কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

প্লাস্টিক দূষণ : এক সর্বনাশা বাস্তবতা

কর্নেল আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক আলম [সূত্র : ২৪ জুন ২০২৫

প্লাস্টিক দূষণ : এক সর্বনাশা বাস্তবতা

আধুনিক সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক। এর সহজলভ্যতা, স্থায়িত্ব এবং বহুমুখী ব্যবহার আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করেছে। প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেজিং, খেলনা, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মহাকাশযান পর্যন্ত এর ব্যবহার ছড়িয়ে আছে। তবে এ ‘সুবিধাজনক’ উপাদানটি আজ মানবজাতি ও পৃথিবীর জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এমন এক নীরব ঘাতক, যা আমাদের মাটি, জল, বায়ু, সর্বোপরি জীববৈচিত্র্যকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে। এ প্রবন্ধে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা, এর উৎস, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব এবং এ বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

 

এক নীরব ঘাতক

প্লাস্টিক দূষণ বলতে পরিবেশে প্লাস্টিকের সামগ্রী বা কণার উপস্থিতি বোঝায়, যা বন্যপ্রাণী, তাদের বাসস্থান বা মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকের প্রধান সমস্যা হলো এটি সহজে পচনশীল নয়। একটি প্লাস্টিকের বোতল সম্পূর্ণভাবে পচতে প্রায় ৪৫০ বছর লাগে, আর একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ পচতে সময় লাগে ১০ থেকে ১০০০ বছর। এ দীর্ঘস্থায়িত্বই প্লাস্টিককে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত করেছে।

 

 

প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, যেমন প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, স্ট্র, কফি কাপ ইত্যাদি। দুঃখজনকভাবে এর মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয় এবং প্রায় ১২ শতাংশ জ্বালিয়ে ফেলা হয়, যা বায়ুদূষণ ঘটায়। অবশিষ্ট বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিক হয় ভূমিতে ফেলা হয় অথবা সরাসরি পরিবেশে মিশে যায়, বিশেষ করে সমুদ্র ও নদীগুলোয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে প্রবেশ করে, যা ২০৪০ সাল নাগাদ ২৯ মিলিয়ন টনে পৌঁছাতে পারে। এ প্রবণতা উদ্বেগজনক, কারণ এটি বিশ্বজুড়ে সমুদ্রের ইকোসিস্টেমের অপূরণীয় ক্ষতি করছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

 

 

প্লাস্টিক দূষণের উৎস

প্লাস্টিক দূষণের উৎসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে। এর প্রধান উৎসগুলো হলো :

 

 

১. একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক : এটি প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস। খাবার মোড়ক, পানীয় জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট, শপিং ব্যাগ, স্ট্র, প্লাস্টিকের থালা-বাসন ইত্যাদি একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়, যা সরাসরি পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপক। এর সহজলভ্যতা ও স্বল্পমূল্য এর ব্যাপক ব্যবহারের প্রধান কারণ।

 

 

২. প্যাকেজিং শিল্প : পণ্যের প্যাকেজিংয়ে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। খাদ্যসামগ্রী, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদির মোড়কে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। অনেক সময় এ প্যাকেজিংগুলো অপ্রয়োজনীয় এবং একাধিক স্তরবিশিষ্ট হওয়ায় বর্জ্যরে পরিমাণ আরও বাড়ায়।

 

 

৩. মাইক্রোপ্লাস্টিক : প্লাস্টিকের বড় টুকরাগুলো সূর্যালোক, বাতাসের ঘষা এবং জলের স্রোতে ভেঙে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়, যাদের মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে। এ মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো পোশাক থেকে নির্গত সিন্থেটিক ফাইবার, প্রসাধনীতে ব্যবহৃত মাইক্রোবিড এবং টায়ার ক্ষয় থেকেও উৎপন্ন হয়। এরা মাটি, জল, এমনকি বায়ুমণ্ডলেও মিশে যায়, যা মানুষের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন মেরু অঞ্চলের বরফ এবং গভীর সমুদ্রেও পাওয়া যাচ্ছে, যা এর বৈশ্বিক বিস্তারের ভয়াবহতা প্রমাণ করে।

 

 

৪. শিল্প ও কৃষি খাত : শিল্পকারখানা থেকে নির্গত প্লাস্টিক বর্জ্য, যেমন, প্লাস্টিকের প্যালেট বা পণ্যের অবশিষ্টাংশ দূষণের কারণ হয়। কৃষিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক শিট, সেচ পাইপ এবং সার বা কীটনাশকের প্লাস্টিক কনটেইনারগুলোও দূষণে ভূমিকা রাখে। কৃষিতে ব্যবহৃত মালচিং শিট বা গ্রিনহাউজ কভারগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।

 

 

৫. মাছ ধরার সরঞ্জাম : সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়া মাছ ধরার জাল, দড়ি এবং অন্য প্লাস্টিকের সরঞ্জামগুলো সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এ সরঞ্জামগুলোয় আটকা পড়ে অনেক প্রাণী মারা যায় এবং বছরের পর বছর সমুদ্রের তলদেশে পড়ে থেকে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে।

 

 

৬. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব : অনেক দেশেই, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বর্জ্য সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হয় বা নদীনালার মাধ্যমে সমুদ্রে চলে যায়। বাংলাদেশের অনেক শহরেই অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিক যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকে, যা বর্ষাকালে ড্রেনেজ সিস্টেম বন্ধ করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।

 

 

৭. অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিত ব্যবহার : প্লাস্টিকের ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জনসাধারণের অসচেতনতা একটি বড় কারণ। যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলা, নদী বা জলাশয়ে প্লাস্টিক ছুড়ে দেওয়া এবং প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞতাও এ দূষণ বাড়িয়ে তুলছে।

 

 

পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

 

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব কেবল দৃশ্যমান আবর্জনার স্তূপে সীমাবদ্ধ নয়, এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ পরিণতি।

 

১. সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব : সমুদ্র হলো প্লাস্টিক বর্জ্যরে সবচেয়ে বড় ডাম্পিং গ্রাউন্ড। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং মাছ ধরার সরঞ্জাম সামুদ্রিক প্রাণী যেমন-কচ্ছপ, তিমি এবং বিভিন্ন পাখির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তারা প্লাস্টিককে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে বা তাতে জড়িয়ে পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। সামুদ্রিক পাখি ও মাছের পরিপাকতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমা হয়, যা তাদের স্বাস্থ্য ও প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এর ফলে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে এ প্লাস্টিক মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। প্লাস্টিকের কারণে প্রবাল প্রাচীরগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

২. ভূমি ও মাটির দূষণ : প্লাস্টিক মাটিতে পচে না গিয়ে দীর্ঘকাল ধরে পড়ে থাকে, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। এটি মাটির জল ধারণক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং মাটির নিচে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করে। কৃষিজমিতে প্লাস্টিকের কণা মিশে যাওয়ায় ফসলের উৎপাদন কমে যায় এবং উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করে। মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ায় কৃষি উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলছে।

 

 

৩. বায়ুদূষণ : প্লাস্টিক যখন পোড়ানো হয়, তখন এটি বিষাক্ত ডাইঅক্সিন, ফিউরান এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ বায়ুমণ্ডলে নির্গত করে। এগুলো বায়ুদূষণ ঘটায় এবং মানুষের শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ক্যানসার এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির কারণ হতে পারে। উন্মুক্ত স্থানে প্লাস্টিক পোড়ানো হয়, যা স্থানীয় বায়ুর মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

 

 

৪. পানিদূষণ : প্লাস্টিকের কণাগুলো নদী, হ্রদ এবং ভূগর্ভস্থ জলে মিশে পানির গুণগত মানকে হ্রাস করে। প্লাস্টিক থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ জলের বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পানীয় জলের উৎসকে দূষিত করে। এটি মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর দেহে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা তাদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।

 

 

৫. মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব : মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক এখন মানুষের রক্ত, ফুসফুস, এমনকি প্লাসেন্টাতেও (গর্ভফুলের মাধ্যমে মায়ের দেহ থেকে ভ্রূণে খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহ হয়) পাওয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিকে থাকা রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বিসফেনল এ (BPA) এবং থ্যালেটস হরমোনজনিত সমস্যা, প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যদিও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে এটি স্পষ্ট, প্লাস্টিক দূষণ মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি সম্ভাব্য গুরুতর হুমকি। শিশুদের ওপর এর প্রভাব বিশেষ উদ্বেগের কারণ।

 

 

৬. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : প্লাস্টিকের উৎপাদন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল এবং এর উৎপাদন প্রক্রিয়া বিপুল পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার কমানো অপরিহার্য।

 

 

প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় করণীয়

 

 

প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা মোকাবিলা করা এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকার, শিল্প, ভোক্তা এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা।

 

 

১. নীতি ও আইনগত পদক্ষেপ

 

 

প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ : একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। অনেক দেশেই প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন প্রণয়ন করে তার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শুধু কাগজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না থাকে।

 

 

পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করা : প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারের জন্য শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করা। রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের সংখ্যা বাড়ানো এবং বর্জ্য পৃথক্করণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

 

উৎপাদকদের দায়িত্বশীলতা : পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে তাদের উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা। এটি তাদের পণ্য ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করবে।

 

গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ : পরিবেশবান্ধব এবং পচনশীল বিকল্প প্লাস্টিক উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতকে এ খাতে অর্থায়ন করতে হবে।

 

 

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা : প্লাস্টিক দূষণ একটি আন্তঃসীমান্ত সমস্যা। এর সমাধানে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সহযোগিতা প্রয়োজন। বৈশ্বিক পর্যায়ে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর কাঠামো তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

 

 

২. শিল্প ও ব্যবসার ভূমিকা

 

 

নকশা পরিবর্তন : প্লাস্টিক পণ্যের নকশা এমনভাবে পরিবর্তন করা, যাতে সেগুলো সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। ‘বৃত্তাকার অর্থনীতি’ (Circular Economy) মডেলের দিকে যেতে হবে, যেখানে বর্জ্যকে আবারও উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

 

বিকল্প উপকরণের ব্যবহার : প্যাকেজিং এবং পণ্য উৎপাদনে প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাগজ, বাঁশ, কাচ, ধাতুর মতো পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহার করা। এ বিকল্পগুলো সহজলভ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী করার জন্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ প্রয়োজন।

 

 

পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের উৎপাদন : পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করা। এটি পুনর্ব্যবহার শিল্পের বাজার তৈরি করবে।

 

টেকসই সরবরাহ শৃঙ্খল : উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলকে পরিবেশবান্ধব করা। সাপ্লাই চেইনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা।

 

 

৩. ভোক্তা ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব : ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব; যেমন-3R নীতি অনুসরণ : Reduce : প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো। Reuse : একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে বারবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার করা। Recycle : যে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, তা সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা। বর্জ্যকে পৃথক করে ফেলা, যাতে পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া সহজ হয়।

 

 

সচেতনতা বৃদ্ধি : প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে নিজেরা সচেতন হওয়া এবং অন্যদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে এ বিষয়ে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।

 

স্থানীয় উদ্যোগ সমর্থন : স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি এবং প্লাস্টিক দূষণবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নেওয়া। সমুদ্র বা নদীর পাড় পরিষ্কার অভিযানে যোগ দেওয়া।

 

স্মার্ট কেনাকাটা : প্লাস্টিক প্যাকেজিংবিহীন পণ্য কেনা। বাজার করার সময় নিজের ব্যাগ নিয়ে যাওয়া।

 

 

মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কে সচেতনতা : মাইক্রোবিডযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার এড়িয়ে চলা। সিন্থেটিক পোশাকের বদলে প্রাকৃতিক ফাইবারযুক্ত পোশাক পরা, কারণ সিন্থেটিক পোশাক ধোঁয়ার সময় মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্গত করে।

 

৪. শিক্ষা ও গবেষণা

 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা : স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্লাস্টিক দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে পরিবেশগত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া।

 

গবেষণা ও উদ্ভাবন : পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকের বিকল্প, প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের নতুন প্রযুক্তি এবং প্লাস্টিক দূষণ শনাক্তকরণ ও পরিমাপের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা। এ গবেষণাগুলো সরকারকে নীতিনির্ধারণে এবং শিল্পকে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করবে।

 

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা

 

বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের মারাত্মক শিকার। অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদীপথে প্লাস্টিক বর্জ্যরে আগমন এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী অবস্থান এর অন্যতম কারণ। সরকার প্লাস্টিক ব্যাগের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্যরে স্তূপ নিত্যদিনের দৃশ্য। এ সমস্যা মোকাবিলায় এ পদক্ষেপগুলো জরুরি : কঠোরভাবে প্লাস্টিক আইন প্রয়োগ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বিকল্প প্রচলন। আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে এবং প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বর্জ্য সংগ্রহ এবং পৃথকীকরণের জন্য আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পুনর্ব্যবহার শিল্পের বিকাশ ও বিনিয়োগ আকর্ষণ। দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের পুনর্ব্যবহার প্ল্যান্ট স্থাপনে উৎসাহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা প্রদান করতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা অভিযান চালাতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও উপকূলীয় এলাকায়। গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এ বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। নদী ও সমুদ্র থেকে প্লাস্টিক অপসারণের জন্য নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি বা অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের মতো উদ্ভাবনী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

 

 

উপসংহার

প্লাস্টিক দূষণ মানবজাতির সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এর ভয়াবহতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় কোনো সহজ সমাধান নেই; কারণ, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে জড়িত। তবে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে আমাদের সম্মিলিতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে কঠোর নীতি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে, শিল্প খাতকে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতির দিকে ঝুঁকতে হবে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভোক্তাদেরকে তাদের ব্যবহার পরিবর্তন করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, পুনর্ব্যবহার করা এবং দায়িত্বশীলভাবে বর্জ্য অপসারণ করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ও দূষণমুক্ত পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের নৈতিক কর্তব্য। আমরা যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করি, তাহলে এক্ষেত্রে জয়ী হওয়া অসম্ভব নয়। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।


কর্নেল আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক আলম : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত