কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পানি নিয়ে নতুন সংকট

♦ হুমকির মুখে কৃষি ♦ হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য ♦ নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর- রফিকুল ইসলাম রনি । সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ মার্চ ২০২৫

পানি নিয়ে নতুন সংকট

দেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ। হুমকির মুখে কৃষি। জলাশয়ে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার আগেই এসব এলাকার অধিকাংশ পাম্প ও নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে পানের ও গৃহস্থালি কাজের জন্য পানি নিয়ে মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

ইরি বোরো মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় শঙ্কিত কৃষক। উত্তরাঞ্চলের নদনদীগুলো নিয়মিত ড্রেজিং না করায় বর্ষার পরপরই পানি থাকছে না। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুরসহ অনেক জেলায় পানির সংকটে ফসলি জমি, মাঠঘাট চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে নদনদী, খালবিল, পুকুরের পানি।

 

 

ভারতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মা হারিয়েছে সেই চিরচেনা রূপ। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় আয়তন কমে নেমে এসেছে অর্ধেকে। কমেছে গভীরতা। পদ্মার বুকজুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর। অববাহিকায় কমেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। বেড়েছে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ১৯৭৭ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে হয় ঐতিহাসিক লংমার্চ। যখন পানি দরকার হয়, তখন পানিপ্রবাহ বন্ধ করা হয়। আর যখন পানির দরকার নেই তখন পানি   ছেড়ে দেওয়া হয়। সে কারণে রাজশাহী এবং পাশের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর বরেন্দ্র এলাকায় শীত শেষ না হতেই পানিশূন্যতায় চৌচির হয়ে পড়েছে খালবিল, পুকুর। পান করার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

 

 

এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষসহ পশ্চিমের অন্যান্য সেচ প্রকল্পও হুমকির মুখে। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী পানি পেয়েছিলাম কিন্তু রিজার্ভ না থাকায় সাগরে চলে গেছে। ২৫-২৬ বছর ধরে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যত্রতত্র পানি তুলছে। পানির স্তর যে নেমে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। অন্তত ১৬০-১৮০ ফুট পানি নেমে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও নজির নেই পানির জন্য মানুষ আত্মহত্যা করে। আমাদের এখানে পানির জন্য কৃষক আত্মহত্যা করার নজির আছে। কৃষিতে যেমন প্রভাব পড়েছে। আর্সেনিক দেখা দিয়েছে। দেশি মাছ নেই বললেই চলে। পশুপাখিও নেই। সবকিছুতেই বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারি তাহলে সামনে আরও কঠিন সংকট দেখা দেবে।’

 

 

দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার নয় উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত এ বিল এখন বর্ষার শেষেই পানিশূন্য হয়ে পড়ে। অথচ একসময় এখানে পানিপ্রবাহ সব সময় চলমান ছিল, আর এখন অনেকটাই পানিশূন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম হুমকিতে পড়েছে দেশের বৃহত্তম এ বিলের জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, মাছ, জলচর প্রাণী। তিন দশক আগেও বছরের এ সময়ে থইথই পানি ছিল চলনবিলে। ছিল মাছসহ জীববৈচিত্র্যের আধার। বর্ষার এ অপার ‘মিঠাপানির সমুদ্র’ শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হতো সবুজের গালিচায়। পলিবাহিত মাটিতে বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পাল্টে গেছে সে চিত্র। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বিশাল বিল অনেকটাই পানিশূন্য।

 

 

বিলের এ পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া পরিবেশের দূষণ এবং যথেষ্ট গাছপালা না থাকাকেই দায়ী করছেন তাঁরা। এ ছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাও রয়েছে। বিলের মাঝে বড় বড় পুকুর খনন করে পানির প্রবাহ বন্ধ করা হচ্ছে। চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক রাজু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফারাক্কার বাঁধ দিয়ে ভারত যে নিয়ন্ত্রণ করছে চলনবিলে পানিসংকটের অন্যতম কারণ এটি। রাজশাহীর চারঘাটে বরেন্দ্র অঞ্চলে বাঁধ দেওয়ার কারণে পদ্মার পানি চলনবিলে প্রবেশ করছে না। ইরি বোরো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার কারণে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মৎস্যজীবী ছিল চলনবিলের সবচেয়ে বড় শ্রমিকশ্রেণি। কিন্তু এখন মৎস্যজীবীদের পেশা পরিবর্তন হয়েছে পানিসংকটের কারণে। 

 

 

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট সংকটের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান করা যেতে পারে। হাওর-বাঁওড়, বরেন্দ্র অঞ্চলে যেমন সরকারের নজর রয়েছে, চলনবিল নিয়ে সেটা নেই। সরকারি নজর বাড়ানো দরকার।’ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্রমেই আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নামতে শুরু করেছে। এতে ইরি বোরো চাষের সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। বাধ্য হয়ে অনেকেই ১০ থেকে ১৫ ফুট গর্ত বা কুয়া করে তার মধ্যে সেচ মেশিন বসিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রংপুর, পাবনা, নাটোরে ইরি বোরো মৌসুমে ১০ থেকে ফুট ১৫ ফুট গর্ত খনন করে তার মধ্যে সেচ পাম্প বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও কয়েক দিন পরপর পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে পানির সন্ধানে অনেকেই আবার গভীর গর্ত খনন করছেন। ইরি বোরো ধান সেচনির্ভর। অথচ চলতি মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার চাষিরা। তাঁরা বলছেন, পানির স্তর এভাবে নামতে থাকলে আগামী বছরগুলোয় সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।