প্রশাসনে কেন এত ক্যাডারের প্রয়োজন
রফিকুল ইসলাম সবুজ [সূত্র : সময়ের আলো, ১ জুন, ২০২৫]

দেশে জনপ্রশাসনের জন্য ক্যাডারের সংখ্যা ২৬টি। এর মধ্যে ১০টি সাধারণ ক্যাডার, পাঁচটি সাধারণ ও কারিগরি বা পেশাগত এবং ১১টি ক্যাডার পুরোপুরি কারিগরি ও পেশাগত। চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরাই কেবল কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারে যেতে পারেন। বাংলাদেশের মতো এত বেশি ক্যাডার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই দাবি করে ক্যাডার ও মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ এসেছে বিভিন্ন সময়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
সম্প্রতি আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিদ্যমান ২৬টি ক্যাডারকে কমিয়ে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় বিদ্যমান একীভূত ‘ক্যাডার সার্ভিস’ বাতিল করে সাধারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা আলাদা পিএসসি গঠনের সুপারিশও করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন বিশ্লেষকরা বলছেন এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের পাশাপাশি বিশেষায়িত জনবল গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাদের মতে, অনেক ক্যাডার রয়েছে যেগুলোর তেমন কোনো প্রয়োজনই নেই। তাই ক্যাডার সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করা উচিত।
সরকারি কর্মকর্তাদের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে ‘প্রশাসন ক্যাডার’ ছাড়া বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতির ক্ষেত্রে কম-বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অভিযোগ তুলে ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’ দাবিতে আন্দোলন করছেন কয়েক মাস ধরে। ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা শূন্য পদে পদোন্নতি না পেলেও প্রশাসন ক্যাডারে পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ায় ক্ষোভ বেড়েছে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাই বৈষম্যহীন, জনবান্ধব ও কল্যাণমূলক সিভিল সার্ভিস গঠনে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের দাবিতে কলম বিরতিসহ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। স্ব স্ব ক্যাডারের কর্মকর্তারা যাতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর শীর্ষ পদে যেতে পারেন, সেই সুযোগ নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছেন তারা।
মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) করার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ছাড়া বাকি সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির পরীক্ষার জন্য একটি পিএসসি থাকবে। এর নাম হবে পিএসসি (সাধারণ)। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য পৃথক দুটি পিএসসি করার সুপারিশ করেছে। সংস্কার কমিশন ক্যাডারগুলোকে ১৩টি সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো- প্রশাসনিক সার্ভিস, বিচারিক সার্ভিস, জননিরাপত্তা সার্ভিস, পররাষ্ট্র সার্ভিস, হিসাব সার্ভিস, নিরীক্ষা সার্ভিস, রাজস্ব সার্ভিস, প্রকৌশল সার্ভিস, শিক্ষা সার্ভিস, স্বাস্থ্য সার্ভিস, কৃষি সার্ভিস, তথ্য সার্ভিস এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান কিছু ক্যাডার এসব সার্ভিসে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন- বিসিএস খাদ্য ও সমবায়কে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিসের (বর্তমানের প্রশাসন ক্যাডার) সঙ্গে এবং এলজিইডি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে কর্মরত প্রকৌশলীদের ‘প্রকৌশল সার্ভিস’ হিসেবে একীভূতের সুপারিশ করা হয়েছে।
সাবেক ও বর্তমান একাধিক সচিব বলেন, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে সচিবালয়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিভাবান কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণের পাশাপাশি বিশেষায়িত জনবল গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আর এটা করা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে চিকিৎসা ও প্রকৌশলবিদ্যার মতো বিশেষায়িত বিষয়ে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত ক্যাডারের পরিবর্তে সুযোগ-সুবিধা বেশি পাওয়ার আশায় প্রশাসন ক্যাডারে চলে যাবে। এতে সংকট তৈরি হবে।
তারা বলেন, দেশে ২৬টা ক্যাডারের মধ্যে এমন কিছু ক্যাডার রয়েছে যেগুলো না থাকলেও চলবে। কারণ ভারত ও পাকিস্তানে মাত্র কয়েকটি ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে। ভারতের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা ইউপিএসসি পরীক্ষা হয় তিনটি পর্বে। এ পরীক্ষার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস), ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (আইএফএস), ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাকিস্তান ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস, পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস ও পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসসহ ১২টি সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, পৃথিবীর সব জায়গায়ই একেকটা সার্ভিসের ধরন ও সুযোগ-সুবিধা স্বতন্ত্র। যেমন-উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের চাকরি শতভাগই স্বতন্ত্র বা স্বশাসিত স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের সামাজিক সম্মান আকাশচুম্বী। তারা স্বীয় কর্ম দিয়ে সেটা অর্জন করেন। আর পলিসি লেভেলের পদগুলো প্রশাসনের। সিঙ্গাপুর, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের, যুক্তরাজ্যে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্লাসের, কানাডায় ও অস্ট্রেলিয়ায় এক্সিকিউটিভ ক্লাসের, যুক্তরাষ্ট্রে ক্লাসিফাইড সিভিল সার্ভেন্টের। সেখানে এক গ্রুপের কাজ, বেতন ইত্যাদি নিয়ে আরেক গ্রুপের মাথাব্যথা নেই। সেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আছে, যা আমাদের মধ্যে নেই। তার মতে, বিসিএস পরীক্ষার মান আরও কঠিন হওয়া উচিত। চার-পাঁচ বছর ধরে সস্তা নোট বই মুখস্থ করে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে সিভিল সার্ভিসে আসাও ভালো লক্ষণ নয়।
সাবেক এই সচিব বলেন, প্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর সবকিছু বর্তমান সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। হয়তো যেটুকু সম্ভব সেটা তারা এখন করবে। আর বাকিটা রাজনৈতিক সরকার এলে তাদের ওপর নির্ভর করবে। অতীতেও এ রকম বহু কমিশন হয়েছে, কিন্তু প্রতিবেদন সরকার বাস্তবায়ন করেনি।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেহসান ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া কোনো উন্নত রাষ্ট্রেই ক্যাডার প্রথা নেই। জনপ্রশাসনে ক্যাডার প্রথাই জনমানসে বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এ কারণে এ প্রথা বাতিল করতে হবে। জনপ্রশাসনের সব সার্ভিসই গুরুত্বপূর্ণ।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কমিশনের সুপারিশের আলোকে বড় পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। তবে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের উচিত হবে একটি স্বাধীন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র তৈরি করা। ভারত ও পাকিস্তানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডারের লোক। সেখানে কোনো সমস্যা হয় না। তার মতে, মাঠপর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা আর কোনো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদ এক নয়। স্বাস্থ্য সচিবকে ডাক্তার হতে হয় না। তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজে দক্ষ কি না, সেটাই দেখা হয়।
ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে কোনো কৃষি কর্মকর্তা কৃষি সচিব হন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবও আসেন প্রশাসন থেকে।