কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

প্রথমে স্থানীয় নাকি জাতীয় নির্বাচন

হোসেন আবদুল মান্নান । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ০৪ মার্চ ২০২৫

প্রথমে স্থানীয় নাকি জাতীয় নির্বাচন

এ মুহূর্তে দেশে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্থাৎ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। এর জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সম্ভাব্য ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও ধরা হয়েছে বলে জানা যায়। নির্বাচন কবে হবে তারও একটা ধারণাও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। সুশীল সমাজের প্রত্যাশা রয়েছে নির্বাচন দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হোক। তাছাড়া নির্বাচন প্রশ্নে তৎপর অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মধ্যে অবিরাম কানাঘুষা, সন্দেহ প্রকাশসূচক বক্তব্য, সরকারের বিরুদ্ধে কটূক্তি ইত্যাদি চলমান আছে। এমনকি ঈদের পর জোরালো আন্দোলনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। বোঝা যায়, তারা মূলত বর্তমান সরকারকে চাপে রাখার জন্যই কৌশল হিসেবে তা নিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে আশার বাণী শুনিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেছেন, ‘ডিসেম্বরকে টার্গেট ধরে ইসি কাজ করে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গকারী এক ঐতিহাসিক নির্বাচন।’ একটি সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য তিনি সকল প্রকার প্রস্তুতি হাতে নেবেন।

 

 

সরকার এবং কতিপয় রাজনৈতিক দলের (ডান-বাম) দাবি হলো বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। সংস্কার অর্থে তারা বিগত সরকারের সময়ের গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ চায় এবং এর পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। এ অংশেরই দাবি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসমূহ সম্পন্ন করতে হবে। তাদের স্পষ্ট দাবি, স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে দল ও রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবমুক্ত হবে এবং সৎ, যোগ্য, জনপ্রিয় মানুষ নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবে। 

 

এর ফলে এমপি, মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজন জোরজবরদস্তি করে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। তখনই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হবেন দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে নির্দলীয় মানসিকতাসম্পন্ন। যারা স্থানীয় সরকারে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন তথা জনসেবা করতে সক্ষম হবেন। একই সঙ্গে তারা মনে করে, এর ফলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা অতিরিক্ত সময় পাবে, যার মাধ্যমে চলমান সংস্কার কার্যক্রমও একটা যৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। যদিও বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর মত ভিন্ন। তারা মনে করে, কোনো অজুহাতে সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হলে তাদের দলীয় বা জোটের পক্ষে ভোটের পাল্লা ক্রমে হালকা হতে পারে। নির্বাচন এ বছরের মধ্যে হলে তারা সরকারে যাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। তারা চায় মাঠের রাজনীতি উত্তেজনায় রেখে নির্বাচনী বৈতরণি অতিক্রম করতে। না হলে তারা ভোটের রাজনীতি ও অঙ্কে পিছিয়ে যাবে। এমনকি তাদের কর্মীদের এখনকার উদ্দীপনা ও তৎপরতা নেতিয়ে পড়তে পারে।

 

 

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনদিন নাজুক হয়ে উঠছে। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি শহর থেকে গ্রামে বিস্তৃতি লাভ করে চলেছে অকল্পনীয় হারে। দেশব্যাপী পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব পালনে অনেকটা গতানুগতিকতা লক্ষণীয়। মাঠে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিও এদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। ফলে সম্প্রতি সেনাপ্রধান দলগুলোর মধ্যে কলহ ও কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে ধৈর্য ধরে সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন সতর্ক হোন, সতর্ক করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী দেশের সার্বিক অবস্থার ওপর নজর রাখছে। রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের  বাড়াবাড়ি না করার জন্যও অনুরোধ করেছেন তিনি। একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত একে অন্যকে দোষারোপ না করে সবাইকে দেশের পক্ষে দাঁড়াতে আহ্বান জানিয়েছেন। সেনাপ্রধানের সর্বশেষ বক্তব্য সাধারণ মানুষের কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে। কারণ তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। দিন শেষে সাধারণ মানুষও শান্তি চায়। এমনকি মানুষ উন্নয়নের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রেখে জননিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়ার পক্ষে। আর এ ক্ষেত্রে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বরাবরই রাষ্ট্রের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।

 

 

দেশে বর্তমান সময়ের শীর্ষ আলোচনা হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠান প্রয়োজন? এর পেছনের মূল কারণ হলো, অতীতের বিভিন্ন সরকারের সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা। দেখা গেছে, কোনো নির্বাচনী এলাকার একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তার এক ভাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাগনে পৌরমেয়র আর একই পরিবারের একাধিক আত্মীয় বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে এমপির অসীম ক্ষমতা বহাল আছে। ফলে তারা এমপির মেয়াদকাল অবধি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে স্থানীয় প্রশাসন, থানা পুলিশ, স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি, হাওর-বাঁওড়, বালু উত্তোলন, মাদক, চাঁদাবাজি ইত্যাদির ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব বিস্তার করে চলে। বিরোধী মত-পথের কোনো তোয়াক্কা না করেই তারা জনগণের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষও তা প্রতিবাদহীন চোখ বুজে সহ্য করেছে। এসবের চির অবসানের নিমিত্ত বা এমন সুপ্ত বাসনা থেকেই সাধারণ মানুষ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায়।

 

 

তবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন হলে স্থানীয় সরকারের আওতায় জেলা পরিষদের ৬৪ জেলা, প্রায় ৫০০ উপজেলা, ১২ সিটি করপোরেশন, ৩৩০ পৌরসভা এবং ৪ হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করা অসম্ভব। তা ছাড়া নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন। সরকারের বাজেট বরাদ্দ, ব্যালট পেপার ছাপানোসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম অতীব ব্যয়বহুল বিষয়। বলাবাহুল্য, অসংখ্য পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা বা ইউনিয়নের সীমানা জটিলতা নিয়ে বা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে এমনকি দুর্নীতিসংক্রান্ত নানাবিধ মোকদ্দমা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। যার নিষ্পত্তি ও মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত একসঙ্গে নির্বাচন করা যাচ্ছে না। এসব বিষয়ও সরকারের একান্ত সদিচ্ছার বিপক্ষে বড় চ্যালেঞ্জস্বরূপ। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ছাড়া স্থানীয় সরকারের সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।

 

 

দেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় শতকরা ৯০ জন মানুষের প্রত্যাশা হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে নজিরবিহীনভাবে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও দলনিরপেক্ষ পরিবেশে। যে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে লাখ লাখ নতুন প্রজন্মের ভোটার। ভোট নিয়ে গণমানুষের হতাশা ও আফসোস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটা ঐতিহাসিক গণভোট আয়োজন এবং সম্পন্ন করার বাইরে অন্য কোনো বিকল্প নেই। যার দায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায়। সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে কোন মাপকাঠিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে। ভবিষ্যতের বিতর্ক এড়িয়ে চলার লক্ষ্যে সরকারকে শতভাগ নিরপেক্ষতা ও লেভেল-প্লেয়িং-ফিল্ড সৃষ্টি করে দিতে হবে। অন্যথায় পুনরায় অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হবে দেশ। মানুষের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের পথে নেমে আসবে ঘোর অমানিশার থাবা। কাজেই একটা ইতিহাস সৃষ্টিকারী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ সরকারকেই নতুন ইতিহাস গড়তে হবে। এটাই বর্তমান সরকারের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব।

 

  • গল্পকার ও কলাম লেখক