কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

[সূত্র : শেয়ারবিজ, ২৪ জুন ২০২৫]

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি


বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনীতিকে কেন্দ্র করে কিছু প্রশ্ন আবারও দৃঢ়ভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ প্রশ্নগুলো শুধু কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে নয়; বরং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কতিপয় রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের দুর্বৃত্তায়ন সম্পর্কে। তাদের কর্মকাণ্ডে বিশ্বমানবতা, বৈশ্বিক ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক নীতিনৈতিকতার মৌল ভিত্তিগুলো অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এগুলো এমন প্রশ্ন, যেগুলো উচ্চারণ করা সহজ হলেও বাস্তবতায় তা এক নির্মম বৈষম্য ও দ্বিচারিতার নির্মম দলিল হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো যখন একদিকে নিজেদের স্বার্থে যেকোনো অস্ত্রের অধিকার নিশ্চিত করে, তখন অন্যদিকে দুর্বল ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আত্মরক্ষার সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করলে সে পথ রুদ্ধ করে দেয়।

 

 এ দ্বিমুখী নীতি কেবল কূটনৈতিক অসততা নয়, এটি হচ্ছে সেই আদর্শিক অসভ্যতা ও ভণ্ডামির নগ্ন প্রকাশ, যার ফলে গোটা বিশ্বব্যবস্থার ন্যায্যতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। এটি এমন এক 'আধিপত্যবাদী অনৈতিকতা', যা জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাস্টের (১৭২৪-১৮০৪) 'নিঃশর্ত নৈতিক কর্তব্য (ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভ)'-এর ধারণার পুরোপুরি বিপরীত, যেখানে একটি আচরণ তখনই ন্যায়সংগত, যদি তা সর্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য হয়। আন্তর্জাতিক চক্রান্তে দ্বৈত মানদণ্ডের শিকার 'নিরাপত্তা' ও 'হুমকির' সংজ্ঞা।

 

তথাকথিত শক্তিধর একটি রাষ্ট্র যদি নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে পারমাণবিক অস্ত্র রাখে, তখন তা আত্মরক্ষার (ডিটারেন্স) বৈধ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়; অথচ কোনো উদীয়মান রাষ্ট্র একই লক্ষ্য নিয়ে এগোলে তখন সেটিকে 'বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, এই দ্বৈত মানদণ্ড কি আদৌ ন্যায়বোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই অসামঞ্জস্য শুধু রাজনৈতিক পক্ষপাত নয়, বরং তা হলো গভীরভাবে প্রোথিত এক ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি ও চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ, যেখানে ক্ষমতার আধিপত্যকেই 'নীতির উৎস' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এমনই প্রেক্ষাপটে ইরান যখন পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের সীমিত অধিকার চাইছে, তখন তাকে 'অভিশপ্ত' বা 'উগ্র' সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়। অথচ আমেরিকা, রাশিয়া, কিংবা ইসরায়েল যদি বিপুল পারমাণবিক ভাণ্ডার নিয়ে বসে থাকে, তখন তারা হয়ে ওঠে তথাকথিত 'বিশ্বের ভারসাম্য রক্ষাকারী' তথা মানবতা ও বিশ্ব নিরাপত্তার ধারক-বাহক। এখানে প্রশ্ন ওঠে, এই 'বিচার' করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? বিশ্ব জনমত, নাকি জাতিসংঘ? বাস্তবে দেখা যায়, এই কর্তৃত্বের উৎস একটাই-সেটা বিশ্বব্যাপী তাদের অর্থনৈতিক শক্তির দম্ভ ও সামরিক আধিপত্য। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর (১৯২৬-১৯৮৪) মতে, ক্ষমতা জ্ঞান উৎপন্ন করে এবং সেই সৃষ্ট জ্ঞানের বৈধতা দাবি করে। অর্থাৎ ক্ষমতাই জানের ও নিয়মনীতির সংজ্ঞা তৈরি করে এবং সেসবের পক্ষে 'ন্যায়'-এর দাবি তোলে।

 

 

জ্ঞান ও ক্ষমতা একে অপরকে নির্দিষ্ট করে। ক্ষমতা জ্ঞানকে উৎপাদন ও পুনর্গঠন করে, আর সেই জ্ঞানের ভিত্তিতেই ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাস্তবতাই আজ বৈশ্বিক নিরাপত্তার ধারণাকে এক অবিচারমূলক রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছে। ফলে পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতার একচোখা নীতি তথা নিরাপত্তা মানেই নিজের জন্য মারণাস্ত্র রাখার 'অধিকার', আর অন্যের জন্য সেটা অর্জন বা রাখা 'অপরাধ'। এই যে 'আমি রাখলে তা নিরাপত্তা, তুমি রাখলে তা হুমকি'-এ কেমন ন্যায়নীতি? এটি কি কেবল বিশ্ব মোড়লদের শিশুসুলভ 'মামার বাড়ির আবদার', নাকি আধুনিক বিশ্বশাসনের এক প্রাতিষ্ঠানিক 'মগের মুল্লুক' মানসিকতা? এই প্রশ্ন শুধু ভাষার রঙ্গব্যঙ্গ নয়, এটি একটি অশুভ রাজনৈতিক যুক্তির অনাবৃত স্বরূপও বটে।

 

 

এই দৃষ্টিভঙ্গি আসলে ইংরেজ দার্শনিক টমাস হোবেসর (১৫৮৮-১৬৭৯) 'প্রকৃতির অবস্থা (স্টেট অব ন্যাচার)'-এ ফিরে যাওয়ার মতই, যেখানে 'ক্ষমতাই ন্যায়ের উৎস', আর প্রবাদের ভাষায় বলা যায়, 'যার লাঠি মোটা, তার কথাই শেষ কথা।' সেটাই বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নিয়ম তৈরি করে নিজের সুবিধা অনুযায়ী এবং ভঙ্গ করে অন্যের 'অপরাধ' প্রমাণের জন্য।

 

 

 একে ফুকোর ক্ষমতা-জ্ঞান সম্পর্কের আলোকে বুঝলে বলা যায়, তথ্যপ্রবাহ, আইনকানুন, ন্যায়বিচার-সবই এখন ক্ষমতাবানের হাতের মুঠোয়। একে 'কৌশলগত ভণ্ডামি (ট্র্যাটেজিক হিপোক্রেসি)' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে, যেখানে যুক্তি নয়, বরং কর্তৃত্বই সিদ্ধান্তের মূল চালিকাশক্তি। সম্প্রতি ইসরায়েল একাধিকবার ইরানের অভ্যন্তরে সামরিক হামলা চালিয়েছে, যেখানে নিহত হয়েছেন দেশটির উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারাসহ অসংখ্য সাধারণ নাগরিক। এখন প্রশ্ন হলো, অন্যদেশে গিয়ে আক্রমণের এই ঘটনার ব্যাখ্যা কী? এটি কি আত্মরক্ষা, নাকি পরিকল্পিত আগ্রাসন? অথচ এর প্রতিক্রিয়ায় যখন ইরান পাল্টা মিসাইল হামলা চালায়, তখনই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও পশ্চিমা কূটনৈতিক পরিসরে তাকে 'উসকানিমূলক শক্তি' বা 'বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি' বলে আখ্যায়িত করা হয়।

 

 

 এই বৈষম্য শুধু তথ্যপ্রবাহের রাজনীতি নয়, বরং এটি 'সত্য' ও 'ন্যায়' সংজ্ঞায়নের রাজনৈতিক ক্ষমতার নিদর্শন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক হ্যানস মরগেনথাউ (১৯০৪-১৯৮০) বলেছিলেন, 'রাজনীতি বস্তুনিষ্ঠ আইন দ্বারা পরিচালিত হয়, যার মূল মানবপ্রকৃতিতে নিহিত।' আর সেই মানবপ্রকৃতিই যখন দখলদারি ও আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠে, তখন আত্মরক্ষাও হয়ে যায় অপরাধ, যদি সেটি দুর্বল কোনো রাষ্ট্র করে। 'প্রতিরক্ষা' আর 'আক্রমণ'-এই দুয়ের পার্থক্য এখন আর ঘটনাভিত্তিক নয়; বরং পার্থক্যটি নির্ধারিত হচ্ছে কে ক্ষমতাবান, কার হাতে সংবাদমাধ্যম এবং কে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার ওপর। একে ধরা যায় 'বিপরীতমুখী নৈতিকতা' (রিভার্সড ইথিক্স) বা রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ন্ত্রণের এক ধরনের 'ক্ষমতার বয়ান' (পাওয়ার ন্যারেটিভ) হিসেবে, যেখানে অন্যায়ও ন্যায় হয়ে ওঠে, যদি সেটা শক্তিধরদের পক্ষ থেকে আসে।

 

 

 বিশ্বমানবতার জন্য এটা পরিহাস হয়ে দেখা দিয়েছে, যখন নিরীহ জনসাধারণকে হত্যাকারীই হয়ে ওঠে 'শান্তির দূত'। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বাস্তবতা হলো অধিকৃত ফিলিস্তিনের গাজার মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে যখন হাজার হাজার নিরপরাধ নারী-শিশুকে অনবরত খুন করা হয়, যখন হাসপাতাল, বিদ্যালয়, সংবাদকর্মী, সাহায্য সংস্থার কর্মীসহ সবই জায়েনবাদী ইসরায়েলি সৈন্যদের নিশানায় পরিণত হয়, তখন সেই হত্যাযজ্ঞ চালানো রাষ্ট্রই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে 'শান্তি' শেখানোর দাবিদার হয়ে ওঠে। হায়রে শান্তি। এ রকম ভণ্ড দাবিদারের মুখোমুখি হয়ে 'শান্তি' শব্দটি যেন আন্তর্জাতিক চক্রান্তে দ্বৈত মানদণ্ডের শিকার 'নিরাপত্তা' ও 'হুমকির' সংজ্ঞা। তথাকথিত শক্তিধর একটি রাষ্ট্র যদি নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে পারমাণবিক অস্ত্র রাখে, তখন তা আত্মরক্ষার (ডিটারেন্স) বৈধ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়; অথচ কোনো উদীয়মান রাষ্ট্র একই লক্ষ্য নিয়ে এগোলে তখন সেটিকে 'বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নিজেই লজ্জায় মুখ লুকায়।

 

 

ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে, রোম সাম্রাজ্যের 'রোমান শান্তি'ও (পাক্স রোমানা) ছিল মূলত দমন-পীড়নের এক মসৃণ মোড়ক, যেখানে যুদ্ধ থেমেছিল, কারণ প্রতিপক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বর্তমান সময়ের 'পাক্স আমেরিকানা' বা 'পাক্স ইজরায়েলিকা'ও কি এক ধরনের আধুনিক উপনিবেশবাদ নয়, যেখানে 'শান্তি' মানে হচ্ছে শুধু শক্তিধরের ইচ্ছার সামনে নিঃশব্দ আনুগত্য? আসলে একে ফরাসি লেখক জ্যাঁ-পল সার্জের (১৯০৫-১৯৮০) পরিভাষায় বলা যায়, 'মন্দ বিশ্বাস (ব্যাড ফেইথ)' যেখানে ভণ্ডামিকে আত্মপ্রবঞ্চনার আদর্শরূপে দাঁড় করানো হয়। এই নির্লজ্জতার চূড়ান্ত রূপ হলো, যখন হত্যাকারীই হয়ে ওঠে শান্তির বার্তাবাহক। এই বিপরীত বাস্তবতা আমাদের কেবল বিক্ষুব্ধই করে না, ন্যায়বিচার ও মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়েই উৎকণ্ঠিত করে তোলে। শক্তিমানের তথাকথিত ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার জাঁতাকলে সাধারণ মানুষের নিষ্পেষণ আজ নিয়তি হয়ে উঠেছে। এই বৈশ্বিক শঠতা, বিশ্বশান্তি রক্ষায় 'ন্যায়বিচার' নামক প্রতারণার পুনঃপুন সংজ্ঞায়ন এবং একচোখা নীতির বিরুদ্ধে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আজ গভীর বেদনা ও প্রতিবাদের সঙ্গে কবির সেই অমর উচ্চারণ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়-'তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে?'

 

 

 এই একটি প্রশ্নেই যেন ধরা পড়ে যায় পুরো বৈশ্বিক ভণ্ডামির ছায়াচিত্রে, যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেকে নির্দোষ বলে প্রতিষ্ঠা করে, অথচ দুর্বল রাষ্ট্রগুলো হয়ে ওঠে অপরাধী শুধু আত্মরক্ষার প্রয়াস নিলেই। একেই বলে-'দশাচক্রে ভগবান ভূত।' এই কথাটি কেবল এক সাহিত্যিক ক্ষোভ নয়, এটি হচ্ছে সেই চিরন্তন প্রশ্ন, যেখানে প্লেটোর 'রিপাবলিক' থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যজগৎ ও বর্তমান বিচার ব্যবস্থার অকার্যকারিতা পর্যন্ত প্রতিফলিত হয়েছে-ন্যায় কি শুধু ক্ষমতাবানের অস্ত্র? নাকি ন্যায়ের এক সর্বজনীন নৈতিক ভিত্তি থাকা উচিত, যেখানে সত্য, ক্ষমতা নয়, সিদ্ধান্তের মাপকাঠি হবে? এই প্রশ্নই আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলে এবং মনে করিয়ে দেয়, 'সাধু' পরিচয়ে যে হিংসা চালায়, তার সাধুতার স্বরূপকে আজই প্রশ্ন করতে হবে, অন্যথায় 'শান্তি' শব্দটিই একদিন ইতিহাসের ব্যঙ্গবোধে পরিণত হবে। এই প্রশ্ন কেবল ইজরাইল কর্তৃক আক্রান্ত ইরানের একক প্রশ্ন নয়; এটি সেই সব রাষ্ট্র ও জনগণেরও যারা নিজেদের অস্তিত্ব, আত্মরক্ষা ও আত্মমর্যাদা বজায় রাখার সংগ্রামে লিপ্ত। আর পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদী চক্রান্ত ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা সেটা করছে নিরন্তর।

 

 

 ফিলিস্তিন থেকে সিরিয়া, ইয়েমেন থেকে উত্তর কোরিয়া, কিংবা আফ্রিকার প্রান্তিক অঞ্চলগুলো পর্যন্ত একই প্রশ্ন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় আধুনিক বিশ্বের পক্ষপাতদুষ্ট ন্যায়বোধে। বিশ্বের দুর্বল জাতিগুলোর জায়গা কোথায়? এই বিশ্বরাজনীতির অসমতা, দম্ভ এবং তথ্য-সন্ত্রাসচালিত প্রতারণার ভেতরে মানুষ বাঁচবে কীভাবে? সত্য ও বিবেকের পক্ষে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই যেন আজ এক কঠিন যুদ্ধ, এক অদৃশ্য অথচ অবিরাম সংগ্রাম, যেখানে বিবেক প্রতিনিয়ত শক্তির কাছে ও মিথ্যার কাছে পরাজিত হয়। ফরাসি লেখক আলবেয়ার কামু (১৯১৩-১৯৬০) তার 'দ্য মিথ অব সিসিফাস'-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে মানুষ অর্থহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিদিন একটি পাথর ঠেলতে ঠেলতে উঠে পড়ে।

 

 

 আজকের বিশ্বেও সেই সিসিফাসই যেন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের রূপ; যে সত্য সে জানে, মিথ্যার প্রতিবাদ করে, কিন্তু দমন ও বিভ্রান্তির পাহাড়ে আবার ছিটকে পড়ে। তবু থেমে যায় না। সেই না থেমে যাওয়ার মধ্যেই মানবতার সম্ভাবনা নিহিত। ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো বর্বরতার বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষদের প্রতিবাদই তার প্রমাণ। সাম্প্রতিক বিশ্বের ঘটনাবলি ভণ্ডামির বিরুদ্ধে ইতিহাসের অমোঘ সাক্ষ্য দেবে। এই পৃথিবী যেন ক্রমেই পরিণত হয়েছে এক নির্লজ্জ, বেহায়া, ঘৃণ্য ক্ষমতাধরদের হাতের পুতুলে, যারা 'মানবতা'র মুখোশ পরে অনুসরণ করে যাচ্ছে 'মানবতা হত্যা'র সংঘবদ্ধ নীতি। তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলো আজ যেন 'আলো'র বাণী দিয়ে 'অন্ধকার' ছড়াতে বদ্ধপরিকর। তারপরও বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের থেমে গেলে চলবে না। তথ্যবিকৃতি, শক্তির দম্ভ কিংবা দমননীতির ভয়ে চুপ থাকা মানে কেবল অন্যায়ের সঙ্গে আপস নয়, বরং মানবতার প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা।

 

 

 তাই আমাদের কথা বলতে হবে সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে ও প্রতিরোধের পক্ষে। কারণ ইতিহাস কখনও চুপ থাকে না; ইতিহাস রক্তের দাগ জমিয়ে রাখে, বেদনার স্মারক গড়ে তোলে এবং একদিন সেই রক্তচক্ষু শক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। জার্মান দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮-৩১) বলেছিলেন, 'মিনার্ভার প্যাঁচা কেবল সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই তার ডানা ছড়িয়ে দেয়।' অর্থাৎ ঐতিহাসিক সত্যের উপলব্ধি মানুষ একটু দেরিতেই করে; কিন্তু একবার যখন করে, তখন তারা আর পিছু হটে না। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। এই ভণ্ডামির হিসাব-নিকাশ একদিন ইতিহাস চাইবেই। আর সেই হিসাবের প্রথম অঙ্ক লেখা হয় কলমে, প্রতিবাদে, আর সাধারণ মানুষের একটুখানি বিবেকবোধের জাগরণে।

 

 

 আশার কথা, সেটা যে শুরু হয়েছে তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। শেষ কথা হলো, শান্তির মুখোশ পরে যারা চারদিকে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দেয়, মানবতার নামে যারা নির্বিচারে রক্তপাত চালায়, সেই শক্তিধর পরাশক্তিদের মুখোশ যেন একে একে খুলে পড়ে। ইতিহাসকে উপহাস করে, বিবেককে অপমান করে যে শঠতা বিশ্বরাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে, তার প্রকৃত চেহারা যেন বিশ্ববাসীর সামনে নগ্ন হয়ে যায়। এখনই উৎকৃষ্ট সময়, যখন শান্তি আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহৃত শব্দগুলোকে শক্তিধরদের কূটনৈতিক ছলনার হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের ভাষায়।

 

 

 

 

যুদ্ধ আর আগ্রাসনের নেপথ্যে সাজানো প্রতীক ও প্রতিশ্রুতি আর নয়, দুর্বৃত্তের তথ্য-সন্ত্রাসের জালে আবদ্ধ মানবিকতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে তার প্রকৃত মর্যাদায়। সত্য বলার সাহস ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম তোলার অঙ্গীকার এবং নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিই একদিন গড়ে তুলবে সেই বিশ্ব, যেখানে যুদ্ধ নয়, মানবিকতাই হবে শেষ কথা। শাস্তির মুখোশ পরা যুদ্ধবাজদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হোক। ভুলুষ্ঠিত হোক তাদের ক্ষমতার দড়। সাধারণ বিবেকবান মানুষের প্রতিরোধে মানবতার মুখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক প্রতিদিন।
ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য
ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি
mahruf@ymail.com