পরিবেশ প্রশ্নে আমরা জাগছি বিশ্বময়
পাভেল পার্থ। সূত্র : কালের কন্ঠ, ৪ এপ্রিল ২০২৫

পৃথিবী নামের এই গ্রহ আজ জীবন-মরণের এক প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়েছে। রুগ্ণ, রক্তাক্ত, রংচটা। কারণ ছোট্ট এই গ্রহের সঙ্গে হাতে গোনা কিছু মুনাফাখোর নির্দয় রগড় করে চলেছে। বলা ভালো, ২০০ বছর ধরে ধনী আর উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলো এই নিষ্ঠুর খেলার নেতৃত্ব দিচ্ছে। খেলাটির বাহারি নাম ‘শিল্প বিপ্লব’ এবং ‘উন্নয়ন’। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে দুনিয়ার নদীস্রোতগুলো বাঁধ দিয়ে খুন করা হয়েছে। অরণ্যের হাড়-পাঁজর খুবলে টেনে তোলা হয়েছে বুকের দম আর ধমনির রক্ত। বাজারের অভিধানে যার নাম কয়লা, তেল আর গ্যাস। দুনিয়ার সব কৃষিজমির মাটি আজ বিষাক্ত আর পিপাসার্ত। প্রতিদিন এই মাটি এখন সার ও বিষ খেতে চায়। প্রতিদিন বাড়ছে পানির জ্বালা। কৃষিকে ঘিরে এই হত্যাকাণ্ডের পুস্তকি নাম ‘সবুজ বিপ্লব’।
প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ প্রশ্নে ৮০০ কোটি স্যাপিয়েন্সের দায় ও দায়িত্ব কোনোভাবেই এক ও অভিন্ন নয়। প্রমাণিত হয়েছে, প্রজাতি হিসেবে মানুষ এই পৃথিবী গ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠুর অন্যায়-অত্যাচার করে চলেছে। সৌরজগতের এই নীল ছোট্ট গ্রহ আজ দূষণ-দখলে কাহিল, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। তার পরও এই গ্রহটিই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বুধ, মঙ্গল, ইউরেনাস বা নেপচুন থেকে কেউ বাঁচাতে আসেনি। তবে এই ৮০০ কোটির সবাই কিন্তু পৃথিবীকে ধর্ষণ করছে না। মানুষ কিন্তু এই পৃথিবীকে আগলে, এই পৃথিবীর সঙ্গে বাঁচার জন্য জানবাজি রেখে লড়ছে। দুনিয়ার নানা প্রান্তে গড়ে উঠছে পরিবেশ মুক্তির আন্দোলন। কোক-পেপসির প্লাস্টিক দূষণ থেকে একটি নদী বা মনস্যান্টোর গ্লাইফোসেটগিরি থেকে একটি শাকলতা কিংবা বহুজাতিক বোম্বিং থেকে একটি বনরুই বাঁচানো আজ যুদ্ধের ময়দানে গর্দান চিতিয়ে দাঁড়ানো। পরিবেশ মুক্তির প্রশ্ন নিওলিবারেল ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের শ্রেণি আন্দোলন। বৈষম্য, দুর্নীতি, বিভাজন, লুণ্ঠন, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, নয়া উদারবাদ আর সর্বময় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধেই দানা বাঁধছে বৈশ্বিক পরিবেশ আন্দোলন।
একটা সময় রাজা-বাদশাহর আমলে বাঘ, হরিণ, বুনোমহিষ, গয়াল, অজগর, গণ্ডার খুন করাকে ‘অভিজাতপনা’ হিসেবে দেখা হতো। সেই কাল চলে গেছে। বন্যপ্রাণী হত্যাকে রাষ্ট্র এখন ‘অবৈধ’ ও ‘বেআইনি’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু তার মানে কি বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ হয়েছে? বরং বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য আরো মোটাতাজা হয়েছে। চাইলে লেমুর কিংবা ধনেশ নিমেষেই হাজির হবে। সবুজ বিপ্লবের নামে মাটি ও শস্যদানা সব আজ বিষাক্ত। কিন্তু এই বিষ কে খাচ্ছে? আর কে খেতে চাচ্ছে না? বলা হয়, সচেতন মানুষ সার-বিষে ভরা এমনতর ‘অনিরাপদ খাদ্য’ খেতে চায় না। তারা গ্রামের টাটকা ফলফলাদি, গৃহস্থবাড়ির সতেজ দানা আর নদীর খলবলে মাছ খেতে চায়। এই ‘সচেতন’ মানুষ কারা? গ্রামের গরিব কৃষিমজুর না, শহরের ধনী চাকুরে বা ব্যবসায়ী? সবাই সচেতন হলেও গ্রামের গরিব কৃষিমজুর, যারা আজও কৃষি-জুমের দা-হাল ধরে রেখেছে, তাদের পক্ষে কি সার-বিষহীন নিরাপদ খাবার খাওয়া সম্ভব? করপোরেট চেইনশপগুলো যেসব খাবারের নাম দিয়েছে ‘অর্গানিক ফুড’। কারণ নিরাপদ খাবারের দাম বেশি।
প্রশ্নটি কিন্তু অন্য জায়গায়। এসব সার-বিষের ব্যবসা কে করে আর এসব ব্যবহার করে কারা? প্রশ্ন হলো, মন্যস্যান্টো বা সিনজেনটা কম্পানির মালিকের বাসায় কি সার-বিষ দেওয়া খাবার রান্না হয়? তাঁদের পরিবার-পরিজন কি হাইব্রিড ফসলের খাবার খায়? নিশ্চয়ই নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো, সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবারগুলো তাদের পাতেই যায়। আর খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষকের পাতে পড়ে থাকে বিষাক্ত খাদ্যের উচ্ছিষ্ট। নিরাপদ খাদ্য আর নিরাপত্তা বলতে এই গরিব নিম্নবর্গের জন্য কিছুই নেই। সব নিরাপদ আর নিরাপত্তা বহুজাতিক বিষ কম্পানির মালিকদের। ঔপনিবেশিক শাসনকাল শেষ হলেও বিদ্যমান শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও বৈষম্যমূলক মনস্তত্ত্ব গায়েব হয়ে যায়নি, বরং আরো ভিন্নরূপে জোরালো ও দশাসই হয়েছে। দুনিয়ার শরীর ও স্বাস্থ্যকে বহুজাতিক জিম্মায় ছেড়ে দিতে কোনোভাবেই আমাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি না। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী তরুণদের নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তর তত্ত্ব এবং তৎপরতায় প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ মুক্তির প্রশ্নটি সরব নয়।
পরিবেশ সুরক্ষা ও মাতৃদুনিয়ার দুর্দশার প্রশ্নটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বিচারহীন পরিবেশ মুমূর্ষু দুনিয়ায় পরিবেশ সুরক্ষা প্রশ্নকে বারবার অরাজনৈতিক করে দেখা হয়। বাহাদুরি আর ক্ষমতার গণিতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়, যেন পরিবেশ সুরক্ষা মানে হলো কিছু ‘আগ্রাসী গাছের চারা লাগানো’। কিংবা প্রাকৃতিক বনভূমিতে ‘ইকোপার্ক’ বানানো বা জলাভূমিকে দখল করে ‘অভয়াশ্রম’ নাম দেওয়া। কিংবা কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার কমানোর নামে ‘সমন্বিত বালাইনাশক’ বা ‘জিএম বিটিবেগুনের’ অনুমোদন। একটি অন্যায় ঢাকতে গিয়ে আরেকটি জুলুম চাপিয়ে দেওয়া। পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নকে স্থানীয় প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ঐতিহাসিকতা থেকে দেখতে হবে। প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে চারপাশের নানা জীবনের নানা জটিল বহুমাত্রিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েই পরিবেশ সুরক্ষার যাত্রা শুরু করতে হবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি, আইন ও বহুবিধ বৈশ্বিক পরিবেশ অঙ্গীকার তৈরির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই তা নিম্নবর্গের আকাঙ্ক্ষা, অবদান, কাজ ও মনোজগেক স্পর্শ করে না। তাই দেখা যায়, বেশির ভাগ নীতিমালাই বছরের পর বছর কার্যহীন ও বিকল সময় পাড়ি দেয়। নীতিমালা গ্রহণের এই জনবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে জনগণের যাপিতজীবনের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করেই নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত বিরাজমান নীতিগুলো জনগণের বহুমাত্রিক স্বর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভঙ্গিকে ধরতে ব্যর্থ। তাই দেখা যায়, দুম করেই পরিবেশপ্রক্রিয়ার সামগ্রিক শৃঙ্খলাকে তছনছ করে কোনো আহামরি উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। সুন্দরবনের জেলে-মৌয়াল থেকে শুরু করে আমাজন বনের আদিবাসী সবার পরিবেশ সুরক্ষার বিজ্ঞানকে আগলে দাঁড়ানো জরুরি।
এই গ্রহ আর খুব বেশিদিন জেগে থাকবে কি না, আমরা জানি না। কিন্তু বিলীনের আগেই আমরা জবরদস্তি করে এর জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি না। বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য, ‘আমাদের পৃথিবী আমাদের শক্তি’। আমরা কি এই গ্রহকে বিশ্বাস করি? আমরা কি আমাদের ওপর আস্থা রাখি? তাহলে দায় ও দরদের প্রবাহ জারি রাখতে হবে। থামতে হবে, থামাতে হবে। পরিবেশ প্রশ্নে আপনিও জাগুন, জনে জনে প্রতিজনে, জলে-জঙ্গলে, প্রাণে প্রাণে সর্বপ্রাণে সংহতি জোরদার করুন।
লেখক : গবেষক ও লেখক