রাখাইন পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক করিডর
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন। সূত্র : যুগান্তর, ০৫ মে ২০২৫

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে এবং পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে, মানাং দ্বীপ এবং গুরুত্বপূর্ণ চকপিউ বন্দরের নিয়ন্ত্রণ এখনো জান্তার হাতে। মিয়ানমারের নৌবাহিনীও সেসব এলাকায় তাদের অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় চলমান তীব্র সংঘর্ষের কারণে রাখাইনের জনগণের জীবন বিপর্যস্ত। এ ভোগান্তি আরও বাড়াতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের সরবরাহ পথ বন্ধ করে রেখেছে। রাখাইনের জনগণ তীব্র খাদ্য ও ওষুধ সংকটে ভুগছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) রাখাইনে মানবিক সংকটের বিষয়ে জানিয়েছিল, রাখাইনে তীব্র মানবিক সংকট, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের মধ্যে রাখাইনে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পাশাপাশি জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ-রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে বিবদমান পক্ষের কারণে বেশির ভাগ মানুষই মানবিক সহায়তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিলে রাখাইনের অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন জনসংখ্যার চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারছে। বীজ, সারের অভাব, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং কৃষিকাজ করতে অক্ষম অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ফসলের উৎপাদন কমে গেছে। রাখাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘ আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে।
রাখাইনে মানবিক সংকট দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে আরও মানুষের বাংলাদেশে আসার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, যা বাংলাদেশের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে। তাই সেখানকার দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় বাংলাদেশ থেকে একটি মানবিক চ্যানেলে কিংবা করিডর দিয়ে সেখানে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, সার, বীজ, ওষুধসহ ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে চায় জাতিসংঘ। বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখলে নিলেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত এক লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসস্থলের ব্যবস্থা করতে ইউএনএইচসিআর আরআরআরসি কার্যালয়কে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, মিয়ানমার জান্তা সরকারের মতো আরাকান আর্মির মধ্যেও রোহিঙ্গাবিদ্বেষ রয়েছে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তা কমেনি এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মার্চে বাংলাদেশ সফরের সময় রাখাইনে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রভাব নিয়ে জানিয়েছিলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। মিয়ানমারের সব প্রতিবেশী দেশকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যেন সহিংসতা বন্ধে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ তৈরি হয়। একই সঙ্গে মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সবসময়ই সংকটকালে অন্যান্য দেশকে সহায়তা করে এসেছে, সম্প্রতি মিয়ানমারে ভূমিকম্পের পরও বাংলাদেশ দ্রুত সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। রাখাইনে জাতিসংঘের সহায়তায় মানবিক কার্যক্রম পরিচালিত হলে রাখাইন অঞ্চলে তা স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে আশা করা যায়।
রাখাইনে মানবিক বিপর্যয় রোধে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে করিডর চালু করার জন্য মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সম্মতি প্রয়োজন। কোনো এক পক্ষ রাজি না থাকলে এ করিডর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জান্তা সরকারকে বাদ দিয়ে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত রাখাইনে এ করিডরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমার সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগের বিষয়ে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পত্র দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। জান্তা সরকার আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে বাংলাদেশ কেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ নিজস্ব স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই হবে।
২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করতে অনুরোধ করে। এরপর জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সে সময় তখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এসেছিল। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান জানান, তিনি সেসময় আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার-সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন। জাতিসংঘ, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে এ করিডর ব্যবহার বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। যে করিডর দিয়ে সহায়তা যাবে, সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে তাদের জন্য সেখানেই মানবিক সহায়তার কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে পারবে বাংলাদেশ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মাধ্যমেই রাখাইনে সহায়তা পাঠানো সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার রাখাইনে করিডরের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকেও সঙ্গে রাখবে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান জানান, মানবিক সহায়তার রুটের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে, যা নিয়ে নানা পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরকার যোগাযোগ করছে, যথাসময়ে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গেও পরামর্শ করা হবে। জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং আরাকান আর্মিকেও এ বিষয়ে একমত হতে হবে। রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের শর্তে আরাকান আর্মির সঙ্গে চুক্তি করতে পারে এবং জাতিসংঘ সেই চুক্তির গ্যারান্টার হলে, পরবর্তীকালে আরাকান আর্মি সেই চুক্তি থেকে সরে আসতে পারবে না।
অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সমস্যাকে বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসাবে তা সমাধানের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগে দলমতনির্বিশেষে সবার সমর্থন জরুরি। রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের বিষয়ে জাতিসংঘ প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারে। মিয়ানমারের মানবিক সংকট রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও প্রভাব ফেলছে। এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।
রাখাইনে বাংলাদেশ থেকে করিডরের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা দিতে জাতিসংঘের দুই দেশের সরকারের অনুমতি লাগবে, এ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ সীমিত। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনো মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য দুই দেশের সরকারের সম্মতি দরকার এবং সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর অনুমতি নেওয়ার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আমাদের দেশের স্বার্থ দেখতে হবে। এজন্য যেসব বন্ধুরাষ্ট্র আমাদের সহায়তা দিতে চায়, তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে। প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের দেশের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আট বছর ধরে রোহিঙ্গাদের এ বোঝা বহন করে আসছে, এ সংকট সমাধানে তেমন কোনো সহায়তা এত বছর ধরে বাংলাদেশ পায়নি এবং একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারেনি। বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। এটা বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকট।
এ সংকট সমাধানে যারা বাংলাদেশকে সহায়তা করবে, তাদের দল-মত নির্বিশেষে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য সব পক্ষ একত্রে দেশের স্বার্থসংরক্ষণে সচেষ্ট হবে। বাংলাদেশকে ভাবতে হবে দেশের জন্য ভালো কোনটি এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো রাখাইনে তাদের স্বার্থসংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশকেও নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় এবং সংকট সমাধানে নিরাপত্তা নিশ্চিতপূর্বক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক