পারমাণবিক ধ্বংসলীলাই আধুনিক সভ্যতা?
জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, মিসর থেকে [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২১ জুন ২০২৫]

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে এখন সীমান্তের রেখাগুলো রক্ত দিয়ে আঁকা। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিছু রাষ্ট্র বিপন্ন, বিহ্বল এবং বিবর্ণ কূটনীতির কোলাজে রঙ খুঁজে ফেরে তারা। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কাঁপুনিতে যখন গাজার ইট, লেবাননের পাথর আর ইয়েমেনের ধুলো শত্রু আর মিত্রের পার্থক্য ঘোলাটে করে তোলে, তখন সেই কাঁপুনি গিয়ে পৌঁছে জর্ডানের রাজপ্রাসাদ আর দামেস্কের ধ্বংসস্তূপে। এখানেই শুরু হয় আরেক অধ্যায় নীরবতায় লেখা কূটনৈতিক নাট্যরচনা, যেখানে কথার চেয়ে ছায়াই বেশি সরব।
জর্ডান এক অদ্ভুত দ্বৈততার দেশ। একদিকে পশ্চিমা অর্থনীতি ও আমেরিকান সামরিক ছাতার নিচে আশ্রয়প্রাপ্ত, অন্যদিকে জাতিগত চেতনায় গাঁথা একটি আরব আত্মা, যার শিরায় এখনো প্রবাহিত হয় ফিলিস্তিনের শোক। রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয় যিনি নিজেকে ঘোষণা করেন জেরুজালেমের পবিত্র স্থানসমূহের অভিভাবক, অথচ তেলআবিবের সঙ্গে তার সরকারের নিরাপত্তা সমঝোতা চলে প্রতিদিন। এই দ্বন্দ্ব জর্ডানের কূটনীতিকে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধ ভারে রেখেছেযেখানে তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য আহাজারি করেন জাতিসংঘে, অথচ বিমানঘাঁটিতে নামতে দেন ন্যাটোর সশস্ত্র বিমানগুলো।
২০২৫-এর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ জর্ডানকে নিয়ে গেছে এক জটিল অগ্নিপথে।
ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতির কারণে জর্ডান জুড়ে ব্যাপক জনরোষ, লাখো মানুষের প্রতিবাদ মিছিল। কিন্তু রাজপ্রাসাদের ভেতর শান্তভাবে চলে কূটনৈতিক ব্যালান্স একদিকে তেল আবিবের প্রতি সতর্কতা, অন্যদিকে ওয়াশিংটনের পরামর্শে ‘স্থিতিশীলতা রক্ষার’ নামে গোপন সহযোগিতা। এ এক দুর্বিষহ কূটনীতি যেখানে জর্ডান প্রতিদিনই দুমুখো প্রতিচ্ছবিতে নিজেকে রক্ষা করে, অথচ জানে গাজা দগ্ধ হলে, সেই আগুনের ছাই একদিন পৌঁছবেই আম্মানে।
আর সিরিয়া এক অন্ধকার মহাকাব্যের নাম, যেখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদ লেখা হয় বারুদের অক্ষরে। বাশার আল-আসাদের সরকার কূটনীতিকে জনমত রক্ষার অস্ত্র নয়, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় মনে করেছিল। ২০১১-র গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া এক রাষ্ট্র আজ দাঁড়িয়ে আছে রাশিয়ার সহায়তায় এবং ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপে টিকে থাকা এক ছায়া-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে। দামেস্ক এখন আর স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং ইরান-রাশিয়া-হিজবুল্লাহ জোটের একটি কৌশলগত ব্যূহ, যেখান থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছোড়া হয় সতর্ক হুঙ্কার আর সীমিত রকেট। সিরিয়ার কূটনীতি এখন একধরনের ভয়ংকর খেলা যেখানে মুখে শান্তির আহ্বান, আর বাস্তবে নিজেদের মাটিকে পরিণত করেছে ছায়া-সংঘাতের পরীক্ষাগারে।
বাশার সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলছে ‘আমরা আরব ঐক্যের পক্ষে, আমরা ফিলিস্তিনিদের পাশে’, অথচ বাস্তবতা হচ্ছে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে উঠেছে ইরানপন্থি মিলিশিয়াদের ট্রানজিট রুট, যা দিয়ে হিজবুল্লাহর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েল অন্তত ছয়বার বোমাবর্ষণ চালিয়েছে সিরিয়ার অভ্যন্তরে লক্ষ্য শুধু হিজবুল্লাহর ঘাঁটি নয়, বরং তেহরানের প্রযুক্তিগত চর্চাকেন্দ্র, ড্রোন কারখানা এবং রকেট লঞ্চিং স্থাপনা। দামেস্ক এসব নিয়ে নীরব থাকে, কারণ জানে প্রতিশোধ নেওয়া তাদের সামর্থ্যরে বাইরে। তবে এই নীরবতা একদিন বিস্ফোরিত হবে। সিরিয়া জানে, তার ভূমি হয়ে উঠছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রধান ফ্রন্ট এবং এই সংঘাতে সে আর নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। নিকট ভবিষ্যতেই এটি প্রমাণিত হবে। যদি ততদিন ইরান অক্ষত থাকে। কারণ ভয়ংকর রাক্ষুসে গ্রাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে এগিয়ে আসছে, তাতে কোনো পূর্বানুমান করা কঠিন। তবে এটা ধারণা করা যায়, সম্মিলিত বেদনার্ত রক্ত ঝরার দিন এলো বলে। হয়তো এরপর বিশ্ব শান্ত হবে, নয়তো নতুন আঙ্গিকে শুরু হবে মহাযুদ্ধ। কিন্তু এটা নিশ্চিত, ক্ষমতা আর অস্তিত্বের বর্তমান যুদ্ধে একটি স্পষ্ট উত্তর আসবেই। তবে সেটি কোন সমীকরণে, তা কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। এরপর কী হবে! জর্ডান ও সিরিয়া, আজ দ্বিধাগ্রস্ত মঞ্চের দুই বিপরীত অংশ।
একদিকে নিয়ন্ত্রিত নিরপেক্ষতা, অন্যদিকে শর্তাধীন পক্ষপাত। জর্ডান যে শান্তির চেয়ে স্থিতাবস্থাকে বেছে নিচ্ছে, তা এক চোখের কূটনীতি যা হয়তো অস্তিত্ব রক্ষা করে, কিন্তু মর্যাদাহানি নিশ্চিত করে। আর সিরিয়ার পথ এক অন্ধ বিশ্বাসের পথ, যেখানে তারা আর নিজের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে না, কেবল শত্রুদের লক্ষ্যে নিজ ভূমিকে ব্যবহৃত হতে দেয়। এই দুই ভূখণ্ডের ভূমিকাই প্রমাণ করে, মধ্যপ্রাচ্যে আর কেউই নির্দোষ নয়। যে চুপ থাকে না, সে ভূমিকা নেয়। যে লড়াইয়ে নামে না, সে পথ করে দেয় দখলদারদের। ইরান চুপ থাকেনি। দখলদারদের কোনো সুযোগ দেবে না। যতক্ষণ জীবন রয়েছে। এবার ইসরায়েল নিজের অস্তিত্ব এবং ক্ষমতার লড়াইয়ে মরণপণ লিপ্ত। বিশ^শক্তি স্পষ্ট বিভক্ত হচ্ছে। পরাশক্তি দেশগুলো বেছে নিচ্ছে মিত্র। ইরানের পক্ষে পাল্লা ক্রমশ ভারী হচ্ছে। রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া এক হয়েছে ইরানের পক্ষে। এছাড়া অন্যান্য স্বাধীনকতকামী জাতি গোষ্ঠী তো রয়েছেই। হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ মিশে গেছে ইরানের সঙ্গে। গোপনে পাকিস্তানও সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপের কিছু দেশ রয়েছে ইসরায়েলি জোটে। এর মানে হচ্ছে, পরমাণু শক্তিধর পৃথিবী স্পষ্টতই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পরিণতি কী হবে! আবার কি আরেকটি হিরোশিমা-নাগাসাকি? নাকি আরও অমানবিক-বিধ্বংসী কোনোকিছু!
কোনোভাবেই এটা মনে করা উচিত নয় যে, এই যুদ্ধক্ষোভ একদিনের। যুগের পর যুগ নির্যাতন, অপমান, রক্ত আর ধ্বংসের বিস্ফোরণ এটি। এই ভয়ানক মৃত্যুখেলার সমাধান আসবে। হয়তো অনেক মৃত্যু-ধ্বংস হবে। হয়তো আমেরিকা সক্রিয়ভাবে গর্জে উঠবে। অথবা হয়তো আচমকা অন্য কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যেই একটা সমাধান স্পষ্ট হবে। যদি তা না হয়, তাহলে ব্যবহৃত হতে পারে সর্বশেষ মারণাস্ত্র। আর তখনই সব শান্ত হবে! নাকি বিভিন্ন মেরুর পরমাণু শক্তিধর অধিকাংশ দেশ জড়িয়ে যাবে পারমাণবিক ধ্বংসলীলায়! এটাই কি আধুনিক সভ্যতার কূটনীতি? যেখানে ভাষা বা পরিস্থিতি নয়, ভূমি কথা বলে! কথা বলা শেষ হলে মাটি সাক্ষ্য দেবে রক্ত, ধ্বংস, মৃত্যু আর নির্মমতার। তারপর সবকিছু শান্ত হলে পরে, আবার হয়তো গড়ে উঠবে অন্যরকম সভ্যতা।
হাজার বছর আগের ইরানকে আমরা ভুলে গেছি। হয়তো আবার হাজার বছর পরে, বর্তমান ইরানকেও ভুলে যাবে পরবর্তী প্রজন্ম। এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মানুষের মানসিকতাই এমন ইতিহাস ভুলে তারা গড়ে তুলতে চায়, নিরাপদ ভবিষ্যৎ। যেখানে কেবলই গুরুত্বপূর্ণ, বর্তমান। সত্যিই কি এইভাবে সভ্যতা গড়ে ওঠে? নাকি সভ্যতার আড়ালে, হিংস্র জানোয়ার-অসভ্য আর বর্বর গোষ্ঠীর রক্তের হোলিখেলা চলে যুগের পর যুগ। সেখানে বিবেকবান মানুষের পক্ষে আদৌ কোনো সভ্যতার স্পর্শ থাকে?
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কায়রো, মিসর