কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমি উজাড় নয়

মো. অহিদুর রহমান । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৪ মার্চ ২০২৫

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমি উজাড় নয়

অক্সিজেন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, বাণিজ্য, উৎসব, শিল্পসংস্কৃতি, আশ্রয়, প্রশান্তি জীবনের সবকিছুই গাছ ঘিরে, বন কেন্দ্র করে। কিন্তু দেশের গুরুত্বপূর্ণ শালবন, শেরপুরের ঝিনাইগাতীর রাংটিয়ায় আগুন, পান্থকুঞ্জের গাছ কর্তন, রাজশাহীর টেক্সটাইল মিলের শতাধিক গাছ প্রাণ-আরএলএফ গ্রুপের কেটে নেওয়া, রাজশাহীর সোনাদীঘি এলাকায় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য শতবর্ষী গাছসহ অর্ধশত গাছ কর্তন, ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের গাছ কাটা, রাজশাহীর বাগমারায় বিষ দিয়ে তাল গাছ হত্যা, অক্সিডেন্টাল কোম্পানির অঙ্গার করে দেওয়া লাউয়াছড়া বন, মধুপুরের শালবন কেটে চলা, শত শত ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের, নেত্রকোণা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শতবর্ষী গাছ কর্তনসহ সারা দেশে বনভূমি ও গাছের ওপর নির্মম অত্যাচার চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র এখানে নীরব ভূমিকা পালন করছে। 

 

 

ঔষধি লতা-পাতা, বীজ, বাদাম, শেকড়, কন্দ, পোকামাকড়, মধু, মাশরুম, ফল, রসসহ নানা খাদ্যবৈচিত্র্যের জোগানদাতা প্রাকৃতিক বন। খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানে বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো জৈবিক বৈচিত্র্যের প্রকৃত ভান্ডার এবং বনজ সম্পদ বিশ্বব্যাপী পরিবারের প্রধান ভিত্তি। জীববৈচিত্র্যের কারণে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পরিবেশগত ভিত্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

 

 

 

বন এবং গাছপালা পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যাপক অবদান রাখে। গাছ মাটির উর্বরতা উন্নত করে ফসল উৎপাদন বজায় রাখে। গাছগুলো জল এবং বায়ু ক্ষয় নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং নাইট্রোজেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানগুলো মাটিতে ফিরিয়ে আনে। গাছগুলো এমন জায়গায়ও জন্মায় যেখানে কৃষি ফসল ব্যর্থ হতে পারে, যার ফলে প্রান্তিক জমিতে উৎপাদন সম্ভব হয়। গাছগুলো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ এবং সঞ্চয় করে। অনেক প্রাণী তাদের খাদ্যের জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। অনেক প্রাণী বনে খাদ্যসংকটের কারণে লোকালয়ে চলে আসে ফলে মানুষ ও প্রাণীর মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

 

 

 

আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ বন ও বনজ সম্পদ ব্যবহার করে অত্যন্ত সংযমের সঙ্গে ও পরিমিতভাবে। কারণ তারা মনে করে বন তাদের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, আশ্রয়, পানি, ওষুধ, জ্বালানি এবং বস্ত্র জোগায়।

আদিবাসীরা বনকে মনে করে মাতা বা পিতা হিসেবে। সেজন্য বনকে দেবতা বা ঈশ্বরজ্ঞান করে এর পবিত্রতা রক্ষা করে। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ৩০ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে আছে অরণ্য। পরিষ্কার বাতাস, পানি তৈরির প্রাকৃতিক কারখানা বলতে পারেন একে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থান এটি। তেমনি বহু মানুষ কোনো না কোনোভাবে এর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পৃথিবীজুড়ে বন উজাড় হচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। আজ বিশ্ব বন দিবসে অরণ্যের ১২টি উপকারিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব পাঠককে।

 

 

বন অক্সিজেন তৈরি করে। আমাদের ছাড়া কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে গাছ। আবার এর বদলে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে। বলা হয়, একটি বড় আকারের গাছ চারজন মানুষের এক দিনের অক্সিজেনের জোগান দেয়। পৃথিবীর কার্বন ডাইঅক্সাইডের বড় সংরক্ষণাগার অরণ্য। বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে পরিবেশ ভালো রাখে অরণ্যের গাছপালা। মাটি থেকে পানি নিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয় গাছ। তাই বড়সড় জায়গা নিয়ে বিস্তৃত জঙ্গলগুলো নিজেদের একটা ক্ষুদ্র জলবায়ু এলাকা তৈরির পাশাপাশি আবহাওয়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। এমনকি খুব বড় অরণ্য হলে এর প্রভাব থাকতে পারে হাজারো মাইল পর্যন্ত। যেমন অ্যামাজনের জঙ্গল শুধু এর ভেতরে ও আশপাশে বৃষ্টিপাত ঘটাতে ভূমিকা রাখে তা নয়, এমনকি উত্তর আমেরিকার বিশাল সমতলভূমিতেও বৃষ্টি ঝরতে পারে বিশাল অরণ্যটির প্রভাবে।

 

 

বন বাতাস পরিষ্কার রাখে। বন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করার পাশাপাশি কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড থেকে বাতাস পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এগুলোর সবই বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু বাতাস বিশুদ্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরের গাছপালা এভাবে ৮৫০ জন মানুষের জীবন বাঁচায় বছরে, আর স্বাস্থ্যসেবায় খরচ কমায় ৬৮০ কোটি ডলারের।

 

 

অন্যদিকে বন ভূমিক্ষয় রোধে সাহায্য করে। ভূমিক্ষয়ে ভূমিকা রাখে এমন বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। যেমন বাতাস আর বৃষ্টিকে আটকায় নিজের শেকড় আর ডালপাতার মাধ্যমে। তাই কোনো এলাকায় বন উজাড় হলে আশপাশের জায়গাগুলোয় ভূমিধস, ধূলিঝড় ও বন্যার সৃষ্টি হয়।

বনের গাছ ওষুধ তৈরিতে সাহায্য করে। ওষুধ তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয় তার অনেকটিই পাওয়া যায় জঙ্গলে। বন শব্দকে চাপা দেয়। উচ্চ শব্দও মৃদু হয়ে যায় বনে। এ ক্ষেত্রে বনের বৃক্ষ শব্দের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। এ শব্দের তেজ হারানোর কারণ পাতার মর্মর, পাখির ডাক ইত্যাদি। শুধু জায়গামতো থাকা গাছ এমনকি আপনার বাসায় আসা কৃত্রিম শব্দ ৫ থেকে ১০ ডেসিবেল কমিয়ে দিতে পারে। কিংবা আপনার কানে যে শব্দ পৌঁছে এটা অর্ধেক করে দেবে।

 

 

বন নির্মল বাংলাদেশ তৈরিতে ফুসফুসের মতো কাজ করে, দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে, বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখে। বাংলাদেশে দিনদিন বন কমছে। বন কমছে বলেই বন্য প্রাণী তার বাসস্থান হারাচ্ছে। অনেক বন্য প্রাণী তার বাসস্থান হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী দেশের বনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমি কাগজে লিখি, বই পড়ি, একটি বাড়ি তৈরি করি, ঘরে সুন্দর আসবাবপত্র তৈরি করি, পাখির গান শুনি, অক্সিজেন গ্রহণ করি, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি সবই সম্ভব হচ্ছে এ বনের কারণে। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, মানুষ-প্রাণীর খাদ্যসংকট, হাওর-জলাভূমি ও নদীর নাব্য হ্রাস, ভূমিতে অতিরিক্ত বিষপ্রয়োগ, বনদস্যু ও মানুষের অত্যাচারে বন হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন।

 

 

বন ধ্বংসের প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জ্বালানির চাহিদা পূরণ করছে বনের কাঠ দিয়ে, বসতবাড়ি নির্মাণ, ফসল চাষাবাদ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নগরায়ণ, জুমচাষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃক্ষের পরিচর্যার অভাব, পরিবেশদূষণ, পাহাড় কাটা, পাহাড় ধ্বংস, বৃক্ষের রোগ, বনবিধি অমান্য করাসহ বিভিন্ন কারণে বন ধ্বংস হচ্ছে।

 

 

গারো পাহাড়ে বাঘ, চিত্রা ও মায়া হরিণ, রামকুত্তা, ভোঁদড়, খ্যাঁকশিয়াল মেঘলা চিতা, বাঘডাশা, গন্ধগোকুল, বড় টিকটিকি, বাদুড়, প্যাঁচা, চিল, কৌড়াপাখি, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, শজারু, বনরুই, শূকর, বনগরু, গুইসাপ, উদ্‌বিড়াল, কালিম পাখি, সোনালি বিড়াল, রামকুকুর, কচ্ছপ, কাউট্টা, গেছোবাঘ, উল্লুক, সোনাগুইল, হনুমান, খরগোশ, গোয়াল, লজ্জাবতী বানর, চশমাপরা বানর, বনছাগল, অজগর, বাঘ, নীলগাই, বন্যহাতি ইত্যাদির দেখা পাওয়া যেত। বর্তমানে এসব প্রাণীর সচরাচর বিচরণ লক্ষ করা যায় না।

 

 

আমাদের পাহাড়ি বন পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। পাহাড় আজ খোলা হয়ে গেছে। সুন্দরবনে গাছ কমছে। বন্য প্রাণী কমছে, মৌমাছি কমছে। মৌয়ালরা মধু পাচ্ছেন না। অনেক মৌয়াল বেকার হয়ে যাচ্ছেন। বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষ পেশা হারাচ্ছে।

 

 

কিন্তু যখন কোনো বন কেটে বা পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন আর্দ্রতা কমে যায়। যার ফলে গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি এবং গ্রীষ্মকালীন রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তার থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রাণী ব্যাপকভাবে হারিয়ে যায় এবং বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি ঘটে।

 

 

বনভূমি সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যত্রতত্র নির্বিচার গাছ কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বন উজাড়কারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আসুন বন রক্ষা করে টিকে থাকি এ গ্রহে।