প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে
ড. মাহফুজ পারভেজ [সূত্র : যুগান্তর, ০২ জুন ২০২৫]

বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন সেক্টরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি অংশের আচার-আচরণ ও কাজ-কারবার সম্পর্কে এন্তার অভিযোগ উচ্চারিত হয়। পেশাগত দক্ষতা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও নৈর্ব্যক্তিতা তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে এসব গুণের লেশমাত্রও দেখা যায় না। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শীর্ষ আমলাই প্রজাতন্ত্রের সেবক ও স্বার্থরক্ষাকারী হওয়ার চেয়ে সরকারি দলের অনুগত হতে অধিকতর আগ্রহী।
পেশাগত পরিচয়ের বদলে দলীয় পরিচয় গ্রহণ করায় আমলাতন্ত্রে তীব্র দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। অনেক সদস্য নিরপেক্ষ আমলা বা কর্মকর্তা-কর্মচারী না হয়ে কোনো না কোনো দলের বরাতে পরিপুষ্ট হওয়ায় বাংলাদেশের প্রশাসনব্যবস্থা সদ্য-অতীতে চরম অবক্ষয়ের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়া এখনো দেখা যাচ্ছে আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ও সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর স্থানে অসন্তোষ ও আন্দোলনের চিত্রে। সন্দেহ নেই, এসবের পেছনে রয়েছে আমলাতন্ত্রের দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণ। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আন্দোলন ও বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তীব্রভাবে উচ্চারিত সংস্কারের রণধ্বনির পরও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে দলীয়করণ, রাজনীতিকীকরণ ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না? এ প্রশ্নটি বছরের পর বছর ধরে উত্থাপিত হলেও উত্তরহীন রয়েছে, যা সুশাসন ও স্বচ্ছতার জন্য ক্ষতিকর। এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। নইলে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সুশাসনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
আমলাতন্ত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের সুবাদে পছন্দের লোকদের পদোন্নতি দেওয়া এবং বিরাগভাজনদের বঞ্চিত করার ধারা অব্যাহত থাকায় দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসকের বদলে দুর্নীতিবাজ-দলীয় অনুসারী বৃদ্ধি পেয়েছে অতীতের নানা সরকারের আমলে। ফলে, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে নির্দ্বিধায় চলতে পারছে। যদিও অনেক রাজনৈতিক নেতার মতো অনেক প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিও অভিযুক্ত হয়েছেন, তথাপি সমস্যাটির সমাপ্তি ঘটেনি এবং দলীয়করণ ও দুর্নীতির ঘটনাগুলো নিরপেক্ষ, দক্ষ, আইনানুগ প্রশাসনের এবং গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য অশনিসংকেতস্বরূপ।
আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন নিয়ে যে বিশেষজ্ঞ সবচেয়ে বেশি গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেছেন, তার নাম ম্যাক্স ওয়েবার। তিনি ছিলেন একজন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও আমলাতন্ত্রবিষয়ক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। আমলাতন্ত্র নিয়ে ওয়েবারের বিশ্লেষণ আধুনিক প্রশাসন, সরকার ও করপোরেট কাঠামো বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও বাংলাদেশের প্রশাসন ম্যাক্স ওয়েবারের চিন্তা-চেতনা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে।
ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, আমলাতন্ত্রের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। এসব বৈশিষ্ট্য যদি বাংলাদেশের পটভূমিতে পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে অনেক দুর্বলতা ও অসংগতি দৃশ্যমান হয়, যা বাংলাদেশের প্রশাসনকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত অদক্ষ ও অপেশাদার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে।
ওয়েবারের মতে, আমলাতন্ত্রের জন্য অবশ্যই স্পষ্টভাবে নির্ধারিত কর্তৃত্বের কাঠামো থাকতে হয়। আমলাতন্ত্রে এক ধরনের উপরে-নিচে সাজানো দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের ধাপ থাকে। প্রত্যেক কর্মকর্তা তার উপরস্থ কর্মকর্তার অধীন থাকেন এবং নিচের কর্মচারীদের ওপর কর্তৃত্ব রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা আইনে বহাল থাকলেও কার্যক্ষেত্রে প্রতিপালিত হয়েছে কমই। রাজনৈতিক প্রভাবে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিচের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্তৃত্ব করতে দেখা গেছে বারবার। এসব তথ্য সময়ে সময়ে উন্মোচিত হলেও কোনো সরকারই তা বন্ধ করেনি।
বরং প্রশাসনের কাঠামো ও পদক্রম ভেঙে দলের লোকজনকে দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাতে দুর্নীতির জোয়ার বয়েছে। সিরাজ উদ্দিন সাথী বাংলাদেশের প্রশাসন নিয়ে বেশকিছু অভিজ্ঞতাজাত গবেষণা করেছেন। তার রচিত ‘আমলা পুরাণ’, ‘বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র : রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণের আবর্তে’, ‘আমলাতন্ত্রের অন্দর মহলে বত্রিশ বছর’ বইগুলোতে এমন অনেক ব্যাখ্যার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে প্রশাসনের অবক্ষয়, দলীয়করণ ও দুর্নীতির দলিল।
আমলাতন্ত্রে নিয়ম ও বিধান অনুসারে কার্য সম্পাদন করার কথা বলেছেন ম্যাক্স ওয়েবার। প্রশাসনের সব সিদ্ধান্ত ও কাজ পূর্বনির্ধারিত নিয়ম-কানুন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার কথা। এতে ব্যক্তিগত পক্ষপাত বা অনিয়ম প্রতিরোধও সম্ভব। অতীতে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ করা গেছে; পদোন্নতি, পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও দলীয় পছন্দ প্রাধান্য পেয়েছে। প্রশাসনে সিন্ডিকেট করে নিয়ম ভাঙা হয়েছে। আইনকে এড়িয়ে অন্যায় করারও অনেক উদাহরণ রয়েছে। এসবই হয়েছে রাজনীতি ও প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকা লোকজনের সম্মতি ও ইঙ্গিতে।
তাছাড়া দায়িত্বে গাফিলতির প্রশ্নে অতীতে আমলাতন্ত্রে বহু নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। লিখিত নথিপত্র ও ডকুমেন্টেশন রাখার ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখানো হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে নথিভুক্ত করে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বদলে রাজনৈতিক গডফাদারদের ইচ্ছায় কর্ম করে বাহবা ও সুবিধা নিয়েছেন, এমন আমলা ও প্রশাসকের সংখ্যা ছিল অনেক। চাকরিকালে বিশেষায়িত দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকাারবদ্ধ থাকলেও অনেকে দলীয় কর্মীর ভূমিকা পালন করেছেন। প্রশাসনে নির্দিষ্ট একটি কাজের জন্য নিয়োজিত থেকে সে বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের বদলে তৈলমর্দন ও মোসাহেবির প্রতিযোগিতা করে নিজেদের আখের গুছিয়েছিলেন অনেকেই; অসাংবিধানিক ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব তারা মোটেও উপেক্ষা করতে পারেননি। বরং ব্যক্তিগত/দলীয়/আত্মীয়তা/আঞ্চলিকতার অনুভূতি বা সম্পর্ককে অর্পিত দায়িত্বের উপর স্থান দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার শর্ত ও শপথ ভঙ্গ করে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে পিছপা হননি।
ওয়েবার মনে করতেন, আধুনিক সমাজে আমলাতন্ত্র একটি ‘সর্বাধিক কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা’। কারণ এটি দক্ষতা, নিরপেক্ষতা এবং পূর্বনির্ধারিত নিয়মের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যে বিকশিত ধামাধরা আমলাতন্ত্র ‘সর্বাধিক কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা’ হওয়ার বদলে ‘সর্বাধিক কার্যকর তাঁবেদার ও ধামাধরা ব্যবস্থা’য় রূপান্তরিত হয়েছে। যে কারণে রাজনৈতিক সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনে উলটপালট শুরু হয়। প্রজাতন্ত্রের আইনানুগ ও স্থায়ী কর্মচারীর নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে না পারায় অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের অনুগমন করে পলায়ন করেছেন বা জেলে গিয়েছেন। আরেক দল বঞ্চিত হওয়ার দাবি করে সবকিছু দখল করে নিতে সচেষ্ট হয়। এতে আমলাতন্ত্র নামক নিরপেক্ষ ব্যবস্থার নিরপেক্ষকতা, স্থায়িত্ব, দক্ষতা এবং চেইন অব কমান্ড বিনষ্ট হয়। সরকারি চাকরিবিধির নিয়মকানুন কেউই আর পরোয়া করেন না। এরই ধারাবাহিকতায় সচিবালয়ও আন্দোলন ও দাবি আদায়ের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সন্দেহ নেই, আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকীকরণ ও দলীয়করণের কারণে পুরো ব্যবস্থার অবক্ষয়ের পাশাপাশি বহু যোগ্য, দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীও বঞ্চিত হন। সঠিক নিরীক্ষা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে তাদের ন্যায়বিচার প্রদান করা অবশ্যই কর্তব্য। কিন্তু ক্ষমতা বদলের সুযোগে দলবদ্ধ হয়ে প্রশাসনের ভেতরে সুপ্ত ক্যু করে সবকিছু দখলে নেওয়া মোটেও কাম্য নয়। এতে প্রশাসনিক কাঠামো আরও নাজুক হবে। পুরো ব্যবস্থা আরও ভঙ্গুর হবে। আমলাদের স্বচ্ছ অবস্থান আরও কোণঠাসা হবে।
১/১১-এর পরিবর্তনের পরও এমন অরাজকতা প্রশাসনে শুরু হয়েছিল। চাপ প্রয়োগ করে যে যেভাবে পেরেছেন, পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন নিতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় আমি নিজে সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এসব কাজের বৈধতার প্রশ্ন তুলে একটি রিট করেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ অ্যাকাডেমিক। আমি বলতে চেষ্টা করেছিলাম, এসব কাজ স্থায়ী ভিত্তিতে হওয়া দরকার। এবং প্রশাসনের ভেতরেই ক্ষোভ ও বঞ্চনা নিরসনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা দরকার। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই দলীয় চাপে ঢালাও পরিবর্তন করতে শুরু করলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে এবং একটি দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণের স্থলে আরেকটি দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণের সূত্রপাত হতে পারে, যা নিরপেক্ষ, আইনানুগ ও নৈর্ব্যক্তিক প্রশাসনের জন্য মারাত্মক বিপদের কারণ হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে।
বাস্তবে হয়েছেও তাই। এবারও সরকার বদলের পর প্রকৃত যোগ্যদের বঞ্চনার অবসানের সূত্র ধরে দলে দলে অনেকেই সুযোগ নিতে চেষ্টা করছেন। প্রকাশ্যেই অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের শূন্যস্থানে বিএনপি বা জামায়াতের লোকজন যার যার সুযোগ ও সুবিধামতো প্রশাসন দখল করেছে। এসব প্রশাসনিক কর্তা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সরকারি প্রশাসনে নিজ নিজ দলের লোকদের নিয়োগদানেও সচেষ্ট হয়েছেন। এতে বর্তমান সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিএনপি বা জামায়াত, যারা এই সরকারের প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন দাবি দলগুলোর তরফে যেসব নেতা করছেন, তারা মিথ্যা ভাষ্য দিচ্ছেন। বাস্তবে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, পতিত আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের লোকজনই প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন অ্যাকাডেমি ও অধিদপ্তর দখল করে বসেছেন। অতীতে আমলাদের দলবদ্ধ গোষ্ঠীবাদী চাপ যেমনভাবে পদোন্নতি ও পদায়ন দিতে বাধ্য করেছিল, এখনো তেমন চাপাচাপি চলছে। সচিবালয়ের ভেতরে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারী ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা।
সচিবালয় হলো দেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ও চালিকাশক্তি, যেখানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ধরনের স্থানে বিক্ষোভ বা আন্দোলনের বিষয়টি নিঃসন্দেহে স্পর্শকাতর ও উদ্বেগের। বিক্ষোভকারীদের দাবি বা অভিযোগ যাই হোক না কেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমায়েত ও প্রতিবাদ স্বাভাবিক প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটানোর পাশাপাশি সাধারণ জনমনে ভুল বার্তা দিতে পারে। নানা কারণে আন্দোলনে ইচ্ছুক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এসব ঘটনায় প্রলুব্ধ হয়ে মাঠেও নামতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আচরণে নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত যেমন থাকবে, তেমনিভাবে শান্তিপূর্ণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক আচরণের প্রকাশও থাকতে হবে।
বারবার প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পেছনে রাজনীতিকীকরণ ও দলীয়করণের কুপ্রভাবকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ সমস্যার সমাধানে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিশুদ্ধ পেশাদারত্বের বিষয়গুলোকে নিশ্চিত করা। অতীতে হয়নি বলে বর্তমানেও পেশাদারত্ব ও দক্ষতাকে এড়িয়ে পছন্দের লোকজনকে জোরপূর্বক টেনে তুললে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। বর্তমান সরকারের অনুগ্রহে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থায় পদায়ন পাওয়া লোকজনও যদি পেশাদারত্ব, দক্ষতা ও আইনের বিধান অনুসরণের বদলে অতীতের মতো তাঁবেদারির মাধ্যমে নিজের সুবিধা হাসিলের চেষ্টায় থাকেন, তাহলে বিশৃঙ্খলা বাড়তে বাড়তে তা নৈরাজ্যের দিকে চলে যাবে। প্রশাসনের মতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিদপ্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেকের অযোগ্যতার কারণে তেমন আলামতও দেখা যাচ্ছে। ফলে সরকার পরিবর্তনের সুযোগে নানাভাবে পদ বাগানো অযোগ্যদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করাও জরুরি। ট্র্যাক রেকর্ডে বিন্দুমাত্র প্রশাসনিক দক্ষতার চিহ্ন কিংবা সাকসেস স্টোরি নেই, এমন ব্যক্তিও নানা পদে আসীন হওয়ায় তারা অব্যাহতভাবে অযোগ্যতার ছাপ রাখছেন কিংবা অতীতের মতো দলীয়করণ করে ব্যক্তিগত ও আর্থিক স্বার্থ হাসিল করছেন। এদের বিষয়ে উদাসীন থেকে সংস্কার বা স্থিতিশীলতা, কোনোটিই সম্ভব হবে না।
এ কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকার যে, অতীতের পর্যায়ক্রমিক ভুল পদক্ষেপে দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণ বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষা, প্রশাসনে এতটাই শক্তিশালী হয়েছে যে, চট করে এটি দূর করা প্রায় অসম্ভব বিষয়। কেননা শিক্ষক, প্রশাসক, ডাক্তার, সাংবাদিক তথা প্রায় প্রতিটি পেশাই রাজনীতি ও দলীয় প্রভাবে চরমভাবে আক্রান্ত। কতিপয়ের সুবিধার জন্য অতীতে অব্যাহতভাবে পুরো পেশাকেই দলীয় রাজনীতির বৃত্তে ঠেলে দিয়ে অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এসব সুবিধাবাদী চক্র হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। বরং তারা সুযোগের সন্ধানে রয়েছেন মাত্র।
রাজনৈতিক চরিত্র বদল করে দলীয় সুবিধা নেওয়ার জন্য তারা নানাভাবে চেষ্টা-তদবিরও চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক স্থানে বর্তমান সরকার ও প্রশাসনের নানা পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে এসব লোকজন মিশে গেছেন এবং এদের মিলিত দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গেছে। সন্তর্পণে দলীয়করণ ও রাজনীতিকীকরণের মচ্ছব এবং নানা ধরনের দুর্নীতি চলছেই। পার্থক্য একটাই, কোথাও শক্তি বেশি হওয়ায় একদল বেশি সুযোগ নিচ্ছে, কোথাও আরেক দলের শক্তি বেশি হওয়ায় তারা সুযোগ বেশি নিয়ে নিচ্ছে। এসব সুযোগের মধ্যে দুর্নীতির উপাদানও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
ঘটনা আগে যা ছিল আওয়ামী লীগের নামে, এখন তা হচ্ছে অন্য দলের নামে, পার্থক্য এতটুকুই। ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে পেশাদারত্ব এনে দলীয় রাজনীতির দুষ্টচক্র ও দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং অতীতের ঘূর্ণাবর্ত দেখে জনমনে হতাশারই বিস্তার ঘটছে। আমি নিজে, জুলাই বিপ্লব নিয়ে সর্বপ্রথম রচিত বইটি (Student Protest and Fall of government, Dhaka: Student Ways, August, 2024) প্রকাশকালে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি যে, মাত্র নয় মাসের মধ্যে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে পেশাদারত্বের অবক্ষয়ের কারণে রাজনীতিকীকরণ, দলীয়করণ ও দুর্নীতি নিয়ে আগের মতো আবার উদ্বিগ্ন হতে হবে।
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়