প্রাতিষ্ঠানিক মান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন
আব্দুল বায়েস । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

দেশে বর্তমানে বহুল আলোচিত শব্দ ‘সংস্কার’। বিশেষত আশির দশক থেকে এবং বিভিন্ন আমলে শব্দটি বাতাসে ভাসলেও বাস্তবে রূপ পায়নি। অভিযোগ আছে যে, বিগত সরকারের ১৫ বছরে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয় চরমে উঠেছিল। মোট কথা, সবগুলো প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে হয়েছিল অন্তঃসারশূন্য ঠুঁটো জগন্নাথ।
প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হলে যে সরকারও ধ্বংস হয়, আজ বা কাল, তার প্রমাণ বাংলাদেশসহ বহু দেশে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার পর ‘সংস্কার’ শব্দটি নতুন করে নানাভাবে ডানা মেলতে থাকে। কম কথা নয়, সরকার ইতিমধ্যে বেশ কটি কমিশন গঠন করে প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করছেন। আমরা সরকারের সংস্কারমূলক পদক্ষেপের প্রশংসা করি। তবে মনে রাখতে হবে, এটা চলমান প্রক্রিয়া , রাজনৈতিক সংস্কার সবার ওপরে এবং সব সরকারকেই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন না করলে একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
দুই. মেক্সিকো থেকে আমেরিকার আরিজোনা রাজ্যকে আলাদা করার জন্য মাঝখানে একটা দেয়াল দেওয়া আছে; যেমন ছিল পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনকে আলাদা করার জন্য ‘বার্লিন ওয়াল’। মেক্সিকো-মার্কিন সেই দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকালে চোখে পড়ে আরিজোনা রাজ্যের নোগালেস শহর। উন্নত দেশের উন্নত শহর। এখানে অধিকাংশ লোকের আর্থসামাজিক অবস্থান আন্তর্জাতিক মাপে বেশ উঁচুতে। সব দিক থেকেই তারা ভালো আছে, ভালো থাকবে। উন্নতির উপসর্গ হিসেবে কিছু উপাদান উল্লেখ করা যায়। যেমন- সেখানকার মানুষ বেশিদিন বাঁচে, অধিকাংশ ছেলেমেয়ে অনেকদূর পর্যন্ত পড়ালেখা করে, অর্জিত সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিকদের ভাবতে হয় না, কোথাও বিনিয়োগ করলে মার খাওয়ার চান্স নেই, নেতা পছন্দ না হলে নির্দিষ্ট সময়ের পর নিজেদের পছন্দের লোককে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাতে পারে।
আইনের শাসনের কঠোর বাস্তবায়নে মাস্তানি, গুণ্ডামি, জবরদখল, গুম, খুন, রাজনৈতিক হয়রানি অনেকটাই সেখানে নিষিদ্ধ। অপর দিকে, দেয়ালের ওপরে উঠে দক্ষিণে তাকালে দেখা মেলে মেক্সিকোর শহর সিনোরা। যদিও এটা মেক্সিকোর অপেক্ষাকৃত ধনী একটা এলাকা, যেমন বাংলাদেশের ঢাকা, কিন্তু দেয়ালের উত্তর দিকের চেয়ে এদিকটার মানুষ বেশ গরিব।
শুধু যে গরিব তা নয়, ধনী হওয়ার পথেও ব্যাপক আকারে বিপত্তি প্রতি পদে সংঘবদ্ধ ছিনতাই ও সন্ত্রাস নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার; ব্যবসা-বাণিজ্য করা প্রায় অসম্ভব; দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের শেকড় অনেক গভীরে, আইনের শাসনের অভাব ইত্যাদি। যদিও গত ২০ বছর ধরে মেক্সিকোতে গণতন্ত্র আছে, যেমন অভিযোগ বাংলাদেশের ১৫ বছর নিয়ে, কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বেলায় সকলই গড়ল ভেল! ঢাকার গুলশানের মতোই খুব ধনীদের পাশে খুব গরিবের বাস ঐ শহরে।
তিন. স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে একই এলাকার দুটো শহর এমন আলাদা কেন? যাদের ভূমি এক, আবহাওয়া-জলবায়ু এক, অধিকাংশ মানুষের পূর্বপুরুষেরাও তো এক, সাংস্কৃতিকভাবেও তাদের মধ্যে নানা ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, দুই দেশের লোকজন প্রায় একই ধরনের খাবার খায়, ওরা যেসব গান শুনে; তাও মোটামুটি কাছাকাছি। তাহলে জীবন-যাপনে এত তফাৎ কেন? কেন একটা দেশ এতটা ধনী আর অন্য আরেকটা দেশ এতটা দরিদ্র হয় কীভাবে? সমস্যাটা আসলে কী? এই সমস্যা নিয়ে কাজ করেই এ বছর আমেরিকার তিনজন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন।
তারা হলেন, ডেরন আসেমগলু, সায়মন জনসন এবং জেমস রবিনসন। তাদের গবেষণায় দেখা গেল, বিশ্বের ২০ শতাংশ ধনী দেশ দরিদ্র ২০শতাংশ দেশের চেয়ে অন্তত ৩০ গুণ বেশি ধনী। মজার ব্যাপার হলো, ধনী ও দরিদ্র দেশের আয়-বৈষম্য বহুদিন ধরেই স্থির হয়ে আছে। অর্থাৎ, দরিদ্র দেশগুলো যদিও ধীরে ধীরে আগাচ্ছে, কিন্তু ততদিনে ধনী দেশগুলো আরও ধনী হয়ে যাচ্ছে। ফলে আয়-বৈষম্য আর কমছে না। দরিদ্র দেশগুলো ধনী দেশকে কোনোভাবেই ছুঁতে পারছে না। কিন্তু এই আয়-বৈষম্য কেন ঘটে? এর কোনো প্রতিকার নেই?
এই তিন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, দুটো জায়গায় পার্থক্যের কারণ ভৌগোলিক অবস্থান বা সংস্কৃতি নয়। ধর্ম তো আলোচনাতেই নেই। বরং মূল সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠানের গুণাগুণ- স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, ব্যাংক, বাজারব্যবস্থা, মিডিয়া, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সিভিল সোসাইটি ইত্যাদি। দেয়ালের উত্তর পাশে আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মান এতটাই উঁচুতে যে, সেগুলো তার নাগরিকের শিক্ষা ও পেশা নির্বাচন করতে যথাযথ সুরক্ষা দিতে পারে, যে সুরক্ষা দক্ষিণের মেক্সিকোর সরকারি প্রতিষ্ঠান তার নাগরিকদের দিতে পারে না।
এই তিন অর্থনীতিবিদ এমন এক সময়ে, এমন এক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেলেন, যখন বাংলাদেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের সামনে যখন তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ দুয়ারে উপস্থিত। এন্তার অভিযোগ আছে যে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা হলো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো প্রবলভাবে প্রলম্বিত হচ্ছে।
চার. বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থা জানান দেয়, দেশে বর্তমানে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার, এস আলমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এখন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮টি কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা (লাইফ সাপোর্ট) হয়েছে। এই ১৮টির মধ্যে ৯টিই মুমূর্ষু। বাকি ৯টি অতিরুগ্ণ, কোনোমতে টিকে আছে। এ ছাড়া রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাব করলে দেশের মোট ২৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই খারাপ। কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দুর্নীতি সম্পর্কিত ওপরের ভয়াবহ চিত্রটি হিমশৈলের উপরিভাগ মাত্র। তবে বাংলাদেশে ডুবতে যাওয়া ব্যাংক খাতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে টাস্কফোর্স গঠন, কমপক্ষে এক ডজন ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, দখলদারদের হাত থেকে ব্যাংক উদ্ধার এবং কাগুজে নোট ছেপে ব্যাংকের তারল্য সংকট না কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে করছেন তারা। টক অব দি কান্ট্রি এই যে, বাংলাদেশের দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে উপস্থিত সব জায়গায়।
এমনকি সব খাত, নগর-বন্দর এবং সদর-অন্দরে। অভিযোগ আছে, দুর্নীতিবাজদের দাপটে কাঁপছে দেশ কেউ বা ছিলেছুলে বাকলা রেখে দিয়ে সুদূর কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়ায় পাড়ি দিয়েছে। কেউ মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়িতে, কেউ বা ভেতরে থাকছে ‘ম্যানেজ’ করে। এই ম্যানেজ করার ব্যাপার একটা ম্যাজিক এই ভুবনে ফেলো কড়ি মাখো তেল যা সবার দক্ষতায় ধরা দেয় না। যাই হোক রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সমাজনীতির নিয়ন্ত্রক দুর্নীতিবাজ।
পাঁচ. এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? কোনো সরকার এমনি এমনি ফ্যাসিবাদী হয় না; ফ্যাসিবাদী তাকে করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার এখানেও কথা আছে। প্রতিষ্ঠান যাতে ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম সমর্থন করে সে জন্য, অনেক ক্ষেত্রে, সরকার সংসদে তার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে এমন আইনকানুন পাস করিয়ে নেয়, যা তার একনায়কসুলভ আচরণের পক্ষে সায় দেয় (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রহিতকরণ, এমনকি পর পর দুটো নির্বাচনেও না-অবস্থান)। কয়েকশ বছর আগে উন্নয়নের জন্য কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশাসনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছিলেন অ্যাডাম স্মিথ ও জন এস মিল।
নব্বই দশকে ডগলাস নর্থ বললেন, তৃতীয় বিশ্বে ঐতিহাসিক স্থবিরতা এবং সমসাময়িক অনুন্নয়নের জন্য দায়ী কম খরচে চুক্তির কার্যকরীকরণে ব্যর্থতা। অন্যদিকে, ৪০টি অ-শিল্পায়িত দেশের একশ বছরের তথ্য নিয়ে এক গবেষক উপসংহার টানলেন এ রকম প্রবৃদ্ধিকে সজোরে সামনে ঠেলে দেয় যে দুই উপাদান, তার একটি হলো রাজনৈতিক সংগঠন এবং অপরটি সরকারি প্রশাসন। বলাবাহুল্য, পরবর্তী সময়ে ডগলাস নর্থের পথ অনুসরণ করে অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা উন্নয়নের জন্য সুশাসনের গুরুত্ব একনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে থাকেন। আরও একটা কথা, প্রারম্ভিক পর্যবেক্ষণে দুর্নীতিকে অর্থনীতির চাকার গ্রিজ হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু ইদানীং সে ধারণা প্রায় অস্তমিত বরং কম দুর্নীতির বিনিময়ে বেশি আয় তত্ত্ব প্রাধান্য পেতে থাকে।
ছয়. অর্থনীতিবিদ মিনহাজ মাহমুদ ও ইয়াসুকি সাওয়াদার মতে, বাংলাদেশের শাসনের সব চিহ্নই যখন দুর্বল এবং সময়ের আবর্তনে ক্ষেত্রবিশেষ অবনতি ঘটেছে তখন দেশটি অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যক্ষ করে। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি ধারণা সূচক’-এর মতে, ইদানীং বাংলাদেশের স্কোর এমনভাবে উন্নীত হয়নি যে, কম দুর্নীতি ও বেশি প্রবৃদ্ধির মধ্যকার ইতিবাচক সম্পর্ক পাওয়া যাবে। যখন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের ধারণা বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা ‘হতবুদ্ধিকর’, তখন একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে তা হলে (ক) এমন ক্ষেত্র কি আছে যেখানে শাসন বড় কোনো সমস্যা নয়; (খ) বা শাসনের সূচক একপেশে বিধায় বাস্তব অবস্থা প্রতিফলিত হয় না; (গ) অথবা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি জ্বালানি পেয়েছে এমন উপাদান ও নীতিমালা থেকে যেগুলো অপশাসন-প্রবণ ছিল না।
একটা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক গুণ-মান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা দান করে এবং তা ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ধরে রাখার রক্ষাকবচ হিসেবে থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বা তাদের কৃতিত্ব এদের ওপর জনগণের আস্থার নিয়ামক হয়ে ওঠে যা আবার একটা সমাজে সাধারণ আস্থাকে প্রভাবিত করে। ফলে বিনিময় খরচ হ্রাস পায়, অর্থনীতির উপকার হয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, যেহেতু মানুষের মধ্যে আস্থা সহযোগিতা সৃষ্টে অবদান রাখে, তাই এটা প্রবৃদ্ধির জন্য উপকারী।
সাত. সুতরাং, লেট অল রোডস টু রিফরমস সংস্কার কাজে মন দেওয়া দরকার। ঘুণে ধরা প্রতিষ্ঠানের প্রতিকল্প প্রতিস্থাপন কিংবা মোটামুটি চলে এমন প্রতিষ্ঠানের খোলনলচে বদলে দিন বদল করা দরকার। অন্তত বিচারিক, ব্যাংকব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার চা-ই চাই। তবে সব এক সঙ্গে এবং একই সরকারকে করতে হবে এমন কথা নেই।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়