কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পশ্চিমা আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ব্রিকস

২২ থেকে ২৪ অক্টোবর রাশিয়ার কাজানে শুরু হতে যাচ্ছে ১৬তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। এবারের সম্মেলনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই জোটটি পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় নানাভাবে চেষ্টা করে চলেছে। অর্থনৈতিকভাবে সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার সুসম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।

পশ্চিমা আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ব্রিকস
এবারের সম্মেলনটি যে কারণে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে তা হচ্ছে, রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে ব্রিকসের অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক পরিসর অনেক বিস্তৃত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর আধিপত্যকে খর্ব করতে নানা রকম উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা তাসের এক সংবাদ বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে যে ব্রিকস মনে করছে, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন সম্পৃক্ততা তাদের জন্য বর্তমানে একটি বাড়তি বোঝার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় ব্রিকসের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে এবং বিশ্বব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটিয়ে আগামী দিনের বিশ্বের নেতৃত্বে চীন ও রাশিয়াকে অধিষ্ঠিত করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়।

 

ব্রিকসের যে ভৌগোলিক বিস্তৃতির কথা বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কিছুদিন আগে এর অন্যতম সদস্য ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ব্রিকসের সদস্য হতে ইচ্ছুক এমন রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ৪০-এ দাঁড়িয়েছে। ২০০৬ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন—এই চারটি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত ব্রিক  (BRIC) ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার যোগদানের মধ্য দিয়ে ব্রিকসে (BRICS) পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে অনেক ইচ্ছুক রাষ্ট্রের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর এ বছর জানুয়ারি মাসে মিসর, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইথিওপিয়া—এই পাঁচটি নতুন রাষ্ট্রের যোগদানের মধ্য দিয়ে এর পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ১০। সংগত কারণেই এবার এই সংস্থাটির সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে রাশিয়া এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই সম্মেলনে ২০০টির অধিক বিষয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

১০টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ৯টির শীর্ষ নেতৃত্ব, বাইরে আরো ১৪টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান এবং এর বাইরে আটটি দেশের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন, যার মধ্য দিয়ে ৩২টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ঘটছে এবারের সম্মেলনে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এবারের সম্মেলনে মোটামুটিভাবে সব মহাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় পশ্চিমাকেন্দ্রিক নেতৃত্বের জন্য এটি একটি দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। সব মিলিয়ে একটি বড় এবং বিশাল আয়োজন ঘটতে যাচ্ছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই সম্মেলন ঘিরে বাড়তি যেমন আয়োজন রয়েছে, তেমনি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারপ্রধানদের উপস্থিতির সুযোগ নেওয়ার এক ধরনের প্রচেষ্টা থাকবে।
এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সাইডলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

 

এবারের ব্রিকস সম্মেলনের কর্মসূচিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি হলো ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বহুপাক্ষিকতাকে আরো সম্প্রসারিত করা। অন্যটি হলো ব্রিকস প্লাস, যার অর্থ এই সংস্থার ভেতর অংশীজন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যাপক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। ব্রিকসের এবারের সম্মেলনে যে সুস্পষ্টভাবে বর্তমান বিশ্বরাজনীতিকে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হচ্ছে, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে উল্লেখ্য যে এই সম্মেলনের মাত্র ১২ দিন আগে গত ১২ অক্টোবর হঠাৎ করেই তুর্কমেনিস্তানের আশগাবাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মধ্যে এক বৈঠক হয়, যা অনেক রহস্যের ডালপালা বিস্তৃত করছে।

পশ্চিমা আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ব্রিকসঅনেকের মধ্যেই একটি প্রশ্ন জাগতে পারে, রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিকে পরোয়া না করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলো কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দাপট বজায় রেখে চলছে। এর সহজ উত্তর হলো, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর একে প্রথমে স্বীকৃতিদানকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম। তাদের ধারণা ছিল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা বেষ্টিত রাষ্ট্রটি আদতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পরিচালিত হবে। সময় যত ঘনিয়ে আসে, তাদের বিভ্রান্তি দূর হয়, এর মধ্যে চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে রাশিয়ার সম্পর্ক এক ধরনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি কখনো। এর সূত্র ধরে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি অনেক বছরের। বিতর্কিত জাঙ্গেজুর করিডর নিয়ে তাদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বের বাইরেও ইউরোপের বাজারে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে তাদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা ছিল কঠিন এবং কঠোর। আগামী দিনে ব্রিকসের ছায়ায় বহুপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্ককে নির্দিষ্ট করতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্মতি দিয়েছেন। সাম্প্রতিক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের পক্ষ থেকে এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলে আবারও পুতিনের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, কাজান সম্মেলনে এ বিষয়ে অগ্রগতি ঘটতে পারে। এর বাইরেও আগামী দিনগুলোতে একসঙ্গে কাজ করতে হলে দুই দেশের মধ্যে অতীতের কিছু ভুল-বোঝাবুঝি দূর করার অবকাশ রয়েছে।

এর আগে ইরান অর্থ পরিশোধ করার পরও রাশিয়া তাদের কাঙ্ক্ষিত অস্ত্র সরবরাহ করতে দেরি করছিল, যার জেরে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে চার বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা ঠুকে দেয়। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি পরিষ্কার, তা হলো ভূ-রাজনৈতিক চাপে তারা ইরানকে সরাসরি সমর্থন থেকে বিরত থেকেছে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে। এই সময়ে এসে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যেহেতু সরাসরি পক্ষ এবং এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য, এমন অবস্থায় রাশিয়ার দিক থেকে সরাসরি অবস্থান নেওয়ার সময় এসেছে। এই জায়গায় তারা তাদের সহযোগী হিসেবে পেতে চাইছে ব্রিকসকে। ইউক্রেন যুদ্ধে তারা ব্রিকসের কাছ থেকে নিঃশর্ত সমর্থন পেতে সমস্যায় পড়লেও মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে গাজা ও লেবাননে যেভাবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে মানবিক নিধনযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একাট্টা হওয়ার অনেক জোরালো যুক্তি রয়েছে।

তার পরও কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সোভিয়েত সময়ে তারা বুঝল যে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে আর কেউ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি মাত্র। তবে সোভিয়েত পতনের পর রাশিয়ায় থেকে যাওয়া প্রায় ১০ লাখ ইসরায়েলির প্রতি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে অনেকটাই নমনীয় হতে দেখা যায়। কারণ তারা রাশিয়ার প্রতি তাদের সমর্থন বজায় রেখেছিল এবং রুশ ভাষায় কথা বলত। এসব কারণে পুতিনকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে খুব একটা সরব হতে দেখা যায়নি। কারণ রাশিয়া একক রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলবিরোধী হওয়ার চেয়ে একটি জোটের মাধ্যমে জোটগত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে বেশি আগ্রহী। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও তারা তাদের জিঘাংসাকে চরিতার্থ করতে পারবে। এদিকে চীনের বেলায় হিসাবটা একটু ভিন্ন, যদিও রাশিয়া ও চীন উভয়ের অভিন্ন শত্রু যুক্তরাষ্ট্র, এর বাইরেও চীন এককভাবে বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে, যার একটি বড় সরবরাহ হয় মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্যের দেশগুলো থেকে। এটি চীনকে মধ্যপ্রাচ্যমুখী করেছে এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আরো সরব করে তুলেছে।

এখানে ব্রিকস নিয়ে আমরা চীন ও রাশিয়ার সম্ভাব্য ভূমিকা থেকে এটি অনুমান করতে পারি যে ব্রিকস জোটে তাদের ইচ্ছার প্রভাব কোনো না কোনোভাবে অপরাপর দেশগুলোতে পড়বে। চীনের ব্যাপক উৎপাদন সক্ষমতা এবং বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের আমদানিনির্ভরতা, বৈশ্বিক জ্বালানি এবং খাদ্যসংকটের এই সময়ে এসে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও খাদ্যসম্পদের প্রাচুর্য অনেক দেশকে ব্রিকসমুখী করেছে এবং এর সদস্যরা স্পষ্টভাবেই তাদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বর্তমানে বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্রিকস দেশগুলোর অবদান এক-তৃতীয়াংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা একসময় জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর পেছনে ছিল। বৈশ্বিক জনসংখ্যার বিচারে ব্রিকস দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বজনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করেছে, যা ব্রিকস জোটকে আরো শক্তিশালী করেছে, যার জেরে এর পূর্ণ সদস্যসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আরো সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে; অন্যদিকে পশ্চিমা জোটগুলো, বিশেষত ইইউ ও ন্যাটোর মধ্যে বিরাজ করছে আস্থাহীনতা। পশ্চিমা জোটগুলোর সমন্বিত পরিকল্পনার সীমাহীন ব্যর্থতা এবং এর বিপরীতে ব্রিকসের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া বিশ্বরাজনীতির ছককে পরিবর্তন করে দিতে পারে। তাই তারা পশ্চিমা আধিপত্যবাদকে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে আরো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ২০২৪ সালের ব্রিকস এই লক্ষ্যে কতটুকু অগ্রসর হতে পারে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়