কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি: বৈষম্য দলিলের ২৮ বছর পূর্তি

এ এইচ এম ফারুক [প্রকাশ : ইত্তেফাক, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫]

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি: বৈষম্য দলিলের ২৮ বছর পূর্তি

২ ডিসেম্বর ২০২৫। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (কথিত শন্তিচুক্তি) ২৮ তম বর্ষপূর্তির দিন। ৩ ডিসেম্বর থেকে চুক্তি ২৯তম বছর শুরু। চুক্তির মৌলিক কাঠামোতে যে সাংবিধানিক বৈষম্য, পাহাড়ের অর্ধেক জনগোষ্ঠির মতামততে প্রধান্য না দেয়া এবং জাতীয় স্বার্থের সংঘাত বিদ্যমান থাকায় এই চুক্তিটি বোদ্ধা মহলের কাছে ‘তথাকথিত শান্তিচুক্তি’ না হয়ে বরং একটি ‘বৈষম্য দলিল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অভিযোগ আছে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা উপধারা এবং চুক্তির মাধ্যমে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, ৩ পার্বত্য জেলার ৩ জেলা পরিষদ এবং শরনার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সসহ অন্যান্য কাঠামোর বিভিন্ন পর্যায়ে  বাংলাদেশের সংবিধানকে অশ্রদ্ধা ও লংঘন করা হয়েছে।

 

 


একতরফা চুক্তি ও সাংবিধানিক সংঘাতের পটভূমি

 


পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পটভূমি রচিত হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ১৯৭৩ সালে তার সশস্ত্র গেরিলা শাখা তথাকথিত শান্তিবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে খুন-অপহরণ, চাঁদাবাজি ও সা¤প্রদায়িক হামলার এক বীভৎসকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীতে থাকা চাকমা সদস্যরা সেসময়ের অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে শান্তিবাহিনীর যাত্রা শুরু করে। এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানের জন্য সরকার তরফে আশির দশক থেকেই একটি সমঝোতা চুক্তির চেষ্টা চলছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় সেই দীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। অভিযোগ আছে যে, শেখ হাসিনার নতুন সরকার একতরফাভাবে পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে এবং শুধুমাত্র উপজাতীয়দের সশস্ত্র অংশের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে চুক্তিতে উপনীত হয়। এই আকাঙ্ক্ষার তাড়াহুড়োয় চুক্তির মৌলিক কাঠামোতে যে সাংবিধানিক বৈষম্য ও জাতীয় স্বার্থের সংঘাত রয়ে যায়, তার ফলস্বরূপ এই চুক্তিটি বোদ্ধা মহলের কাছে ‘শান্তিচুক্তি’ না হয়ে বরং একটি ‘বৈষম্য দলিল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

 

 

 


সংবিধানের আলোকে পর্যালোচনা

 


চুক্তি-সৃষ্ট আইনগুলো বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে একটি ‘দ্বৈত কাঠামো’ তৈরি করেছে। এই আইনগুলো সরাসরি সংবিধানের তিনটি মৌলিক অনুচ্ছেদকে চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে। যেমন-

 


১. অনুচ্ছেদ ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা): এই আইনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে আইনি অধিকার ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে।

 


২. অনুচ্ছেদ ২৮ (ধর্ম, ইত্যাদি কারণে বৈষম্য নিষিদ্ধ): জাতিগোষ্ঠীর (উপজাতি) ভিত্তিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক পদে সংরক্ষণের মাধ্যমে অন্যদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়েছে।

 


৩. অনুচ্ছেদ ২৯ (সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা): চাকরিসহ স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদ ও অধিকাংশ সদস্যপদ একটি নির্দিষ্ট অংশের জন্য সংরক্ষিত করে সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা নষ্ট করা হয়েছে। এই আইনগুলোর ‘পদ সংরক্ষণ’ সংক্রান্ত ধারাগুলোই মূলত জনসংখ্যার (পার্বত্য বাঙালি) প্রায় অর্ধেক অংশ থাকা সত্তে¡ও তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করেছে।

 

 

ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের বিশ্লেষণ

 


পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন-১৯৯৮, দেশের এককেন্দ্রিক শাসন কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশের ‘একক রাষ্ট্রে দ্বৈত কাঠামো’ তৈরি করেছে। উপজাতীয়দের হাতে একক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছে। এই আইনই প্রমাণ করে কীভাবে এটি একটি ‘বৈষম্য দলিল’।

 

 


চেয়ারম্যানের পদের সংরক্ষণ: ধারা ৫ (২) অনুযায়ী, পরিষদের ‘চেয়ারম্যান উপজাতীয়গণের মধ্য হইতে নির্বাচিত হইবেন’। এই ধারাটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ ও ২৯ এর সরাসরি লঙ্ঘন ঘটিয়ে প্রায় ১০ লক্ষাধিক বাঙালি নাগরিকের এই সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে নির্বাচন করার মৌলিক অধিকার তথা সাংবিধানিক অধিকার স্থায়ীভাবে হরণ করেছে।

 

 

সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা: ধারা ৫ (১) অনুযায়ী, মোট ২৫ সদস্যের (পদাধিকার বলে ৩ জনসহ) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মধ্যে উপজাতীয়দের জন্য ১৮টি পদ এবং অ-উপজাতীয় তথা বাঙালি জনগোষ্ঠির জন্য জন্য মাত্র ৭টি পদ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। জনসংখ্যা প্রায় সমান হওয়া সত্তে¡ও, এই ধারাটি উপজাতীয়দের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে প্রান্তিক করেছে।

 

 

জাতীয় আইনের ওপর প্রভাব: আঞ্চলিক পরিষদকে আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন এবং জেলা পরিষদগুলোর ওপর সমন্বয় ও তত্ত¡াবধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতাটি ডিসি বা এসপি-এর মতো কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের ক্ষমতাকে খর্ব করে এবং দেশের এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি সমান্তরাল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে।

 

 

রাজনৈতিক অধিকার হরণ: তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের পর্যালোচনা

 


চুক্তির শর্তানুযায়ী পার্বত্য ৩ জেলায় স্বায়ত্ত¡শাসিত ৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। এর আইনসমূহ (১৯৯৮-সংশোধিত) স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সাংবিধানিক বৈষম্যকে আরও জোরালো করেছে। যেমন-

 


চেয়ারম্যানের পদের সংরক্ষণ: ধারা ৪ (৪) অনুযায়ী, তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত। আঞ্চলিক পরিষদের মতোই, এটি স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদে অ-উপজাতী তথা বাঙালি নাগরিকদের নির্বাচন করার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হরণ করেছে।
সদস্যদের সংরক্ষণ: ধারা ৪ (১) অনুযায়ী, পার্বত্য জেলা পরিষদের মোট ৩৪ সদস্যের মধ্যে উপজাতীয়দের জন্য ২টি নারীসহ মোট ২৪ টি পদ এবং অ-উপজাতী বাঙালিদের জন্য ১ টি নারীসহ মোট ১০টি পদ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এই ধারাটি জনসংখ্যার অনুপাত তথা সংবিধানের সমতার অধিকারকে উপেক্ষা করে পার্বত্য বাঙালিদের অধিকারকে উপেক্ষিত করা হয়েছে। 

 


নিয়োগে বৈষম্য: ধারা ৩২ (১) অনুযায়ী, জেলা পরিষদগুলোর অধীনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে পরিষদগুলো। সরকারি কর্মসংস্থানে বাঙালি নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৯) খর্ব করা হচ্ছে।

 

 

একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদও সংরক্ষিত!

 


শুনতে আশ্চার্যজনক মনে হলেও এই চুক্তির আলোকে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা পদটিও উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। যা সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘণ। 

 


অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের প্রতি চরম বৈষম্য

 


পার্বত্য চুক্তির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বৈষম্যমূলক দিক হলো- ‘ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স’। এর ভূমিকা ও গঠনতন্ত্রও অত্যন্ত বৈসম্য মূলক। এই টাস্কফোর্স গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সংঘাতকালীন সময়ে দেশান্তরিত হওয়া উপজাতীয় শরনার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া উদ্বাস্তুদের (সে অনুযায়ী উপজাতি এবং অ-উপজাতি বা বাঙালিদের) পুনর্বাসন করা। কিন্তু এই টাস্কফোর্সটির কার্যক্রম ও ক্ষমতাকাঠামোও এই চুক্তিকে একটি বৈষম্য দলিলের প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

 

 

হাইকোর্ট কর্তৃক আঞ্চলিক পরিষদকে অসাংবিধানিক ঘোষণা

 


২০১০ সালে হাইকোর্ট একটি রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছিল। এই রায়ের মূল বক্তব্য ছিল, আঞ্চলিক পরিষদের গঠন ও এর প্রদত্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানের “একক রাষ্ট্র” নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাইকোর্ট দুটি প্রধান কারণে এই রায় দিয়েছিল।  


একক রাষ্ট্রের নীতির লঙ্ঘন: আদালত বলেছিল যে আঞ্চলিক পরিষদকে যে ক্ষমতাগুলো দেওয়া হয়েছে তা বাংলাদেশের সংবিধানের একক রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে ক্ষুন্ন করে। পরিষদকে দেওয়া বিশেষ ক্ষমতাগুলো একটি একক রাষ্ট্রের মধ্যে কার্যত একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে, যা সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে মেলে না।

 


প্রশাসনিক ইউনিটের শর্ত পূরণ না হওয়া: আদালত আরও বলেছিল, যদি এই পরিষদকে স্থানীয় সরকার সংস্থা হিসেবে ধরা হয়, তবে এটি সংবিধানের ‘৫৯ অনুচ্ছেদ’ অনুযায়ী গঠিত হয়নি। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একটি স্থানীয় সরকার সংস্থা গঠনের জন্য সেই এলাকাকে একটি প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে করা হয়নি।

 

 

ভূমি কমিশন ও ‘আদিবাসী’ বিতর্ক: সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ

 


চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট অন্যান্য কাঠামোও এই বৈষম্যকে উস্কে দিয়েছে। পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ (সংশোধিত)-এর মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের তথাকথিত মনগড়া (যার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই) প্রথাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এই বিধান দেশের সাধারণ দেওয়ানি আইন এবং প্রচলিত ভূমি আইনের ওপর প্রথাকে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে, যা অ-উপজাতীয়দের আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৭) সীমিত করে।

 

 

সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা

 


পরিশেষে এটা বলা যায়- পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর পূর্তিতে এটি স্পষ্ট যে, এই তথাকথিত শান্তিচুক্তিটি শান্তি প্রতিষ্ঠার চেয়ে বরং সাংবিধানিক বৈষম্য ও সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। চুক্তি-সৃষ্ট আইনগুলোর মাধ্যমে দেশের এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে ‘দ্বৈত শাসন’ এবং ১০ লক্ষাধিক বাঙালি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সীমিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো জাতীয় ঐক্য এবং সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা।