রাজনৈতিক বিভক্তিই এখন বড় সংকট
ড. সুলতান মাহমুদ রানা। সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৪ মে ২০২৫

নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে হবে, নাকি পরের বছর জুনের ভেতর হবে এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সব বক্তব্য এবং আলোচনার মূল প্রসঙ্গ হলো নির্বাচন। এর আগে তারা জানিয়েছিল ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে তারা কঠোর কর্মসূচি দেবে।
কয়েক বছর আগে নির্বাচনী আচরণ এবং প্রচারণা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এবং নির্বাচন খুব বেশি অলোচিত শব্দযুগল। যেকোনো দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার ধরন এবং প্রকৃতি রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে থাকে। এককথায় বলা যায় নির্বাচন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেন একটি অঙ্গাঙ্গি বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে গোট বিশ্বব্যাপী। এ প্রসঙ্গে সারা বিশ্বের চিত্র প্রায় কাছাকাছি এবং অনেকটা একই। এই কর্মকাণ্ড যখন ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে তখন আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে নিয়ন্ত্রণহীন সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তখন তারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে নানা অজুহাতে সংঘর্ষ ও সংঘাত সৃষ্টি করে ভীতির রাজ্য কায়েম করার চেষ্টা করছে—এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। এর সঙ্গে তারা তৈরি করে বেশ কিছু আইন-কানুন, যা দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায়।
বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। তার পরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। বর্তমান সময়ে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন কতটুকু ভূমিকা রাখছে সেটি এখন অধিকভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এমনকি এ কথা বললে ভুল হবে না যে বিশ্বব্যাপী রাজনীতি বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তর হোমওয়ার্ক প্রয়োজন। মিডিয়া আগের চেয়ে অনেকটাই সক্রিয়। রাজনীতির সবটাই দেখছে এখন মিডিয়া। শাসকবিরোধী লড়াই কিংবা কোন রাজনীতিক হাতে কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরছেন-সবটাই দেখছে মিডিয়া এবং তা প্রচার করছে। তাই রাজনীতির হিসাবটা আরো কঠিন হয়েছে। অতীত-বর্তমান ঘেঁটে বের করে আনতে হয় বিরোধীপক্ষের দুর্বল জায়গা। তারপর প্রস্তুতি নিয়ে আঘাত করতে হয় সেখানে। অক্লান্ত প্রক্রিয়া, থেমে থাকার পথ নেই। একজন যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করবে, অন্যজন ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে। কারণ ক্রিয়ার পরেই প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে।
তার পরও আমরা প্রত্যাশা করি বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বিদ্যমান নির্বাচনী গণতন্ত্রের চর্চার ভালো দিকগুলো নিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কার হবে। কিন্তু আমাদের দুঃখের শেষ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা একে অপরে কাদা ছোড়াছুড়ি করে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এমন পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই এ প্রক্রিয়া দৃশ্যমান। তাহলে আপনারাই বলুন, আইন করে কি এই কাদা ছোড়াছুড়ি রোধ করা যাবে? কখনোই নয়। আমাদের নিজেদের বিবেক ও চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই ইতিবাচক প্রত্যাশা তৈরি হবে না। আমরা অবাক হই যখন দেখি আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা একে অপরকে আক্রমণ করে। তাঁরা যদি নিজেদের আক্রমণ করে, তাহলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা তাঁদের কাছ থেকে কী শিখবে। তখন তারাও এ নিয়ে মাতামাতি করে। দেশে বিদ্যমান অসংখ্য ভালো আইন আছে, কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ যথাযথ নয়।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে একটি সুন্দর কাঠামো উপহার হিসেবে আসলেও তার যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। কারণ আমরা সাধারণ জনগণই নিজেরা বিভক্ত রয়েছি রাজনৈতিক প্রশ্নে। আমরা যে কাঠামোই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তরুণদের স্লোগান হচ্ছে, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই।’ বাংলাদেশে আমরা এবার এমন স্লোগানই দেখেছি। তবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যতা তৈরি করে তরুণরা তাদের ন্যায়বিচারের দাবিটি যথাযথভাবে ঘরে তুলতে পারবে কি না সেটি একটি প্রশ্ন।
দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা একটি সিস্টেমকে সহজ ও সরল সমীকরণে জনগণের জন্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সরকার এবং জনগণ উভয়েরই বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। শুধু সরকার নয়, বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের মনমানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আনতে পারলে কখনোই পরিপূর্ণ স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরের দায়িত্বশীলদের যেমন সংস্কার প্রয়োজন, তেমনি যারা সেবা গ্রহণ করবে তাদের মনেও ১০০ শতাংশ ইতিবাচক প্রবণতা থাকতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়