পরিস্থিতি নিজের জন্য কঠিন করে তুলেছেন নেতানিয়াহু
ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : ইত্তেফাক, ২২ জুন ২০২৫]

শুরুটা নিজের অনুকুলে রাখতে পারলেও দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি যেন নেতানিয়াহর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে। আগ বাড়িয়ে ইরানে আক্রমণ করে দেশসেরা বিজ্ঞানী, ইসলামি রেড্যুলেশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা এবং সামরিক স্থাপনায় সফলভাবে হামলা চালাতে সক্ষম হলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইরানের তরফ থেকে পালটা হামলায় ইসরাইলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অভাবনীয়। তাদের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রণ ডোম এবং পেট্রিয়ট ফাঁকি দিয়ে ইরানের ক্ষপণাস্ত্র বেশ কিছু লক্ষ্যে নিখুঁত হামলা চালিয়েছে। তেহরান খালি করতে ইসরাইলের তরফ থেকে ইরুনের জনগণকে সতর্কবার্তা দিলে ও খোদ ইসরাইলের জেরুজালেম এবং তেল আবিবের জনগণও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটাছুটি করছে। যুদ্ধ শুরুর সাত দিনের মাথায় ইরানের রাস্তায় যেমন লাখ লাখ মানুষ ইসরাইলের অগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সরব হয়েছে, একইরকম প্রতিবাদ হচ্ছে ইসরাইলে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নেতানিয়াহুর স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা শঙ্কার জন্য দায়ী করছে নেতানিয়াহুকে, যার শুরু গাজায় হামাসবিরোধী অভিযান থেকে। সাম্প্রতিক সময়ের জরিপগুলো বলছে এ পর্যন্ত ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহু অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন। ধারণা করেছিলেন, ইরানে এই আচমকা হামলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে তাদের সমরসজ্জা নিয়ে ইসরাইলের পশে এসে দাঁড়াবে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের সম্ভাবনার বিষয় উড়িয়ে দেননি, বরং মার্কিন কংগ্রেস থেকে এ বিষয়ে অনুমোদন নিয়ে রেখেছেন। তিনি দুই সপ্তাহের সময় নিয়েছেন গভীরভাবে ভেবে সিদ্ধান্তে আসতে। এই সময়ের মধ্যেই ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের ভেতরই তৈরি হয়েছে ভিন্নমত। এই মুহূর্তে এ ধরনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়াকে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থি হিসেবে দেখছেন অনেক নীতিনির্ধারক। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘসময়ের মিত্র, যারা এ পর্যন্ত সবধরনের মার্কিন অগ্রাসনকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেই ইউরোপীয় দেশগুলোও এই সময়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের হামলার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়র স্টারমার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিন ইউরোপীয় দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জেনেভায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যুদ্ধটি যতটা ইসরাইল পছন্দ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র যত দ্রুত এই যুদ্ধকে পুঁজি করে ইরানের সরকার পরিবর্তন করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তাদের অবস্থানকে মজবুত করতে চাইছেন, বিষয়টি এতটা সহজ নয়, বরং এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল গোটা বিশ্বের জন্য
অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইল যেভাবে ইরানের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সে দেশের জনগণের একটা অংশের বিরোধিতাকে এই হামলায় কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিল, সেটি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল যে, এই হামলার মধ্য দিয়ে ইরানের গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ
পরিস্থিতি নিজের জন্য কঠিন করে তুলেছেন নেতানিয়াহু
নেতানিয়াহুর হাতে খুব বেশি একটা সময় নেই। দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তুষ্টি কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বলা যায় না। তার রাজনৈতিক মিত্ররা প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছে। ডানপন্থি এই সরকারের দুটি শরিক শ্যাস এবং ইউনাইটেড তোরাহ জুদাইজমইতোর মধ্যে নেতানিয়াহু সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছে।
মানুষের সমর্থনে ইসরাইল সহজেই তাদের বাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। তা হয়নি। এই হামলায় ইরানের ভেতর ইসরাইল যে সংখ্যায় তাদের চিহ্নিত ব্যক্তিদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় (সহস্রাধিক) বেসামরিক মানুষ (নারী ও শিশুদের একটা বড় অংশ) নিহত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইরানের বর্তমান শাসকদের চেয়ে ইসরাইলের প্রতি ইরানের সাধারণ মানুষের ঘৃণ্য বেশি করে ফুটে উঠেছে, যার রেশ দেখা যচ্ছে লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে
এমন একটা সময়ে ইসরাইল এই হামলা চালাল, যখন ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় ছিল। এই আলোচনাটি পঞ্চম ধাপ অতিক্রম করেছিল এবং গত ১৫ জুন দুই পক্ষের ষষ্ঠ ধাপের আলোচনায় বসার দিনক্ষণ ছিল। যদিও আলেচনার অগ্রগতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা ইরান কোনো পঞ্চই সন্তুষ্ট ছিল না, তার পরও এই আলোচনাটি চলমান ছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সনদের সুনির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী আলোচনা, মধ্যস্থতা কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট বিরোধের ক্ষেত্রে সালিশ প্রক্রিয়া ইত্যাদি সব কর্ম সম্পাদনের পরও হাদি আন্তর্জাতিক উদ্বেগ নিরসনে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জিত না হয়, তাহলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব স্থায়ী সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে শান্তি স্থাপনের স্বর্থে শক্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম ইসরাইল এর কোনো তোয়াক্কা না করে চলমান একটি আলোচনা প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে কেবল আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেনি, বরং গাজা হত্যাকান্ডের মতো অসংখ্য বেসামরিক মানুষ হত্যা করে মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর এটা স্পষ্ট যে, ইস্রাইলের সাম্প্রতিক সময়ের নেতানিয়াহু বিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাবোধকে প্রকট করে, এর জন্য ইরানকে দায়ী করে ইরানে অভিযান পরিচালনা করে একধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
এমন এক অবস্থায় তাদের হামলা থেকে 'ইরান কেবল নিজেদের রক্ষা করছে' বলে জানানো হয়েছে ইরানের সরকারের পক্ষ থেকে। সেসঙ্গে তারা এটাও জানিয়ে দিয়েছে যে, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে ইরানও পালটা হামলা চালাবে না। এর মধ্য দিয়ে ইসরাইলের পক্ষ থেকে এই হামলার ন্যায্যতা দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। 'ইরানের কাছে কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র থাকা উচিত নয়'-ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবির সঙ্গে একমত পোষশ করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। সম্প্রতি কানাজায় জি-৭ সম্মেলনে শীর্ষ নেতৃবর্ণ এই বিষয়ে সম্মতি দিলেও ইসরাইলের তরফ থেকে ইরানে হামলার বিষয়ে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া হয়নি। হামলার এই পর্যায়ে এসে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতল্লাহ খোমেনিকে হত্যা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে নেতানিয়াহু কার্যত ইরানে ইসলামিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে তাদের ভাষায় তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করে নিজেকে ইসরাইলের ইতিহাসে 'অমর' করে রাখতে চাইছেন, যা তার পড়তি জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের এক প্রয়াস হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
নেতানিয়াহুর হাতে খুব বেশি একটা সময় নেই। দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তুষ্টি কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বলা যায় না। তার রাজনৈতিক মিত্ররা প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছে। ডানপন্থি এই সরকারের দুটি শরিক শ্যাস এবং ইউনাইটেড তোরাহ জুদাইজমইতোর মধ্যে নেতানিয়াহু সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছে। যেদিন তিনি ইরানে হামলা পরিচালনা করেন, এর পরদিন ইসরাইলের পার্লামেন্ট ন্যাসেটে এই নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করার কথা বলেছেন। এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ইসরাইলের পশে দাঁড়ানোকে কঠিন করে তুলেছে, যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরাইলের এই হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন। ইরানে হামলা বন্ধের বিষয়ে ইসরাইলকে চাপ দিতে ইউরোপীয় নেতারা বৈঠক করছেন এবং তারা এ বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুনরায় ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রক্রিয়া শুরু করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন-এই বিষয়টি ট্রাম্প সমর্থন করেন কি না. এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'ইসরাইল এখন জিতছে এবং তারা খুব ভালো করছে, তাই জয়ী পক্ষকে এমন অবস্থায় কিছু বলা কঠিন।' এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত নিজেকে জড়িয়ে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য দুই সপ্তাহ সময় নিলেও ইসরাইলের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন, যা ইউরোপীয় আলোচনা প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এই মুহূর্তে এটাই বলা যায় যে, ইরুনের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়েই ইসরাইল এবং তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের যত ক্ষোভ। যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, হয়তো এই যুদ্ধে ইসরাইলকে আরো অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করবে এবং মন থেকে চাইবে ইরানের বিরুদ্ধে তারা আরো ভালো করুক। কিন্তু ইসরাইলের ভেতরে নেতানিয়াহুবিরোধী অবস্থান অতিক্রম করে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া কতদিন যুদ্ধক্ষেত্রে 'ভালো করবেন'- এটা একটা বড় প্রশ্ন। রাশিয়া ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশে নতুন করে মিসাইল পরীখল চালিয়েছে, যেখানে চীনের পরোক্ষ মদত আছে, ধরেই নেওয়া যায়। তুরস্ক, লেবানন ও ইরাক ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং গোটা বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে প্রতিনিয়ত ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহুর এই খেলায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়া প্রকারান্তরে আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। লেখক:
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শুরুটা নিজের অনুকুলে রাখতে পারলেও দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি যেন নেতানিয়াহর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে। আগ বাড়িয়ে ইরানে আক্রমণ করে দেশসেরা বিজ্ঞানী, ইসলামি রেড্যুলেশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা এবং সামরিক স্থাপনায় সফলভাবে হামলা চালাতে সক্ষম হলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইরানের তরফ থেকে পালটা হামলায় ইসরাইলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অভাবনীয়। তাদের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রণ ডোম এবং পেট্রিয়ট ফাঁকি দিয়ে ইরানের ক্ষপণাস্ত্র বেশ কিছু লক্ষ্যে নিখুঁত হামলা চালিয়েছে। তেহরান খালি করতে ইসরাইলের তরফ থেকে ইরুনের জনগণকে সতর্কবার্তা দিলে ও খোদ ইসরাইলের জেরুজালেম এবং তেল আবিবের জনগণও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটাছুটি করছে। যুদ্ধ শুরুর সাত দিনের মাথায় ইরানের রাস্তায় যেমন লাখ লাখ মানুষ ইসরাইলের অগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সরব হয়েছে, একইরকম প্রতিবাদ হচ্ছে ইসরাইলে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নেতানিয়াহুর স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা শঙ্কার জন্য দায়ী করছে নেতানিয়াহুকে, যার শুরু গাজায় হামাসবিরোধী অভিযান থেকে। সাম্প্রতিক সময়ের জরিপগুলো বলছে এ পর্যন্ত ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহু অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন। ধারণা করেছিলেন, ইরানে এই আচমকা হামলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে তাদের সমরসজ্জা নিয়ে ইসরাইলের পশে এসে দাঁড়াবে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ধরনের সম্ভাবনার বিষয় উড়িয়ে দেননি, বরং মার্কিন কংগ্রেস থেকে এ বিষয়ে অনুমোদন নিয়ে রেখেছেন। তিনি দুই সপ্তাহের সময় নিয়েছেন গভীরভাবে ভেবে সিদ্ধান্তে আসতে। এই সময়ের মধ্যেই ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের ভেতরই তৈরি হয়েছে ভিন্নমত। এই মুহূর্তে এ ধরনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়াকে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থি হিসেবে দেখছেন অনেক নীতিনির্ধারক। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘসময়ের মিত্র, যারা এ পর্যন্ত সবধরনের মার্কিন অগ্রাসনকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেই ইউরোপীয় দেশগুলোও এই সময়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের হামলার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়র স্টারমার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিন ইউরোপীয় দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জেনেভায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যুদ্ধটি যতটা ইসরাইল পছন্দ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র যত দ্রুত এই যুদ্ধকে পুঁজি করে ইরানের সরকার পরিবর্তন করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তাদের অবস্থানকে মজবুত করতে চাইছেন, বিষয়টি এতটা সহজ নয়, বরং এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল গোটা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইল যেভাবে ইরানের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সে দেশের জনগণের একটা অংশের বিরোধিতাকে এই হামলায় কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিল, সেটি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল যে, এই হামলার মধ্য দিয়ে ইরানের গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি নিজের জন্য কঠিন করে তুলেছেন নেতানিয়াহু নেতানিয়াহুর হাতে খুব বেশি একটা সময় নেই। দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তুষ্টি কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বলা যায় না। তার রাজনৈতিক মিত্ররা প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছে।
ডানপন্থি এই সরকারের দুটি শরিক শ্যাস এবং ইউনাইটেড তোরাহ জুদাইজমইতোর মধ্যে নেতানিয়াহু সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছে। মানুষের সমর্থনে ইসরাইল সহজেই তাদের বাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। তা হয়নি। এই হামলায় ইরানের ভেতর ইসরাইল যে সংখ্যায় তাদের চিহ্নিত ব্যক্তিদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় (সহস্রাধিক) বেসামরিক মানুষ (নারী ও শিশুদের একটা বড় অংশ) নিহত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইরানের বর্তমান শাসকদের চেয়ে ইসরাইলের প্রতি ইরানের সাধারণ মানুষের ঘৃণ্য বেশি করে ফুটে উঠেছে, যার রেশ দেখা যচ্ছে লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এমন একটা সময়ে ইসরাইল এই হামলা চালাল, যখন ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় ছিল। এই আলোচনাটি পঞ্চম ধাপ অতিক্রম করেছিল এবং গত ১৫ জুন দুই পক্ষের ষষ্ঠ ধাপের আলোচনায় বসার দিনক্ষণ ছিল। যদিও আলেচনার অগ্রগতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা ইরান কোনো পঞ্চই সন্তুষ্ট ছিল না, তার পরও এই আলোচনাটি চলমান ছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সনদের সুনির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী আলোচনা, মধ্যস্থতা কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট বিরোধের ক্ষেত্রে সালিশ প্রক্রিয়া ইত্যাদি সব কর্ম সম্পাদনের পরও হাদি আন্তর্জাতিক উদ্বেগ নিরসনে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জিত না হয়, তাহলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব স্থায়ী সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে শান্তি স্থাপনের স্বর্থে শক্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম ইসরাইল এর কোনো তোয়াক্কা না করে চলমান একটি আলোচনা প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে কেবল আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেনি, বরং গাজা হত্যাকান্ডের মতো অসংখ্য বেসামরিক মানুষ হত্যা করে মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর এটা স্পষ্ট যে, ইস্রাইলের সাম্প্রতিক সময়ের নেতানিয়াহু বিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাবোধকে প্রকট করে, এর জন্য ইরানকে দায়ী করে ইরানে অভিযান পরিচালনা করে একধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
এমন এক অবস্থায় তাদের হামলা থেকে 'ইরান কেবল নিজেদের রক্ষা করছে' বলে জানানো হয়েছে ইরানের সরকারের পক্ষ থেকে। সেসঙ্গে তারা এটাও জানিয়ে দিয়েছে যে, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে ইরানও পালটা হামলা চালাবে না। এর মধ্য দিয়ে ইসরাইলের পক্ষ থেকে এই হামলার ন্যায্যতা দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। 'ইরানের কাছে কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র থাকা উচিত নয়'-ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবির সঙ্গে একমত পোষশ করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। সম্প্রতি কানাজায় জি-৭ সম্মেলনে শীর্ষ নেতৃবর্ণ এই বিষয়ে সম্মতি দিলেও ইসরাইলের তরফ থেকে ইরানে হামলার বিষয়ে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া হয়নি। হামলার এই পর্যায়ে এসে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতল্লাহ খোমেনিকে হত্যা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে নেতানিয়াহু কার্যত ইরানে ইসলামিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে তাদের ভাষায় তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করে নিজেকে ইসরাইলের ইতিহাসে 'অমর' করে রাখতে চাইছেন, যা তার পড়তি জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের এক প্রয়াস হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
নেতানিয়াহুর হাতে খুব বেশি একটা সময় নেই। দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তুষ্টি কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বলা যায় না। তার রাজনৈতিক মিত্ররা প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছে। ডানপন্থি এই সরকারের দুটি শরিক শ্যাস এবং ইউনাইটেড তোরাহ জুদাইজমইতোর মধ্যে নেতানিয়াহু সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছে। যেদিন তিনি ইরানে হামলা পরিচালনা করেন, এর পরদিন ইসরাইলের পার্লামেন্ট ন্যাসেটে এই নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করার কথা বলেছেন। এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ইসরাইলের পশে দাঁড়ানোকে কঠিন করে তুলেছে, যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরাইলের এই হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন। ইরানে হামলা বন্ধের বিষয়ে ইসরাইলকে চাপ দিতে ইউরোপীয় নেতারা বৈঠক করছেন এবং তারা এ বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুনরায় ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রক্রিয়া শুরু করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন-এই বিষয়টি ট্রাম্প সমর্থন করেন কি না. এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'ইসরাইল এখন জিতছে এবং তারা খুব ভালো করছে, তাই জয়ী পক্ষকে এমন অবস্থায় কিছু বলা কঠিন।' এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত নিজেকে জড়িয়ে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য দুই সপ্তাহ সময় নিলেও ইসরাইলের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন, যা ইউরোপীয় আলোচনা প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এই মুহূর্তে এটাই বলা যায় যে, ইরুনের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়েই ইসরাইল এবং তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের যত ক্ষোভ। যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, হয়তো এই যুদ্ধে ইসরাইলকে আরো অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করবে এবং মন থেকে চাইবে ইরানের বিরুদ্ধে তারা আরো ভালো করুক। কিন্তু ইসরাইলের ভেতরে নেতানিয়াহুবিরোধী অবস্থান অতিক্রম করে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া কতদিন যুদ্ধক্ষেত্রে 'ভালো করবেন'- এটা একটা বড় প্রশ্ন। রাশিয়া ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশে নতুন করে মিসাইল পরীখল চালিয়েছে, যেখানে চীনের পরোক্ষ মদত আছে, ধরেই নেওয়া যায়। তুরস্ক, লেবানন ও ইরাক ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং গোটা বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে প্রতিনিয়ত ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহুর এই খেলায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়া প্রকারান্তরে আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়