রাজনীতি : বাংলাদেশের রাজনৈতিক শাসন ও গণতান্ত্রিক দৃঢ়তা
ড. এম এম আকাশ। সূত্র : বণিক বার্তা, ০৬ মে ২০২৫

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শাসনকারী রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ (এএল)। এটি ছিল একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, একটি দেশের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা গঠিত হয় একটি শাসক কর্তৃপক্ষ, একটি প্রভাবশালী শ্রেণী বা শ্রেণীর জোট দ্বারা, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয় এবং আইন, নিয়ম-কানুন, কারাগার, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, থিংক ট্যাংক, ধর্ম, রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন ইত্যাদির মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবরদস্তি বা/এবং আধিপত্যমূলক সম্মতি অর্জন ও টিকিয়ে রেখে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখে।
এ উপাদানগুলো সময়ের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত হয়ে একটি দেশে গণতন্ত্রকে হয় উন্নত করতে পারে অথবা সামাজিক ন্যায্যতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং এ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোয় অংশগ্রহণমূলক শাসনকে উৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত করে গণতন্ত্রকে হ্রাস করতে পারে। এখন আমি বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দল এবং তাদের সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবর্তনের একটি খুব সাধারণ রূপরেখা আঁকব।
১৯৭১-৭৫: শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক শাসন
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শাসনকারী রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ (এএল)। এটি ছিল একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাতির বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়েছিলেন। ধনী, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত সবাই তাকে বঙ্গবন্ধু (বাংলাদেশের বন্ধু) বলে ডাকত!
আওয়ামী লীগ মূলত পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল এবং পরে নিজেকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নামে রূপান্তরিত করে। ১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের শাসনের প্রধান সমালোচনাগুলো নিম্নরূপ—
ক. ১৯৭৪ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী দলগুলো কয়েকটি সংসদীয় আসনে কারচুপির অভিযোগ করেছিল।
খ. ১৯৭২ সালে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রস্তাবে সম্মত হননি, যদিও আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এ প্রস্তাবের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে জানা যায়।
গ. পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংসদে তাদের দাবি সত্ত্বেও কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি।
ঘ. ১৯৭৪ সালে প্রান্তিক ও দরিদ্র, বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক শ্রেণী, সরবরাহ সংকট এবং ক্রয়ক্ষমতার হ্রাসের কারণে খাদ্য অধিকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এ ফলে প্রান্তিক শ্রেণীর অনেক সদস্য দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল।
ঙ. আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব প্রথমে বিরোধীদের প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সংকট অব্যাহত থাকায় তিনি পরে একটি একদলীয় ব্যবস্থা গঠন করেন এবং ‘বাকশাল’ নামক দলের বাইরের সবার জন্য নাগরিক অধিকার সীমিত করে দেন।
চ. কিন্তু এটিই ছিল বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের শেষের শুরু।
১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য শেখ মুজিব ও তার পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। খন্দকার মুশতাক ও ডানপন্থী আওয়ামী লীগারদের নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার পুরনো সরকারকে প্রতিস্থাপন করে।
১৯৭৫-৯০: মুশতাক, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক শাসন
এ সময়কাল ছিল সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন ‘রাজার দল’ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের সময়। উদারনৈতিক গণতন্ত্র তখনো সূচিত হয়নি।
ক. শেখ মুজিবের হত্যার অল্প সময় পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে আওয়ামী লীগের চারজন বিশিষ্ট নেতার আরেকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা তৎকালীন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কার্যকরভাবে পঙ্গু করে দেয়।
খ. খন্দকার মুশতাক, আওয়ামী লীগের আরেকজন ডানপন্থী আমেরিকাপন্থী নেতা, অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু শিগগিরই সেনাবাহিনীর মধ্যে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, ক্ষমতায় আসেন। উচ্চাভিলাষী জেনারেল জিয়া সশস্ত্র বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষ থেকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন। এটি একটি ডানপন্থী উদারনৈতিক দল।
গ. কিন্তু পরে জিয়াও একটি অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং জেনারেল এরশাদ তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি প্রায় একইভাবে তার নিজস্ব জাতীয় পার্টি গঠন করেন। সময়ের সঙ্গে জাতীয় পার্টি আরো ডানপন্থী হয়ে ওঠে এবং ভারত-আমেরিকা অক্ষের সঙ্গে আরো শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলে।
ঘ. ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলের জোটের নেতৃত্বে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের সেনা সমর্থিত শাসন উৎখাত হয়।
এই বিস্তৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে অভিনব উদ্ভাবনী ফলাফল ছিল নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নতুন প্রতিষ্ঠান।
১৯৯০-২০০৮: দ্বিদলীয় রাজনীতির যুগ
এই নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অন্যান্য অনেক দেশের মতো সফলভাবে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে দুটি দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসতে ইচ্ছুক ও প্রস্তুত ছিল। উভয় দলই মূলত ধনী শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হতো, যারা বিদেশী সাহায্য ব্যবহার করত বা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সুবিধা ভাগাভাগি করত এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধ করত।
এ ধরনের অভিজাত স্বজনতোষণকারী ধনীদের দ্বারা চালিত সীমিত গণতন্ত্র কিছু সময়ের জন্য শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন ছাড়াই স্থিতিশীল থাকতে পারে। কিন্তু যদি উভয় দলই পর্যাপ্ত সহনশীল এবং সভ্য না হয় তাহলে দ্বিদলীয় রাজনীতি কাজ নাও করতে পারে।
২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে চারটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এ নির্বাচনগুলোয় দুটি প্রধান অভিজাত নেতৃত্বাধীন দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—প্রত্যেকে তাদের ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্ক ‘বঙ্গভবন’ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ‘গ্রাম’ পর্যন্ত বিস্তৃত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে চক্রাকারে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন এ সময়ে সমাজের অসমতা এবং অন্যায়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি, বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আলোচিত সময়ে উভয় দলই নির্বাচনে একটি উল্লেখযোগ্য ন্যূনতম ভোট ও সংসদীয় আসন পেতে সক্ষম হয়েছিল এবং তারা পর্যায়ক্রমে একে অন্যের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সংসদে মুখোমুখি হয়েছিল। [টেবিল ১ দেখুন] তাই এ সময়ে অভিজাতদের প্রতি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে একটি মানসম্মত বুর্জোয়া গণতন্ত্র বজায় রাখা কিছুটা সম্ভব হয়েছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনের ভাঙন
আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা হলো ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট সিস্টেম। এ ব্যবস্থায় একটি দল বা ব্যক্তি তার ভোটের শতাংশের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি আসন এবং ক্ষমতা পেতে পারে। একই সময়ে অনেক প্রান্তিক দল উল্লেখযোগ্য ভোট পাওয়া সত্ত্বেও সংসদ থেকে সম্পূর্ণ বাদ পড়তে পারে। ফলে সংসদে একটি স্বৈরাচারী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনধারী দল একচেটিয়াভাবে শাসন চালাতে পারে বা ‘বিজয়ী সব নেয়’ কৌশল অনুসরণ করতে পারে, যদিও বিরোধী দলের ক্ষেত্রে প্রকৃত শক্তির ভারসাম্য সিটের তুলনায় বেশি থাকতে পারে।
এক্ষেত্রে মাঠে শক্তির ভারসাম্য ভেঙে যাবে এবং দুই ক্ষমতা প্রতিদ্বন্দ্বীদের যুদ্ধক্ষেত্র সংসদের পরিবর্তে রাস্তায় স্থানান্তরিত হবে। দুই প্রধান দলের মধ্যে রাজনৈতিক যুদ্ধ প্রান্তিক শ্রেণীর দ্বারা শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধের সঙ্গে পরিপূরক হতে পারে, যদি তারা তাদের নিজস্ব বিষয়গুলোর চারপাশে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হতে পারে। তা না হলে প্রান্তিক দলগুলো দুই বুর্জোয়া দলের লেজুরবৃত্তির মধ্যেই দিন কাটাতে থাকবে।
বাংলাদেশে ব্যর্থ গণতন্ত্র: ২০০৮-২৪
২০১৪ সালের পর দুই অভিজাত দলের মধ্যে সমঝোতা সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। প্রধান কারণ ছিল প্রভাবশালী দল আওয়ামী লীগ কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। দুই প্রধান দল আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। ফলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো কমবেশি একদলীয় আধিপত্যের কারচুপিযুক্ত নির্বাচন ছিল, যা প্রধান বিরোধী দলগুলো বয়কট করেছিল।
কিন্তু অবশেষে ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি বহু শ্রেণীর আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এটির নেতৃত্বে ছিল বিভিন্ন মতাদর্শের মিশ্রণ। এটি শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটায় এবং সেনাবাহিনী তাকে রক্ষা করতে অস্বীকার করায় তাকে দেশের বাইরে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে নিরাপদ প্রস্থান করতে হয়।
বর্তমান রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যা সেনাবাহিনী ও আন্দোলন পরিচালনাকারী ছাত্র সংগঠন দ্বারা সমর্থিত। বর্তমানে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে একটি সর্বজনীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুনর্গঠিত হয়েছে। অনেক ভূগর্ভস্থ মৌলবাদী শক্তি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন প্রভাবশালী দল হয়ে উঠেছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আশীর্বাদে ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী বাম দলগুলো তিনটি ‘এম’ (অর্থ, শক্তি এবং কারসাজি) নিয়ন্ত্রণ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচন ব্যবস্থায় কিছু সংস্কারের দাবি তুলেছে। তারা সমানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিও জানিয়েছে।
অমীমাংসিত বিতর্কের মূল বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বাদ পড়বে নাকি অন্তর্ভুক্ত হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত মনে করে, জাতিসংঘের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার পূর্বে করা উচিত। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিবেদন সাধারণত আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের সমর্থন করে। এখন পর্যন্ত শুধু মৌলবাদী দল, যাকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিল এবং নতুন গঠিত ছাত্রদল, যারা আন্দোলনের প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত, বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
প্রাপ্ত শিক্ষা
প্রথম শিক্ষা হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র, অন্যত্রের মতো, সবসময় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতা এবং ন্যায়বিচারের অভাব দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক ও কৃষকরা অতীতে কখনই তাদের আয়, সম্পদ, শিক্ষার যথাযথ অংশ পায়নি এবং তারা তাদের ওপর পরিচালিত শাসন প্রক্রিয়ায় অবাধে অংশগ্রহণের রাজনৈতিক সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিল।
এ বঞ্চিত শ্রেণীর মধ্যে এবং তাদের বাইরেও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ গোষ্ঠী রয়েছে, যেমন সাধারণ নারী, বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং সর্বোপরি বিভিন্ন গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছোট রাজনৈতিক দল, যারা তুলনামূলকভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। তাদের সবাইকে ক্ষমতায়িত না করে এবং মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত না করে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একদলীয় আধিপত্যের মাধ্যমে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, যা খেলার ন্যায্য নিয়ম বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করেছিল এবং বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠকে ইতিহাসের নিছক বস্তুতে পরিণত করেছিল।
গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ হলো বাদ পড়া মানুষকে ক্ষমতায়িত করে তাদের ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত করা এবং সংখ্যালঘু স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা উৎখাত করা। তাই প্রধান শিক্ষা হলো—গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ‘ক্ষমতা সবসময় স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হওয়া উচিত’, ‘প্রতি-ক্ষমতার’ (Counter Power) এবং সংগ্রামের সুযোগ সবসময় উন্মুক্ত রাখা উচিত।
আমি আমার উপস্থাপনা শেষ করছি লর্ড অ্যাক্টনের ইতিহাসের একটি শিক্ষv দিয়ে যা স্বার্থবাদী ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী কখনই মানেনি—
‘সব ক্ষমতা দুর্নীতিপ্রবণ করে তোলে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিগ্রস্ত করে’। (All Power Corrupts and Absolute power corrupts absolutely)
ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
[প্রবন্ধটি সম্পূর্ণরূপে লেখকের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে এবং এটি লেখক যে সংগঠনে যুক্ত তাদের মতামতের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। এটি কেবল আলোচনার জন্য একটি প্রাথমিক খসড়া এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া উদ্ধৃত করা
যাবে না।]