কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মহাবিপৎসংকেত

আব্দুল বায়েস । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মহাবিপৎসংকেত

ইদানীং আমাদের মাথায় প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। এবং চলাটাই স্বাভাবিক, বিশেষত তাদের জন্য, যারা চোখ-কান খোলা রেখে বিশ্ব তথা বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার অবকাশ খোঁজে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ভয় থাকার কথা নয়—কারণ প্রযুক্তি মানে মুক্তি এবং আমরা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন চাই। ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা বিশ্ব চাই। কিন্তু ইদানীং স্বস্তির গায়ে যেন আগুন ধরিয়েছে ‘রোবট’ নামক প্রযুক্তি। রোবট নিয়ে দু-একটি কথাবার্তা অতীতে শুনেছি, কিন্তু সেটি যে সুনামির মতো তেড়ে আসবে, তা কখনো ভাবিনি। অনেকটা অচেতন ছিলাম!

 

 

 

দুই.

এটি আজ সুবিদিত যে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ ভালো করছে। পোশাকশিল্প ও রেমিট্যান্স বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিক সূত্র অনুসারে, প্রধানত উদ্বৃত্ত শ্রম উৎসারিত কম মজুরির কারণে এই দুটিতে বাংলাদেশের আপেক্ষিক সুবিধা ‘আপাতত’ সবচেয়ে বেশি। এখানকার শ্রমের দাম যেমন অন্য দেশের তুলনায় কম, তেমনি শ্রমঘন তৈরি পোশাকের দামও কম। গেল কয়েক দশকে বিদেশিরা বাংলাদেশের সস্তা শ্রম ব্যবহার করে তাদের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করেছে আর সস্তার তৈরি পোশাক আমদানি করে ভোগ-চাহিদা মেটাচ্ছে। মোটকথা, গেল কয়েক দশকের উন্নয়নে অবদান রেখেছে এ দেশের সস্তা শ্রম, যেখানে প্রায় ৫০ লাখ মহিলা কর্মী তৈরি পোশাক শিল্পে জড়িত এবং বিদেশে কর্মরত শ্রম থেকে অর্থপ্রবাহ বার্ষিক প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার।

 

 

 

তিন.

কিন্তু যাত্রাটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বাঁকে বাঁকে বাধা। যদি এমন কম দামে ও কম মজুরিতে শ্রম ও পণ্য সরবরাহ করার প্রতিযোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় অথবা উৎপাদন সংগঠনে অটোমেশন প্রাধান্য পায় কিংবা দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশ বিরাট ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংরক্ষিত বাণিজ্য ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাব এবং বৈশ্বিক গোলমেলে পরিস্থিতি বাংলাদেশের অবস্থাকে আরো নাজুক করে তুলতে পারে। এমনিতেই অনেক আগে থেকেই আপেক্ষিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মহাবিপত্সংকেতসুবিধা সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে বাংলাদেশ।

 

 

 

যেমন—গোচারণ ভূমির অভাবে দুগ্ধজাত পণ্য কিংবা গোমাংস উৎপাদনে নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের প্রতিযোগী হয়ে ওঠা বেশ কঠিন। বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রচুর অবকাশ আছে। স্টিফেন হকিংয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি যেন সেই চিন্তার ক্ষেত্রকে আরেকটু বেশি প্রসারিত করে। কারখানায় ব্যবহৃত স্বতঃশ্চল মূর্তি বা ‘রোবট’ নাকি এরই মধ্যে প্রথাগত ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে বিপুলভাবে চাকরি ধ্বংস করেছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তির উত্থান এই ধ্বংসযজ্ঞ এমন গভীরে নিয়ে যাবে যে তখন শুধু পরিচর্যা বা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাজ সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত টেনে বলা চলে, এমনকি ১৯৯০ সালেও কেউ কি কল্পনা করেছে যে পকেটে এমন একটি যন্ত্র থাকবে, যা দিয়ে কথা বলা, ছবি তোলা, এমনকি টিভি দেখা যাবে? এরপর এমন কী আসছে, যা আমরা প্রক্ষেপণ করতে অপারঙ্গম? অনেকে বলেছে যে আমরা প্রায় অন্য এক শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত, যার উৎস হলো প্রযুক্তিগত প্রগতি, তথ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তি ও রোবটিকস। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এরা কচ্ছপগতিতে এগোচ্ছে, কিন্তু কী হবে যদি এরা খরগোশের মতো দৌড়াতে থাকে কিংবা ‘সুনামি’র মতো হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই আঘাত করে? প্রশ্ন উঠছে আগামী বিশ্বে শ্রমিকের দক্ষতার ধরন নিয়েও। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস ফোরামের কিছুকাল আগের এক প্রক্ষেপণ বলছে, আজ যে শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ ভবিষ্যতে এমন কাজে যোগ দেবে, যে কাজের বর্তমান কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, যাকে বলে জবলেস ইকোনমি!

 

 

 

চার.

এতক্ষণ ধরে দেওয়া বক্তব্য অন্তত আমার কাছে কিছুটা তাত্ত্বিক বলে মনে হয়েছে এবং সম্ভবত সেটা পাঠকের কাছেও। তা ছাড়া ‘যখন আসবে, তখন দেখা যাবে’ জাতীয় মনোভাব থেকে কিছুটা স্বস্তি বোধ করাও স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অবকাশ না দিয়েই বলতে হয় যে এই পরিবর্তনগুলো খুব কাছেই ঘটছে এবং খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে ঢুকে যেতে পারে, তখন ১০ নম্বর না হোক, অন্তত ৫ নম্বর ‘বিপত্সংকেতের’ কথা শুনে কিছুটা হলেও পিলে তো চমকাবেই। ‘১০ নম্বর বিপত্সংকেত’ সংক্রান্ত একটি উদ্বেগজনক উদাহরণ দেওয়া যাক। কিছুদিন আগের কথা, ডনগুয়ান নামে হংকংয়ের একটি কম্পানি সম্প্রতি প্রথম স্বতোনিয়ন্ত্রিত (অটোমেটেড) কারখানা চালু করেছে। কারখানাটি মূলত মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ তৈরি করে। একসময় এই কারখানায় ৬৫০ জন মানুষ কাজ করত, অথচ এখন মাত্র ৩০ জন কাজ করে। মানুষের জায়গা নিয়েছে ৬০টি রোবটের হাত, যা ১০টি উৎপাদন সারিতে কাজ করে এবং দৈনিক ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাত দিন। প্রতিটি উৎপাদন সারিতে তিনজন মানুষ রোবট মনিটর করে মাত্র। ওই কারখানাটি ৯৫ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করে মানুষের কাজ মেশিনের হাতে তুলে দিয়েছে বলে এর চাকরির মাত্রা হ্রাস পেয়েছে ৪০০ শতাংশ এবং উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। অর্থাৎ কম মানুষ, কম অপচয় অথচ বেশি উৎপাদন। মনে রাখা দরকার যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি না, যেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং শ্রমিক গড়পড়তা ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩০ ডলার অর্জন করে; আমরা বলছি চীনের কথা, যে কারখানার একজন শ্রমিক পায় গড়পড়তা ঘণ্টায় দুই ডলার (বাংলাদেশে বড়জোর ৭০ সেন্ট)। উত্কণ্ঠিতভাবে অনেক ক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতে প্রযুক্তি যেসব কাজ মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেবে, সেগুলো বর্তমানে নিম্ন অথবা আধাদক্ষ শ্রমিকের কাজ। অনুমান করা যায় যে দিন যত যাবে, ততই এমনকি সৃজনশীল, তত্ত্বাবধায়ক ও পরিচর্যামূলক কাজের জন্যও কঠিন প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।

এদিকে একদিন এক পত্রিকার পাতা খুলেই চোখ যেন চড়কগাছ। এক নিবন্ধকার বলছেন, ভবিষ্যতে কারখানায় দুজন কর্মসংস্থান পাবে একজন মানুষ ও অপরটি কুকুর। মানুষের কাজ হবে কুকুরকে খাওয়ানো আর কুকুরের কাজ হবে মানুষ যাতে রোবট বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের উৎপাদন নষ্ট করতে না পারে সেদিকটিতে লক্ষ রাখা। এটি হলো ১০ নম্বর বিপত্সংকেত।

 

 

পাঁচ.

‘কিপিং আপ উইথ রোবটস’ (রোবটের সঙ্গে বসবাস) অরিজিত চক্রবর্তীর লেখা এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় লাখ লাখ রোবট বিভিন্ন কারখানায় নিয়োজিত এবং এদের সংখ্যা বাড়ছে। ভয়ংকর সংবাদ হচ্ছে এই যে এদের প্রভাবের বলয় ম্যানুফ্যাকচারিং গণ্ডি পেরিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন, খদ্দের সেবা, বিক্রি, এমনকি স্বাস্থ্যসেবায় চলে আসতে আরম্ভ করেছে। সুতরাং রোবট মানবসম্পদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হুমকি কি না সে দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ তো পড়তেই পারে। অবশ্য একদল মনে করে যে রোবটের আবির্ভাব উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং বর্তমান বিশ্ব চায় উচ্চতর উৎপাদনশীলতা। এমনকি এই বাংলাদেশেও বস্ত্র ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে আজ না হয় কাল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে রোবটের আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতাসম্পন্ন হতে হলে এর বিকল্প নেই বলেও অনেকের ধারণা। অরিজিত চক্রবর্তীর নিবন্ধ বলছে, আগামী বছরগুলোতে ম্যানুফ্যাকচারিং ও প্রডাকশনে রোবটের ব্যবহার বর্তমান ৪০ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। গবেষণা ও উন্নয়নে ১১ থেকে ২৩, আইটিতে ৯ থেকে ৩১, কাস্টমার সার্ভিস ৮ থেকে ২৪, বিক্রিতে ৬ থেকে ২০ শতাংশ এবং বাজারজাতকরণে ৩ থেকে ১৩ শতাংশ কাজ করবে রোবট। লেখকের ধারণা, অচিরেই বাংলাদেশে বস্ত্র খাতে রোবট একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে এমন খবর অস্বাভাবিক কিছু নয়।

 

 

ছয়.

অন্য একটি নিবন্ধের প্রতি আমাদের দৃষ্টি যায়, যার সারমর্ম হচ্ছে ‘স্মার্টফোন মানে কোকেইন’! মোবাইল ফোন প্রযুক্তি যে আমাদের কত উপকার করেছে, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু সেই মোবাইল ফোন যে কত ক্ষতি করছে, তা উঠে এসেছে একটি অনলাইন নিবন্ধে। নেশা নিরাময়কারী এক থেরাপিস্ট মনে করেন, স্কুলে যাওয়া শিশুর হাতে একটি স্মার্টফোন দেওয়া মানে তার হাতে এক গ্রাম কোকেইন তুলে দেওয়া। লন্ডনে শিক্ষাসংক্রান্ত এক সম্মেলনের ধারণা, স্নেপচ্যাট ও ইনস্টগ্রামের মাধ্যমে সংবাদ বিনিময়ে যে সময় ব্যয় হয়, তা মদ ও গাঁজার মতো নেশাজাতীয় পণ্য।

 

 

‘আমি সব সময় বলে থাকি, যখন আপনি আপনার শিশুকে একটি ট্যাবলেট বা ফোন দিচ্ছেন, প্রকৃতপক্ষে আপনি তাকে এক বোতল মদ বা এক গ্রাম কোক দিচ্ছেন’—বলেছেন হার্লি স্ট্রিট পুনর্বাসন কেন্দ্রের মান্ডি সেলিগারি। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় এক হাজার ৫০০ শিক্ষকের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মনে করে, তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যৌনবিষয়ক কথাবার্তা বিনিময় করে এবং তাদের ছয়জনের মধ্যে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। গেল বছরগুলোতে দুই হাজার শিশুকে পুলিশ ধরেছে, যারা পর্ন ছবির সঙ্গে যুক্ত অপরাধে অপরাধী। অনেক যুবতী মনে করে, তাদের নগ্ন ছবি বিনিময় করা ন্যায়সংগত কাজ এবং এটি তখনই অন্যায় কাজ, যখন মা-বাবা বা অভিভাবক এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা যে করা হয় না, তা নয়, তবে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের অভিভাবকদের ১০ জনের মধ্যে চারজন এ ক্ষেত্রে নিদারুণ ব্যর্থ হন।

 

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়