পুতিনের শর্তেই শেষ হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ
মাহবুব আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৬ মার্চ ২০২৫

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপের মধ্য দিয়ে এই আলোচনার সূচনা করেন। এরপর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ও তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তারা মুখোমুখি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে উভয় দেশের পক্ষ থেকে আলোচনাকে সন্তোষজনক মন্তব্য করে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তিচুক্তির লক্ষ্যে আরো আলোচনা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে কী শর্তে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে, তা কোনো পক্ষই স্পষ্ট করেনি। এ বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ বলেছেন, রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের যে চারটি প্রদেশ দখল করে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, তাকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই সঙ্গে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না, নিরপেক্ষ থাকবে—এই মর্মে ইউক্রেনকে অঙ্গীকার করতে হবে।
আর ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে হবে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই শর্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে এটি স্পষ্ট যে রুশ শর্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের আপত্তি নেই। আলোচনার পর মার্কিন কর্মকর্তারা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
অবশ্য এই ইঙ্গিত নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্চ ও এপ্রিলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইস্তাম্বুলে যে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির আলোচনা শুরু হয়, তখনো এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত হেনরি কিসিঞ্জার ইউক্রেনকে কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে অবিলম্বে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের কথা বলেন। ওই বছর ২৪ মে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে কিসিঞ্জার আবারও তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, অহেতুক হানাহানি না বাড়িয়ে ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার দাবি মেনে নেওয়া।
রাশিয়া যে জায়গা দখল করেছে তার মালিকানা ছেড়ে দেওয়া। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে রাশিয়াকে পরাস্ত করা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই হুমকির মুখে পড়বে ইউক্রেন। সেই সময় ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে সম্মত হলেও শেষ মুহূর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত হয়। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘আজ হোক, কাল হোক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনকে বেদনাদায়ক আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ অর্থাৎ শান্তির লক্ষ্যে ইউক্রেনকে তার নিজ ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
উল্লেখ্য, সেই সময় যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার শর্ত ছিল—১. ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হবে। ২. ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও নািস প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে এবং ৩. দেশটির নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
ওই সময় শান্তিচুক্তির স্বার্থে রাশিয়া তার সামরিক অভিযানের লাগাম টেনে ধরে। কিয়েভ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে এবং চেরনোহির দখল ছেড়ে দিয়ে সেনাদের রুশ সীমান্তের কাছে ফিরিয়ে নেয়। এ বিষয়ে তৎকালীন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোবিন বলেন, ‘সমঝোতার পথ তৈরির জন্য সেনা সরানো হয়েছে।’ সমঝোতা হলেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন শান্তিচুক্তিতে সই করা থেকে বিরত থাকে এরই মধ্যে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি।
সেই সময় যা ঘটেছিল তা হলো—২৯ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন সম্মত হয়। এবং পরদিন ৩০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তি আলোচনা রাশিয়ার কূটকৌশল। ওয়াশিংটন এই কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেবে না। ভণ্ডুল হয়ে গেল শান্তি আলোচনা। টেবিলেই পড়ে থাকে চুক্তির খসড়া।
তারপর দীর্ঘ লড়াই। তিন বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াই। এই লড়াইয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, জাপোরিঝিয়াসহ চারটি প্রদেশ ও ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ দখল করে নিয়েছে। এই ভূখণ্ডের পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বদলে গেছে রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির শর্ত। কারণ এই সময়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের দখলকৃত এলাকাকে রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে ডিক্রি জারি করেছেন। অবশ্য গণভোট করে ওই অঞ্চলের জনগণের মতামত নিয়ে। এখানে উল্লেখ্য, রাশিয়ার সেনারা যে অঞ্চল দখল করেছে, তা রুশ ভাষাভাষী অঞ্চল। এই অঞ্চলের দুটি প্রদেশ লুহানস্ক ও দোনেত্স্ক আগে থেকেই স্বাধীনতার দাবিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।
রাশিয়ার শর্তের বিষয়ে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তীব্র আপত্তি রয়েছে, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই আপত্তিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এই যুদ্ধের জন্য অতীতের বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য হিসেবে যে অর্থ দিয়েছে, সেই অর্থও ফেরত চাইছে। এ জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের মাটির তলায় যে মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে, তা উত্তোলনের দাবি করেছে। দাবি করেই ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষান্ত হয়নি, অবিলম্বে এ বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আহবান জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে। কার্যত এ লক্ষ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জেলেনস্কি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে দুই নেতার বাগবিতণ্ডা ঝগড়ায় পরিণত হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দেন।
হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে জেলেনস্কি ছুটে যান ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে। ইউরোপীয় মিত্ররা তাঁর পাশে থাকার আশ্বাসও দেন। এতে ক্ষিপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনকে প্রদত্ত সব সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহও বন্ধ করে দেন। ফলে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে খনিজ সম্পদ চুক্তি সই করতে তাঁর সম্মতির কথা জানিয়েছেন। আরো জানিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধের ও একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতেও তিনি প্রস্তুত। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তিনি রিয়াদে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বশেষ ১১ মার্চ জেদ্দায় মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।
একটি বিষয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে মার্কিন সাহায্য ছাড়া শুধু ইউরোপের সাহায্য নিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না। উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে দিয়েছে ৬৫.৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য। সেখানে ইউরোপের সব দেশ মিলে দিয়েছে ৬৪.৯ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য। আর প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর মেয়াদের শেষ সময়ে নতুন করে যে ৫৪ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য ঘোষণা করেন, তা আটকে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
এই অবস্থায় ইউক্রেনের সামনে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় আসা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। তবে যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদনে কত দিন লাগবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। অবশ্য এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিকল্প চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেছেন। তিনি জেলেনস্কিকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এ বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও একমত। পুতিন বেশ কিছুদিন ধরে বলে আসছেন জেলেনস্কির প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই তাঁর সঙ্গে আর কোনো আলোচনা নয়। আলোচনা হবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যুদ্ধের জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনে সামরিক আইন জারি করেছেন। ইউক্রেনের আইন অনুযায়ী সামরিক শাসনের মধ্যে কোনো নির্বাচনের বিধান নেই। তার পরও এ বিষয়ে পর্দার অন্তরালে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস বলেছেন, ‘আমাদের এমন একজন নেতার প্রয়োজন, যিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন, যিনি রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করবেন, যিনি যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত আগের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পেরেশেংকো ওয়াশিংটন সফর করেছেন। এই পেরেশেংকো রুশপন্থী হিসেবে পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতা। তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন সাবেক সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি, বর্তমান গোয়েন্দাপ্রধান কিরিল দাদভ ও বিরোধী দলের নেতা লিমোশেংকো। এককথায় ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য প্রয়োজনে ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তাকে পরাস্ত করার পরিণাম যে ভালো হবে না, এটি একজন বোকাও বোঝে। তাইতো বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধকে অহেতুক যুদ্ধ বর্ণনা করে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতার পরিবর্তে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাই রাশিয়ার শর্তেই শেষ হচ্ছে তিন বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী ইউক্রেন যুদ্ধ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট