প্রযুক্তির যুগে ডাটা সেন্টার
মো. জাহিদুল ইসলাম। প্রকাশিত: দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

ইন্টারনেট হলো একটি বিশাল বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে একসঙ্গে বিভিন্ন কম্পিউটার, সার্ভার এবং নেটওয়ার্ক ডিভাইসসমূহ সংযুক্ত থাকে। ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তথ্য আদান-প্রদান করে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ স্থাপনের আশপাশে পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সেবা গ্রহণ করতে পারে। আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও স্ট্রিমিং, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ও মেইল আদান প্রদান যাই করি না কেন, তার মূল শক্তি হলো ডাটা সেন্টার। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ডাটা সেন্টার হলো তথ্যকেন্দ্র। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অনেক ডাটা জমা হওয়ার যে প্রক্রিয়া, তাকে সাধারণ অর্থে ডাটা সেন্টার বলে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনায় ডাটা সেন্টার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ডাটা সেন্টার হলো একটি নির্দিষ্ট স্থান (বিল্ডিং অথবা জায়গা), যেখানে সার্ভার ও ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যমে ডাটা সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা হয়। একটি ডাটা সেন্টারে অনেক সার্ভার থাকে, যারা নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত। আমরা যখন ব্রাউজারে কোনো টজখ ((Uniform Resource Locator)- এ প্রবেশ করি তখন তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডাটা সেন্টারে প্রবেশ করে এবং সেখানে প্রসেস হয়ে আবার আমাদের কাছে চলে আসে। মূলত একের অধিক সার্ভার নিয়ে গঠিত হয় ডাটা সেন্টার। এই বিশাল পরিমাণ সার্ভার দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা (২৪/৭) নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখার জন্য অনেক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে স্থান বিবেচনা করা এবং অবকাঠামোর বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সার্ভার স্থাপনের জন্য সাধারণত এমন স্থান অথবা অবকাঠামো নির্বাচিত করা হয়, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা প্রায় ০% থেকে ৫%। কারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডাটা সেন্টারের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষতি সাধন করে থাকে। এছাড়া অনেক বড় জায়গা নিয়ে এর ভিত্তি থাকতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে চাহিদা মতো ডাটা সেন্টারের ক্যাপাসিটি বাড়ানো যায়।
ক্লাউড কম্পিউটিং আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষের সমস্ত কাজকর্ম আজ ইন্টারনেট ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদিতে ইন্টারনেটের আশ্চর্যজনক ছোঁয়া রয়েছে। দৈনন্দিন এসব কাজের পেছনে রয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রতিদিন শুধু ইউটিউবেই প্রায় চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ ঘণ্টার ভিডিও আপলোড করা হয়। বিশ্বের প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (চারশ’ কোটি) মানুষ প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাবে বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। এর ফলে, আড়াই মিলিয়ন টেরাবাইট নতুন তথ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। পুরনো তথ্যের সঙ্গে এই নতুন তথ্য রাখার জন্য প্রয়োজন বিশাল তথ্য ভা-ার বা ডেটা সেন্টার। বিশালাকার জায়গা জুড়ে শত শত সার্ভার নিয়ে তৈরি করা হয় একটি ডেটা সেন্টার। এদিকে ফেসবুক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি লোকের ডাটা সংরক্ষণ করে রাখে ফেসবুক। এছাড়াও প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিদিন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা টাইমলাইনে লেখা, ছবি, ভিডিও পোস্ট করেন, যা ডাটা হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এমনকি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যও সংরক্ষণে রাখে ফেসবুক। ব্যবহারকারীদের ডাটা সংরক্ষণ করতে অন্যান্য টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানের মতো বিভিন্ন দেশে অনেক ডাটা সেন্টার তৈরি করেছে ফেসবুক। ডাটা সেন্টার অনেক বড় একটি প্রোজেক্ট। ডাটা সেন্টারে সাধারণ থেকে অনেক হাই প্রোফাইল ডাটা স্টোর থাকে। যে ডাটাগুলো ডিলিট বা নষ্ট হয়ে গেলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ডাটাগুলো নিরাপদ রাখার জন্য অনলাইন এবং অফলাইন দুই ধরনের সিকিউরিটির ব্যবস্থা রাখা হয়ে থাকে। প্রতিটি ডাটা সেন্টারের প্রাণ হলো ডাটা। বর্তমান সময়ে সব থেকে রিলায়েবল ব্যাকআপ সিস্টেম হচ্ছে ক্লাউড। ডাটা সেন্টারে ডাটা সংরক্ষণ ও বিপণন করার জন্য পরিচালনা ব্যয় হিসেবে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। ইন্টারনেট পরিচালনা করতে গেলে এ সকল ডাটা সেন্টারের বিকল্প নেই। কারণ, ডাটা সেন্টার ছাড়া আমাদের ডাটা রাখা ও অ্যাক্সেস করার মতো সিকিউর পদ্ধতি নেই। অন্যদিকে, ডাটা সেন্টারগুলোয় ডাটা অনেক নিরাপদ ও ত্রুটিমুক্ত থাকে। শুধু তাই নয়, সেখানে ডাটার পর্যাপ্ত ব্যাকআপ থাকায় কোনো দুর্ঘটনায় ডাটা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে কম। একটি ডাটা সেন্টারের কাজ হলো, সার্ভারগুলোকে ৩৬৫ দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল থাকার জন্য পাওয়ার, নেটওয়ার্ক, সিকিউরিটি, কুলিং সিস্টেম এবং অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা। ডাটা সেন্টারের প্রধান কাজ হলো, ডাটা স্টোর করা এবং ইন্টারনেট সচল রাখা।
ডাটা সেন্টার মূলত একটি শীতল স্থান, যেখানে সার্ভারগুলোকে র্যাকের মধ্যে সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হয়। যাতে সার্ভারগুলো তাদের কার্যপ্রক্রিয়া একটি স্বাভাবিক তাপমাত্রার মধ্যে পরিচালনা করতে পারে। যেখানে সকল ধরনের ডাটা স্টোরেজ থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট, ব্যাকআপসহ যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা হয়। ডাটা সেন্টারে সাধারণত স্টোরেজ ডিভাইস, নেটওয়ার্কিং ডিভাইসসহ অন্য অনেক হার্ডওয়্যার ডিভাইস থাকে। প্রথমত, সার্ভারগুলো রেডি করার জন্য মাদারবোর্ড, প্রসেসর, র্যাম, স্টোরেজ ইত্যাদি সেটআপ করে নেওয়া হয়। পরে সেগুলো পর্যায়ক্রমে স্টোরেজ র্যাকগুলোতে সাজানো হয়। তারপর রাউটার, সুইচ, ফায়ারওয়ালসহ অন্যান্য নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশ দিয়ে সার্ভারগুলোকে ইন্টারলিঙ্কিং করে তা ইন্টারনেটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তখন গ্রাহকরা উক্ত সার্ভার স্পেস ব্যবহার করে সার্ভিস নিতে পারেন। প্রতিটি সার্ভারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ভিত্তিক নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কোনো ধরনের ঝামেলা বাদে সব সময় ইন্টারনেটের সঙ্গে কানেক্টেড রাখা হয়। প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা (টেম্পারেচার) মেইন্টেইন করা হয়। এ সকল কিছু সঠিকভাবে পরিচালনা করার পর তা প্রান্তিক পর্যায়ে কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ইন্টারনেট হলো ডাটা সেন্টারের হার্ট। ডাটা সেন্টারগুলোতে যে সার্ভার বসানো থাকে, সেগুলো থেকে ডাটা আদান-প্রদানসহ যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রয়োজন হলো ইন্টারনেট। আর এই ইন্টারনেট কানেক্ট করার জন্য ঝামেলাহীন একটি নেটওয়ার্কিং অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়