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বদলালে আমূল পালটে যেতে পারে। ১৯৪০-এর দশকে পাকিস্তান ছিল মুক্তির স্বপ্ন, কিন্তু মাত্র আড়াই দশক পরে সেটি হয়ে ওঠে মুক্তির প্রধান প্রতিবন্ধক। তবে উভয় সময়েই আত্মনিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল। পার্থক্য ছিল-কোন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সেই দাবি উঠছে এবং কোন কাঠামোর ভেতরে তা পূরণের আশা করা হচ্ছে।

 

 

উপসংহার

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে ‘পাকিস্তান’ শব্দটির স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে রূপান্তর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক স্বপ্নের ধারক রাজনৈতিক প্রতীক চিরকাল একই অর্থ বহন করে না। পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা ও ক্ষমতার সম্পর্ক তার মানে বদলে দেয়।

 

 

১৯৪০-৪৭ সালের বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের মধ্যে দেখেছিলেন সাংস্কৃতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের পথ। কিন্তু একাত্তরের প্রেক্ষাপটে সেই পাকিস্তানই হয়ে ওঠে বাঙালি জাতিসত্তা ও স্বাধীনতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

 

 

এ বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রগঠনের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা সম্ভব। আমাদের মুক্তির বয়ান যেমন পাকিস্তানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি তা শেকড় গেড়ে আছে সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়, যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা সবসময়ই কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল।

 

 

‘পাকিস্তান’ বয়ানের রূপান্তর : ১৯৪০-৪৭ বনাম ১৯৭১-পরবর্তী

 

 

১৯৪০-৪৭ সালের বাঙালি কল্পনায় পাকিস্তান

 

রাজনৈতিক অর্থ : সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীয় শাসন থেকে মুক্তি, ফেডারেল কাঠামো।

 

সাংস্কৃতিক অর্থ : বাংলা ভাষা ও বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশের প্রতিশ্রুতি।

 

অর্থনৈতিক অর্থ : পূর্ব বাংলার কৃষি ও শিল্পোন্নয়ন, স্বনির্ভরতার স্বপ্ন।

 

প্রতীকের চরিত্র : মুক্তি, পুনর্জাগরণ, ন্যায়বিচারের প্রতীক।

 

কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক : দিল্লি/কংগ্রেসকেন্দ্রিক আধিপত্যের বিরোধিতা।

 

ঐক্যের ধারণা : মুসলিম ঐক্য+বাঙালি মুসলিম স্বাতন্ত্র্য।

 

একাত্তরের পরের বয়ানে পাকিস্তান

 

রাজনৈতিক অর্থ : দমনমূলক সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ।

 

সাংস্কৃতিক অর্থ : উর্দুকেন্দ্রিক আধিপত্য, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দমন।

 

অর্থনৈতিক অর্থ : পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য।

 

প্রতীকের চরিত্র : দমন, শোষণ ও নিপীড়নের প্রতীক।

 

কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক : ইসলামাবাদ/রাওয়ালপিন্ডি/পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক আধিপত্যের বিরোধিতা।

 

ঐক্যের ধারণা : পূর্ণ বিচ্ছেদ, বাঙালি জাতিসত্তার অগ্রাধিকার।

 

ড. হাসান মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কাতার