পোশাক রফতানিতে কেমন ছিল ২০২৪ এবং নতুন বছরের প্রত্যাশা
মো. মহিউদ্দিন রুবেল । সূত্র : বণিক বার্তা, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ২০২৩ শেষে নতুন বছরের শুরুতে আমাদের পোশাক রফতানি আয় দাঁড়িয়েছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার, যা রফতানিতে আমাদের অব্যাহত অগ্রযাত্রার কথাই বলছিল। এর ধারাবাহিকতায় স্বভাবতই আমরা ২০২৪-এর রফতানি নিয়েও আশাবাদী ছিলাম এবং রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। তবে রফতানি ডাটাগুলোর অসংগতিগুলো আমাদের গণনা এবং অনুমানগুলোয় যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছে। যখন আমরা সংশোধিত পরিসংখ্যান পেলাম, তখন আমরা দেখতে পাই যে ২০২৪ সাল শেষে আমাদের পোশাক রফতানি কমে ৩৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যদিও এই ফিগারটি ২০২৩ সালের সংশোধিত ফিগারের তুলনায় ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০২৩ শেষ হওয়ার আগেই আমরা অনিশ্চয়তায়পূর্ণ বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ন্যূনতম মজুরি বিক্ষোভ এবং কারখানা বন্ধের মতো চ্যালেঞ্জগুলো ব্যাপক আকারে ঘনীভূত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা নিম্নতম মজুরি ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। যদিও নিম্নতম মজুরি বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত শিল্পের জন্য কঠিন ছিল, তার পরও এটি শিল্পের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল। আমরা আশা করেছিলাম যে এটি কাজের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাবে এবং ক্রেতাদের সহযোগিতায় উৎপাদনশীলতা বাড়বে, মূল্য সংযোজনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে, সর্বোপরি শিল্পে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকবে।
নতুন বছরটি (২০২৪ সাল) শুরুই হয়েছিল আমাদের নিজস্ব চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে, যেহেতু দ্বাদশতম জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমাদের নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। এ পরিস্থিতি আমাদের বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধির গতিপথকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে, যার ফলে জানুয়ারিতে শিল্পে মাত্র ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ হারে মাঝারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসটি শিল্পের জন্য বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং ছিল, কারণ তার এক মাস আগেই বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর রফতানি প্রণোদনা এক ধাপে ৬০ শতাংশ কমিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। পর্যাপ্ত আলোচনা বা প্রস্তুতি ছাড়াই আকস্মিকভাবে নেয়া এ সিদ্ধান্ত আমাদের এরই মধ্যে সংগ্রামরত শিল্পকে আরো গভীরতম সংকটে নিমজ্জিত করেছে।
সর্বোপরি ২০২৪ সালজুড়ে এসব অভ্যন্তরীণ বিষয়ের বাইরে আরো ছিল বিশ্বব্যাপী বিবাদমান দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে মূল্যের ঘন ঘন ওঠানামা, যা ক্রেতা এবং ভোক্তাদের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে। তবে বছরের শেষের দিকে এসে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, যা কিনা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ফ্যাশনসামগ্রী ক্রয়ের জন্য ক্রেতাদের চাহিদা ও সামর্থ্যকে প্রভাবিত করেছিল, তা কমতে শুরু করে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা, আঙ্কটাড ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে ৫ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস দিয়েছে। এর মানে হলো সারা বছর আমাদের পোশাকের ইউনিট মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাবে, যদিও স্বাভাবিকভাবেই শিল্পের প্রত্যাশা আছে যে নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।
মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে মূল্যবৃদ্ধি, সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকের সুদহার প্রভৃতি কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য লোকসানের সম্মুখীন হয়ে অনেক ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ২০২৪ সালজুড়ে শিল্প-কারখানা বন্ধের ঘটনা ঘটেছে।
এ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে জুলাই বিপ্লব আমাদের জাতির জন্য বিশেষভাবে আশাজাগানিয়া ছিল। যদিও শিল্প ও অর্থনীতিকে এর জন্য বড় মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া অস্থিরতা, তার সঙ্গে দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনা যুক্ত হয়ে শীত ও ক্রিসমাসকে সামনে রেখে আমাদের মার্কেটিং কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
এসবের রেশ ধরে সাপ্লাই চেইন এবং উৎপাদন সময়সূচি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়, এমনকি অনেকগুলো কনফার্মড অর্ডারও অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত হয়। ফলে জুলাই ২০২৩-এর তুলনায় জুলাই ২০২৪ সময়ে রফতানি মাত্র ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। উল্লেখ্য জুলাই ২০২২-এর তুলনায় জুলাই ২০২৩-এর রফতানি ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। ২০২৪-এর আগস্টে রফতানি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, ২০২৩-এর আগস্টের তুলনায় রফতানি ৭ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে, তার পরও ২০২২ সালের একই মাসের (আগস্ট) তুলনায় ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ কমেছে।
সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শ্রম অসন্তোষ, কারখানা বন্ধ, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ব্যাংকিং সংকটসহ অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হয়েছি। যদিও এ মাসগুলোয় রফতানিতে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো সাপ্লাই চেইনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে, শিল্পের সুনামকে কলঙ্কিত করেছে এবং ক্রেতার আস্থা নষ্ট করেছে। তবুও আমরা উৎপাদন এবং রফতানি পণ্য জাহাজীকরণের সময়সূচি স্বাভাবিক করার জন্য আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সৌভাগ্যক্রমে আমরা এ মাসগুলোয় রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখেছি, বিশেষ করে ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পোশাক আমদানিতে একটি অসাধারণ ঘুরে দাঁড়ানো দেখতে পেয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত, যা অক্টোবরে ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
২০২৪-এর জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের পোশাক রফতানি ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে, তথাপি এটি (২০২২-এর অ্যাডজাস্টেড পরিসংখ্যান বিবেচনা করে) এখনো ২০২২-এর তুলনায় ৬ শতাংশ কম রয়ে গেছে। যদিও এটি সন্তোষজনক বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধির কথা বলছে, তার পরও শিল্পের সক্ষমতা বিবেচনায় নিলে এটি যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য নয়। এসব পরম্পরার মধ্য দিয়েই ২০২৪ সালটি শিল্পের জন্য সংকট ও চ্যালেঞ্জের একটি বছর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে আমি আশাবাদী যে ২০২৫ সাল বিশ্বব্যাপী পোশাক বাণিজ্যের জন্য একটি পুনরুত্থানের সূচনা করবে এবং আমাদের রফতানি পরফরম্যান্সের উন্নতি ঘটাবে।
গর্বের বিষয় হলো ২০২৪ সালজুড়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সফলভাবে শিল্প সাসটেইনেবিলিটি বাস্তবায়নে তার প্রতিশ্রুতি বজায় রেখেছে। ২০২৩ সালে প্রায় ২৪টি পোশাক কারখানা ইউএসজিবিসি কর্তৃক লিড সনদ পেয়েছে। ২০২৪ সালে নতুন করে ২৬টি কারখানা লিড সনদ পায়। ২৬টি লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার মধ্যে ১৬টি প্লাটিনাম রেটেড এবং ১০টি গোল্ড রেটেড। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে এখন ২৩৩টি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে, যা টেকসই প্রবৃদ্ধির প্রতি শিল্পের পরম নিষ্ঠা প্রদর্শন করে।
আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের এ শিল্পের গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, যেহেতু আমরা পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও বাজার বহুমুখীকরণের দিকে ঝুঁকছি, নতুন বাজার অন্বেষণ করছি। পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা অ্যাক্টিভওয়্যার এবং নন-কটন পণ্য খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করে চলেছেন। তবে টেকসই জ্বালানির জন্য চলমান সংকট নতুন বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে, একই সঙ্গে যারা এরই মধ্যে বিনিয়োগ করেছেন তারাও সংগ্রাম করে চলেছেন।
আমরা স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি, মাঝখানে আর মাত্র দুটি বছর বাকি। এ সময়ে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে এসেছে, তা হলো এ পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য আমরা নিজেরা কতটা ভালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি? পুরো ২০২৪ জুড়ে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ ব্যবসা ও বিনিয়োগে কাঙ্ক্ষিত গতি অর্জনে আমাদের সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এ মুহূর্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হব সেগুলো মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং নিজেদের প্রস্তুতিতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যদি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সময়সূচি নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়, আমাদের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হতে পারে।
আমি মনে করি, ২০২৫ সাল বিশ্ব অর্থনীতি এবং পোশাক ব্যবসার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর হবে। সেই সঙ্গে একান্তভাবে আশা করি, জাতি চলমান সংকট, বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জগুলোও কাটিয়ে উঠবে। আস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য শিল্প সম্পর্কের টেকসই উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার অপরিহার্য। আমি সত্যিকারভাবেই বিশ্বাস করি, ২০২৫ সালে এ উন্নয়নগুলো আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করব।
মো. মহিউদ্দিন রুবেল: বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক