রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রসঙ্গে
ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ছিল। চলতি অর্থবছরসহ বিগত ৯ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ পিছিয়ে পড়লেও বছর বছর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৭ থেকে ২০ শতাংশ হলেও যথেষ্ট উচ্চ প্রবৃদ্ধি (৩২ শতাংশের বেশি) প্রাক্কলন করেই জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হয়তো বছরের মাঝপথে উন্নয়ন বাজেট ওরফে এডিপি বড় কাটছাঁটের শিকার হয়। আবার অনুন্নয়ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের হিস্যা হ্রাস পায়।
ব্যাংকঋণসহ নানা সংস্কারের শর্তসংবলিত দাতা সংস্থার বাজেট সাপোর্ট ফান্ডের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। মোটকথা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বশংবদ নীতি প্রথার, পারঙ্গমতার খোঁজ মেলে না। পণ্ডিতরা মনে করেন, কর রাজস্ব জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের যৌক্তিকতা থেকেই যাবে। আসল কথা, করের হার না বাড়িয়ে করজালের সম্প্রসারণ ঘটিয়েই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যত্নবান হতে হবে।
উপলব্ধিকে বাস্তবতায় এভাবে আনতে হবে সব পক্ষকেই যে বাঞ্ছিত পরিমাণ রাজস্ব বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরতার গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে কর রাজস্ব অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তরফে সরকারের সামষ্টিক আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতা সঞ্জাত মনোভঙ্গি ভজনের, পদ্ধতি সহজীকরণের, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রসঙ্গেগতানুগতিক কর্মধারায় নয়, নীতিনির্ধারক, বাস্তবায়ক ও নাগরিক নির্বিশেষে সবাইকেই সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট হতে হবে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণে।
দেখা যাচ্ছে, আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা এখনো ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রমেই কম্পানি ও কম্পানি ছাড়া কর আয়ের অনুপাত ৭০ঃ৩০ থেকে ৫৮ঃ৪২-এ পৌঁছেছে। দেশে করপোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি। অন্যদিকে কম্পানি ছাড়া করদাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসন, আর্টিফিশিয়াল জুরিডিক্যাল পারসনস রয়েছেন—তাঁদের করজালের আওতায় আনার উদ্যোগ আরো জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএনধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে, তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চলছে।
যাঁরা আয়কর নথি খুলেছেন, তাঁদের শতকরা মাত্র ২৫ থেকে ৩০ ভাগ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামো কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশীয় দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে এবং প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি; তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি-প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতা বান্ধব বা সহজ করা যাবে, তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে করজালের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। দেশের কর জিডিপি রেশিও উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য যে সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকেই মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।
কয়েক বছর ধরে প্রকৃত অর্থে বোঝা যাচ্ছে না পটেনশিয়াল করদাতার সংখ্যা সত্যি বাড়ছে কি না। সার্বিকভাবে উৎস কর ও কম্পানির করের ওপরই আয়কর নির্ভর হয়ে পড়েছে। এটি বাড়ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। দেখতে হবে করের প্রকৃত পরিধি বাড়ছে কি না। করদাতার সংখ্যা বাড়ছে কি না এবং সেই হারে করের পরিমাণ বাড়ছে কি না। আবার এর সঙ্গে ঢালাও রেয়াত ও অব্যাহতি প্রদানসহ কর ফাঁকি রোধ বা সীমিত করতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে করপোরেট কর যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা সবাই সঠিক পরিমাণে দিচ্ছেন কি না, সেটিও দেখার বিষয় রয়েছে। কারণ প্রায়ই প্রতিবেদনে দেখা যায়, অমুক প্রতিষ্ঠান বা কম্পানির এত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি। এটি তো ছেলেখেলার বিষয় নয়। এখানে কর আহরণকারী প্রতিষ্ঠানের সততা, সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ সেখানে কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের, প্রয়াসের, দক্ষতার, সততার দায়িত্বশীলতার ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিত আসতে পারে।
গত কয়েক বছরে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনবিআরের বেশ কিছু সংস্কার এবং জনবল ও কাঠামোতে ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। সক্ষমতা অনেক বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি কর সেবাদানের দৃষ্টিভঙ্গি। কিছুটা হলেও রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। তবে ভেবে দেখতে হবে, যে হারে সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে, সে হারে কর বা করদাতার সংখ্যা বাড়ছে কি না কিংবা যাঁরা যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা পরবর্তী সময়ে থাকতে পারছের কি না? বিদ্যমান কর ব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কর বিভাগের অপারগ পরিস্থিতির কারণে করদাতারা যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। করের বেইস বাড়ানোর জন্য এটি জরুরি।
মোট কর রাজস্বে আমদানি শুল্কের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৪২ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩০ শতাংশের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কখনো ২৭, কখনো মাত্র ০৫ শতাংশ অর্থাৎ বড় এলোমেলো এবং অপরিকল্পিত প্রয়াস পরিস্থিতি নির্দেশ করে। ডব্লিউটিওর অনুশাসন মেনে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক হ্রাস পেতে থাকবে এমন একটি ধারণা বা যুক্তি বিদ্যমান থাকলেও ক্রমান্বয়ে উচ্চ শুল্কায়নযোগ্য সামগ্রীর আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে শুল্ক আয় সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির কার্যকরণ সম্পর্কটিও পরীক্ষা-পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে।
মূল্য ওঠানামার সঙ্গে ট্যারিফ স্ট্রাকচারের সমন্বয় সাধন, ভ্যালুয়েশনসহ শুল্কায়নে অধিকতর একাগ্রতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও প্রকৃষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য থেকে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর আয়ের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৩৩ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয়কর আয়ের সামঞ্জস্যহীন পরিস্থিতি নির্দেশ করে। মূসক আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মিশ্র হারও মূসক আয়ের টেকসই ও ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ করে না। এ সময়ের (২০০৬-১৭) গড় প্রবৃদ্ধি আমদানি (২২ শতাংশ), জিডিপি (৫ থেকে ৭ শতাংশ) ও মূল্যস্ফীতির (৭ থেকে ৯ শতাংশ) হিসাব এবং স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনলে স্থানীয় পর্যায়ে পরোক্ষ কর থেকে আয়ের প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম ২৫ শতাংশের বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়।
মোট কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ২৫ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সময়গুলোর তুলনায় বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি—এ ধারা আরো বেগবান হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে আয়করের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২৭, ১১, ১৮, ২৮ ও ১৯ শতাংশ অর্থাৎ সুস্থিরভাবে ঊর্ধ্বগামী হতে পারেনি। আয়কর দাতার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত, তা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। দক্ষ ও দায়িত্বশীল লোকবলের সমাহার ঘটিয়ে সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে পারলে মোট রাজস্ব আয়ের হিস্যা বাড়ানো সহজতর হবে। কর জিডিপি রেশিও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে তাই প্রয়োজন সবার সমন্বিত প্রয়াস।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান