প্রফেসর ইউনূস : অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা
মো. মাহবুবুর রহমান বুলবুল [সূত্র : যুগান্তর, ১৭ জুন ২০২৫]

অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে তুলে ধরেছেন। এটি আমাদের জন্য গর্বের ও অহংকারের বিষয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রচলিত ব্যাংকিংব্যবস্থাকে ভেঙে একটি বিকল্প ধারার ব্যাংকিংব্যবস্থা ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ কর্মসূচীর মতো ‘তত্ত্ব’ উদ্ভাবন করে দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন, তা গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত, এমনকি উন্নত দেশগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন। সেজন্য তিনি বিশ্বের বাকি সব নোবেল লরিয়েটের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও অনন্য। দারিদ্র্যবিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন ও বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তিনি শুধু ‘ক্ষুদ্রঋণ’ কর্মসূচির তত্ত্ব নিয়ে বসে থাকেননি। সেই চিন্তাধারাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে তা সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরও যুগোপযোগী করে নুতন তত্ত্ব বা থিওরি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। সেটি ‘সামাজিক ব্যবসা’ এবং ‘থ্রি জিরোস’ থিওরি। তার এ তত্ত্ব বা থিওরিগুলো এখন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভূক্ত করে তা নিয়মিত পড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচীতেও তা অন্তর্ভূক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
‘সামাজিক ব্যবসা’ হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত একশ্রেণির অর্থনৈতিক প্রকল্প যার মূল লক্ষ্য হলো মুনাফার বদলে মানবকল্যাণ। তিনি ২০০৭ সালে এ ‘সামাজিক ব্যবসা’র ধারণাটি প্রবর্তন করেন। সামাজিক ব্যবসার সাতটি মূলনীতি রয়েছে : ১. দারিদ্র্যবিমোচনসহ এক বা একাধিক বিষয় যেমন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাহীন কল্যাণকর ব্যবসা এটি। ২. সবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসার লক্ষ্য। ৩. সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগ করা অর্থই ফেরত পাবেন। এর বাইরে কোনো ধরনের লভ্যাংশ ফেরত পাবেন না, কোনো ধরনের লভ্যাংশ ফেরত নিতে পারবেন না। ৪. বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত নেওয়ার পর বিনিয়োগ করা মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহৃত হবে। ৫. সামাজিক ব্যবসা হবে পরিবেশবান্ধব। ৬. এখানে যারা কাজ করবেন তারা ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন। ৭. সামাজিক ব্যবসা হবে আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা।
অপর পক্ষে ‘৩ শূন্য’ বা ‘থ্রি জিরোস’ তত্ত্বটি বর্তমান বিশ্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘৩ শূন্য (০)’ তত্ত্বটি হলো-শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নির্গমন। তিনি নোবেল লরিয়েটের বাইরেও একজন ক্রীড়া অনুরাগী, সংস্কৃতি প্রেমিক, আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অনুসারী এবং সর্বোপরি তিনি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে জীবনের শেষ বেলায় এক টগবগে তারুণ্যের প্রতীক।
তিনি বড় মাপের একজন ক্রীড়াপ্রেমিকও। ২০১৮ সালের কথা, বার্সেলোনার তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসিকে সেদিন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। সেদিন তার হাতে ছিল বার্সার জার্সি আর মেসির হাতে ছিল তার লেখা ‘দি ওয়ার্ল্ড অফ থ্রি জিরোস’ বইটি। স্প্যানিস ভাষায় সংস্করণের উদ্বোধনের জন্য সেদিন তিনি বার্সেলোনায় গিয়েছিলেন। বার্সা তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে তার আগমন উপলক্ষ্যে একটা ভিডিও পোষ্ট করেছিল। তিনি সেদিন বলেছিলেন, বাংলাদেশের লাখো-কোটি তরুণ বার্সাকে পছন্দ করে। আমি তাদের মুখপাত্র হয়ে এখানে এসেছি। তিনি সামাজিক ব্যবসায় খেলাধুলার প্রভাবকে কাজে লাগানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। এজন্য তিনি গড়ে তুলেছেন ‘ইউনূস স্পোর্টস হাব’, যার মাধ্যমে খেলাধুলাকে সামাজিকীকরণের জন্য কাজ করা হচ্ছে। তিনি ২০২৪-এ প্যারিস বিশ্ব অলিম্পিক আসরের অন্যতম প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ২০২০ সালে জাপান অলিম্পিকের মশাল বাহকও ছিলেন তিনি। আসন্ন ইতালি অলিম্পিকে ইতালিয়ানরা ড. মুহাম্মদ ইউনূকে পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে তদবির শুরু করেছেন। বিশ্ব অলিম্পিক আসরে প্রজ্জ্বলিত মশাল বহন করা সবচেয়ে সম্মানজনক একটি কাজ। তিনি একজন বড় মাপের সংস্কৃতিপ্রেমী ও উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশের ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় সফর, বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে আন্তর্জাতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রীয় সফরগুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তরুণ ও যুব সমাজের মাঝে বক্তৃতায় প্রায়ই বলেন, ‘তুমি চাকরিপ্রার্থী নও, তুমি চাকরি সৃষ্টিকারী’. জীবনে কর্মক্ষেত্রে কাজের কোনো বয়স নেই। ‘অবসর’ বলতে মানুষের জীবনে কোনো শব্দ থাকতে পারে না। অবসরকে চিরতরে অবসরে পাঠিয়ে দিতে হবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষই কর্মক্ষম। যেমন-তিনি ৮৬ বছর বয়সে টগবগে তরুণের মতো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার এসব বক্তব্য ও উপদেশগুলো আজ তরুণ সমাজকে সামনের দিকে পথ চলায় ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করছে এবং প্রতিটি বক্তব্যই আজ একেকটি তত্ত্ব কিংবা থিওরি হিসাবে কাজ করছে।
অথচ তার মতো একজন বিশ্ববরেণ্য নোবেল লরিয়েটকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার কতভাবেই না অসম্মান ও হেয় করার চেষ্টা করে গেছেন। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করা, কোর্টে বিচার কাজে হাজিরার দিন ৬ তলায় যাতে লিফট বেয়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য লিফট বন্ধ রাখা কিংবা সুদখোর বলে গালি দিয়ে হেয় করা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাকে চরমভাবে অপমানিত করার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনকে প্রধান অতিথি হিসাবে নিয়ে আসা, এমনকি কোর্টে হাজিরার দিন আসামির কাঠগড়ায় লোহার খাঁচা তৈরি করার মতো জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আজ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে পতিত জুলুমবাজ ফ্যাসিস্ট সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মৃত্যুর ভয়ে ধাওয়া খেয়ে দেশ ছেড়ে পলিয়ে কোনোরকম প্রাণে বেঁচে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে তিনি আমেরিকার মিডল টেনেসিস্টের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। সেই সময় তিনি বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত আদায়ের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার’ পরিচালনা করেন। আমেরিকার ন্যায়স ফেলে তার নিজ বাড়ি থেকে প্রকাশ করতেন ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’। এভাবেই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাস জীবনযাপন করেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০২৪-এর বিপ্লব পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে তিনি যদি দায়িত্ব নিতে রাজি না হতেন, তাহলে দেশ ও দেশের বাইরে একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম বলেন তো যিনি দেশের ওই ক্রান্তিলগ্নে ক্ষমতার হাল ধরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে আজকের দিন পর্যন্ত দেশকে এভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন? সেদিন তার বিকল্প কেউ কি ছিল? যদি অন্য কেউ ক্ষমতায় আসতেন তবে সর্বোচ্চ ১৫ দিন থেকে ১ মাস টিকে থাকতে পারত।
আর ওই এক মাসের মধ্যে প্রতি বিপ্লবের সমুহ আশংকা ছিল। এর অন্যতম কারণ ভারত ও তার গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’- এর বিশাল অপতৎপরতা। তিনি সেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই তার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও লবিং বিশেষ করে জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও কুটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিপ্লব পরবর্তী ধ্বংস প্রায় একটি দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে টেনে তুলে ধীরে ধীরে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
আর ভারত ও ‘র’-এর সব ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা রুখে দিয়ে,পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারকে পুনর্বাসনের জন্য ঘৃণ্য যে প্রতি বিপ্লবের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা হয়েছিল তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে সব অপতৎপরতা রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিসহ সবকিছুর অনেক ঊর্ধ্বে। দেশের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবেন, এটিই বাস্তবতা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, সম্প্রতি একটি গোষ্ঠী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে শুধু নির্বাচন নির্বাচন করে পাগল হয়ে গেছে। দেশের আপামর জনসাধারণ শুধু নির্বাচন চায় না।
তারা দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায়, যাতে করে কোনো সরকার ভবিষ্যতে বিগত সরকারের মতো ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। সেজন্য দরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার। বর্তমান বাংলাদেশের পাবলিক পারসেপ্শন অনুযায়ী মানুষ তার নেতৃত্বের প্রতি যথেষ্ঠ আস্থাশীল ও খুশি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ বলিষ্ঠ ও দক্ষ নেতৃত্বের গুণাবলি এবং তার সব ধরনের কর্মের সৃজনশীলতাই তাকে বিশ্বের অন্য সব নোবেল লরিয়েট ও প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে করেছে সম্পূর্ণ আলাদা ও অনন্য। দেশের ১৮ কোটি মানুষের তার অবিচল নেতৃত্বের প্রতি রয়েছে পূর্ণ সমর্থন।
মো. মাহবুবুর রহমান বুলবুল : সাবেক পরামর্শক, সিএআরডি ব্যাংক, ফিলিপাইন