রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি না হলেও অগ্রগতি হয়েছে
গাজীউল হাসান খান [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৭ আগস্ট ২০২৫]

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সাড়ে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি এবং সর্বশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে এত দিন যে আলোচনা চলেছে, বিভিন্ন ওয়াকিফহাল মহল সেটিকে সার্বিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ‘জুয়ার আসর’ বলে অভিহিত করেছে। আলাস্কায় সূচিত বর্তমান যুদ্ধবিরতি এবং শান্তিচুক্তির আলোচনায় এ মুহূর্তে শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট পুতিন বসলেও উল্লিখিত তিনটি দেশেরই মোটাদাগের কিংবা বিশাল মাপের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। এই শতাব্দীর এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা সার্বিকভাবে বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। সে কারণেই সার্বিক বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন বলছেন, শান্তিচুক্তির শর্ত চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে কোনো যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়, তখন জেলেনস্কি বলছেন, রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত এ অঞ্চলে কোনো শান্তি নিশ্চিত হতে পারে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমন অনেক বার্তা পৌঁছেছে যে এই চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের কোনোমতেই ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। ইউক্রেন অনেক আগেই এ যুদ্ধ হেরে বসে আছে। এখন এ যুদ্ধের অবসান না হলে ইউক্রেন ক্রমে ক্রমে পুরো ভূখণ্ডই হারিয়ে ফেলতে পারে। সে কারণেই ট্রাম্প তাৎক্ষণিকভাবে এমন একটি চুক্তি চান, যা এ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।
এতে ইউক্রেনের আত্মসমর্পণ করতে হলেও ট্রাম্প একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চান। তা ছাড়া ট্রাম্প বলেছেন, ‘ইউক্রেন ও রাশিয়ার মঙ্গল কিংবা একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তির জন্য কিছু এলাকা অদলবদল করতে হতে পারে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ‘এ মুহূর্তে শান্তির জন্য একটি যুদ্ধবিরতি চাই’—এ কথা মুখে উচ্চারণ করলেও শান্তিচুক্তি প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনের ডেনিপ্রো বা ডিনেইপার নদীর পূর্বাঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির। এ ক্ষেত্রে তিনি ইউক্রেনের সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, যা ক্ষেত্রবিশেষে যথেষ্ট বিতর্কিত।
জেলেনস্কি ভুলে যান যে ১৯৯১ পর্যন্ত ইউক্রেন রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশ ছিল। তা ছাড়া জেলেনস্কি বিগত তিন বছরেরও অধিক সময় সামরিক আইন জারি করে দেশ চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে দেশে তাঁর জনপ্রিয়তায় রীতিমতো ধস নেমেছে। সে ভয়ে জেলেনস্কি নির্বাচন দিচ্ছেন না। এ অভিযোগ দেশের নাগরিকরা ছাড়াও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও।
জেলেনস্কির বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে আগত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে দেশের নাগরিকদের একটি বিশাল অংশ অবিলম্বে এ যুদ্ধের অবসানের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্দরনগরী ক্রিমিয়া কিংবা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাসসহ রুশ ভাষাভাষী বিভিন্ন প্রদেশের নাগরিকরা দীর্ঘ সময় ধরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল।
লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, জাপোরিঝিয়া, খেরসন, ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখণ্ড এখন রাশিয়ার দখলে। দনবাস প্রদেশের যে ৩০ শতাংশ ভূখণ্ড রাশিয়া এখনো দখল নিতে পারেনি, সেই এলাকাটি তাদের দিয়ে দিলে তারা অন্যত্র ইউক্রেনের সঙ্গে সমপরিমাণ ভূমি বিনিময় করতে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু জেলেনস্কি সে প্রস্তাবে রাজি নন, তিনি বরং পুরো দনবাস প্রদেশই ফিরে পেতে চান, যা প্রেসিডেন্ট পুতিনের মতে সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করবেন বলে মনে হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আগে থেকেই ধরে নিয়েছেন যে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিচুক্তির শর্তাবলি এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব চূড়ান্ত করা মোটেই সহজ হবে না। কারণ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পেছনে রয়েছেন কয়েকজন ইউরোপীয় সরকারপ্রধান, যাঁরা তাঁকে ভিন্ন কৌশলে পরিচালিত করতে চান। বাস্তবে তেমন কোনো অর্থ সাহায্য কিংবা উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ না করলেও মুখে মুখে তাঁরা এখনো জেলেনস্কিকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ইউক্রেন-রাশিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ হলে বিশ্বব্যাপী রুশ তেল ও গ্যাসের সরবরাহ রাতারাতি বেড়ে যাবে এবং দাম অত্যন্ত সহনশীল পর্যায়ে নেমে আসবে। এতে শুধু জ্বালানি নয়, রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম, সয়াবিনসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের সরবরাহ আশাতীতভাবে বেড়ে যাবে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার্য সার সরবরাহ এবং তার মূল্য ব্যয়সাধ্য হবে, তাতে উৎপাদন খরচ কমবে। ইউক্রেন ও রাশিয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত করা গেলে রাশিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্য কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিধি-নিষেধ উঠে যাবে। রাশিয়া আবার আগের মতো তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ফিরে পেতে সক্ষম হবে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি হলে শুধু যে একতরফাভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হবে তা নয়, উপকৃত হবে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও তার নাগরিকরা। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হয়তো তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। কারণ একদিকে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং অন্যদিকে বর্তমান অবস্থা থেকে মার্কিন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো—দুটিই এখন তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবসানের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর শান্তি উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত এগোতে বাধাগ্রস্ত হলে প্রথমেই তিনি ইউক্রেনের বর্তমান নড়বড়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবেন বলে মনে হচ্ছে। শান্তিচুক্তির শর্তাবলি কিছুটা রদবদল করে ট্রাম্প তাঁর সুহূদ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দ্রুত যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় রাজি করাবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত না করার নিশ্চয়তা ট্রাম্প দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্রমে ক্রমে ন্যাটোর পরিবর্তে ইউরোপকে নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য উৎসাহ দেওয়া হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রাম্প তাঁর শাসনকালের বাকি সময়টা রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইউক্রেনে দুর্লভ খনিজ সম্পদ উত্তোলনসহ কিছু কাজ করবেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যবসায়ী মানুষ। সে কারণেই বিশেষ করে তিনি আলাস্কাকে তাঁর বৈঠকের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করছে। অনেকে বলেছেন, আলাস্কায় রুশ-মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল রয়েছে। সেখানে তাদের পারস্পরিক লাভজনক প্রকল্পের সম্ভাবনাও রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। শুক্রবার আলাস্কার অ্যাংকোরেজে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ আলোচনার জন্য পৌঁছার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এয়ারফোর্স ওয়ানে তাঁর সঙ্গে আসা সাংবাদিকদের বলেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত কথোপকথনে যাবেন না। কারণ সে পর্যায়ে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত রয়েছে। কিন্তু এত কিছু বলার পরও আলাস্কা থেকে কোনো চূড়ান্ত ঘোষণা আসেনি—না যুদ্ধবিরতি, না শান্তিচুক্তির শর্ত সম্পাদনে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উভয়েই প্রায় তিন ঘণ্টা স্থায়ী শীর্ষ আলোচনা শেষে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে এ আলোচনা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, কোনো চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না কোনো চুক্তি হয়েছে। পরবর্তী আলোচনায় সেটি হতে পারে বলে ট্রাম্প আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এবং সে আলোচনার আয়োজন মস্কোতে করার জন্য পুতিন অনুরোধ জানিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, সে মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে তিনি ন্যাটো সদস্য ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনকে একটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা, আলাস্কায় অনুষ্ঠিত ‘শান্তির সন্ধানে আলোচনা’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে, তেমনি পুতিনের মতো একজন ‘যুদ্ধাপরাধীকে’ আবার বিশ্বমঞ্চে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক