কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত ছিল দেশ

কাওসার রহমান । সূত্র : জনকণ্ঠ, ৯ জানুয়ারি ২০২৫

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত ছিল দেশ

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব দেখা গেছে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। বলা যায় পুরো বছরটাই পার হয়েছে এক প্রকার বৈরী আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে। বছরটা শুরু হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। এর পর দেশের ইতিহাসে উষ্ণতা আর বন্যার রেকর্ডের সঙ্গে ছিল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও। এসব দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ।

 

বৈরী আবহাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দেশের কৃষি অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতির। ব্যাহত হয়েছে শিক্ষার পাঠদান কর্মকাণ্ড। রেড অ্যালার্ট জারি করে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেইসঙ্গে তীব্র তাপপ্রবাহে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যগত সংকটও তৈরি হয়। ফলে দাবি ওঠে তীব্র তাপপ্রবাহকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার।

 

এপ্রিলে রেকর্ড তাপপ্রবাহ
২০২৪-এর জানুয়ারিতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। তাপমাত্রা এত নিচে নামলেও শীত খুব স্থায়ী হয়নি। মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে যায় গ্রীষ্ম মৌসুম। তাপ বাড়তে বাড়তে ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহ। মাসের শেষ দিকে কিছুটা কমলেও এপ্রিলের প্রথম থেকে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় দফা তাপপ্রবাহ। পুরো এপ্রিলজুড়ে টানা তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে দেশ।

 

এর আগে দেশের ইতিহাসে সর্বশেষ ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে এত লম্বা সময় ধরে তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। গত বছরের গ্রীষ্মের টানা তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। টানা ৩৭ দিন পর দূর হয় তাপপ্রবাহ। ৩১ মার্চ তাপপ্রবাহ শুরু হয়, আর শেষ হয় ৭ মে। মৃদু থেকে অতি তীব্র এই তাপপ্রবাহ প্রায় সারাদেশেই বিস্তৃত ছিল। এ সময় জনজীবনের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। তীব্র গরমে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

 


আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক তখন জানিয়েছিলেন, ‘এর আগে ২০১৯ সালে চুয়াডাঙ্গায় টানা ২৩ তিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল। এরপর গত বছরই সর্বোচ্চ ব্যাপ্তিকালের তাপপ্রবাহ চলেছে। আলাদা করে এপ্রিল মাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ সচরাচর হয় না।’ একই কথা জানিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি বলেছিলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে টানা এত ব্যাপ্তিকালের তাপপ্রবাহের রেকর্ড নেই।’ 

 

আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩১ মার্চ রাজশাহী ও পাবনায় মৃদু তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় রাঙ্গামাটিতে। ১৬ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তীব্র তাপপ্রবাহ। ওইদিন চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়। এরপর সারাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। কালবৈশাখীরও দেখা মেলে না। সর্বশেষ ঢাকায় বৃষ্টি হয় ১৭ এপ্রিল।

 

 সারাদেশের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০ এপ্রিল বিভিন্ন জায়গায় দিনের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে অর্থাৎ তাপপ্রবাহ অতি তীব্র আকার ধারণ করে। ওইদিন ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়। মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ প্রায় সারাদেশে বিস্তৃত হয়। দেশের আবহাওয়ায় বিরাজ করে মরুভূমির তাপ। বৃষ্টির বাতাস সরে যায় চীনের দিকে।

 

২৯ এপ্রিল ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়, যেটি ছিল সেই মৌসুমে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এছাড়া ৩০ এপ্রিল যশোরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে, যা ছিল ১৯৮৯ সালের পর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠা-নামা করে ৪২ থেকে প্রায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। গরমের তীব্রতায় তৈরি হয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি। তিন তিনটি হিট অ্যালার্টও জারি করে আবহাওয়া অফিস। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয় ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত।

 

জনজীবন অতিষ্ঠ করে দেওয়া রেকর্ড তাপপ্রবাহে জীবন ও সম্পদের বড় ক্ষতি হয়, নিভে যায় ৯৫টি প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়ে কৃষি, নেমে যায় পানির স্তর। বেঁকে যায় রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়ে সড়ক। ৪ মের পর এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ফের বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা, যা দফায় দফায় স্থায়ী ছিল জুলাই পর্যন্ত। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের জেরে আগস্টে গরমের কষ্ট কিছুটা কমে। তবে সেপ্টেম্বরের প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহেও দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ প্রবাহিত হয়।

 


এপ্রিলে দেশব্যাপী বয়ে চলা তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত ছিল রাজধানী ঢাকার জনজীবনও। এর কারণ ছিল ঢাকার তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া। দেখা গেছে গত ৭ বছরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা ছিল মহাখালী এবং গুলিস্তান এলাকার। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

 

২০১৭ সালে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অন্যদিকে এই সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তাপমাত্রা বাড়ে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৩৯ ডিগ্রি। ২০২৪ সালে সেটি এসে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।