রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি শেষের পথে
নিরঞ্জন রায় । সূত্র : সময়ের আলো, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের শুরু থেকেই বলে আসছেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই অতি দ্রুত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবেন। সেই উদ্যোগ শুরুও হয়ে গেছে এবং এর প্রভাব ইতিমধ্যে দেখাও গেছে। যুদ্ধের উত্তেজনা এখন অনেকটাই স্তিমিত। ফলে এই যুদ্ধ যে খুব সহসাই বন্ধ হবে- এমনটাই সবার ধারণা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও, এই যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী হবে তা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছে। তবে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যেতে শুরু করেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই। কেননা সেই নির্বাচনের ফলে বাইডেন প্রশাসনের বিদায় ঘটে এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের শুরু থেকেই বলে আসছেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই অতি দ্রুত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবেন।
সেই উদ্যোগ শুরুও হয়ে গেছে এবং এর প্রভাব ইতিমধ্যে দেখাও গেছে। যুদ্ধের উত্তেজনা এখন অনেকটাই স্তিমিত। ফলে এই যুদ্ধ যে খুব সহসাই বন্ধ হবে- এমনটাই সবার ধারণা। এ ধারণা কিছুটা পরিষ্কার হয়ে গেছে গত মাসে সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় আমেরিকা এবং ইউরোপের প্রতিনিধিদের মধ্যকার আলোচনা থেকে।
দাভোসের সেই সভায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা এবং এর সম্ভাব্য শেষ পরিণতির বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা হয়েছে আমেরিকা এবং তাদের মিত্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতার মধ্যে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে তার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত যেসব প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, তাদের সবাই প্রকাশ্যে ইউরোপের রাষ্ট্রনায়কদের সমালোচনা করেছেন। তারা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের বিষয়টি সঠিকভাবে হ্যান্ডল করতে পারেনি ইউরোপের নেতারা। আমেরিকার এক প্রতিনিধি তো বলেই ফেললেন যে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার শর্ত জুড়ে দিলে, সেটি আমেরিকার জন্য শাঁখের করাত হয়ে দেখা দেবে।
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট অবশ্য আমেরিকার উপস্থিত প্রতিনিধিদের বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা না করেও দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে ইউক্রেন এই সামরিক জোটে যোগ দেবে। তিনি যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে ইউক্রেনের অবস্থান শক্ত হতে হবে, যা একমাত্র ন্যাটোতে যোগদানের মাধ্যমেই সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের জন্য যদি ভালো একটি সমঝোতা না হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং তাদের মিত্রপক্ষ যেমন- উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং চীন এক ধরনের বিজয়োল্লাস করবে। তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন যে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে সম্মত হওয়ার আগে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যে রাশিয়া আর কখনো ইউক্রেন আক্রমণ করবে না। তার মতে এরকম নিশ্চয়তা তখনই আদায় করা সম্ভব, যখন ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে।
দাভোসের সেই সভায় ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের বিশেষ মিশন দূত (এনভয়) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রিচার্ড গ্রেনেল। তিনি ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেলের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করেন যে ন্যাটো সামরিক জোটের বিস্তৃতি বাড়ানোর কারণে বাড়তি অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য আমেরিকানরা মোটেই প্রস্তুত নয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে ন্যাটোর শর্ত অনুযায়ী অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের জিডিপির দুই শতাংশ পরিমাণ অর্থ ন্যাটোতে প্রদান করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও, অনেক সদস্য রাষ্ট্র সেটা করছে না। গ্রেনেল ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল রুটকে উদ্দেশ করে বলেন যে তিনি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যা করার জন্য চাপ দিয়ে প্রকারান্তরে আমেরিকাকে শাঁখের করাতের মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে আমেরিকানরাই প্রতিরক্ষা ব্যয়ভার বহন করে চলেছে। অথচ অন্য সদস্য রাষ্ট্র ন্যাটোতে যে বরাদ্দ প্রদানের কথা, তা তারা করছে না। এই বলে তিনি ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রকে ন্যাটোতে অর্থ প্রদানের বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সেই বার্ষিক সভায় উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের আরেক প্রতিনিধি যিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন বিবদমান স্থানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চান এবং আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব¡ দিয়ে আমেরিকানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করতে চান।
এই বলে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ইউরোপের নেতাদের দায়ী করে জানান যে তারা বিগত তিন বছরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে একটিবারের জন্য হলেও কথা বলেননি। তার মতে ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বাস করে যে আলোচনাই হচ্ছে সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। এ প্রসঙ্গে গ্রেনেল উল্লেখ করেন ইউরোপে এত বৈদেশিক মন্ত্রী ছিলেন, আমেরিকায় ছিল অনেক উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে তারা কেউ এ যুদ্ধ বন্ধে কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে দুঃখজনক হলেও সত্য যে জো বাইডেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বিগত সাড়ে তিন বছরে একবারের জন্য হলেও নিজেদের মধ্যে কথা বলেননি।
দাভোসের বার্ষিক সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমেরিকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন রিপাবলিক দলের দুজন সিনেটর, তারা উভয়েই একটু কৌশলী হয়ে ভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে, আমাদের কাছে এখন আমেরিকা সবার উপরে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে আমেরিকা একা চলবে। আমেরিকা বন্ধু এবং অংশীদারদের সঙ্গে নিয়েই চলবে বলে তারা দুজনেই উল্লেখ করেন। ইউরোপের অন্য নেতারা অবশ্য ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেলের বক্তব্যকে সমর্থন করেই কথা বলেন।
দাভোস সভায় উপস্থিত ছিলেন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। তিনি প্রথমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সবার আগে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান। এ সভায় ন্যাটোর সাবেক প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ উপস্থিত ছিলেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তিনি বলেন যে তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ হচ্ছে যে যুদ্ধে হেরে যাওয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক এস্ক (টুইটার) বার্তায় জানিয়ে দেন, রাশিয়া যদি যুদ্ধ বন্ধ আলোচনায় সম্মত না হয় তা হলে তার প্রশাসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেক উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করবে এবং অধিক মাত্রায় বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এ কথার পাশাপাশি ট্রাম্প এটাও বলেছেন যে, তিনি পুতিনকে চটাতে চান না। তিনি যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে একটা পরিষ্কার মেসেজ দিয়ে বলেছেন যে , যুদ্ধ বন্ধ হতে হবে। তাতে সেটা হয় খুব সহজে হবে, না হয় কঠিনভাবে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমেরিকা এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রশক্তি, বিশেষ করে ন্যাটোর সদস্য দেশ একযোগ জোটবদ্ধ হয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করেছে। এ যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে ইউক্রেনকে আমেরিকা এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র একজোট হয়ে অর্থ দিয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং সব প্রকার সমর্থন জুগিয়েছে। আমেরিকা এবং ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে একসঙ্গে রাশিয়ার বিপক্ষে সব ধরনের অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। যেমন- রাশিয়ার ওপর কঠোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা রাখা রাশিয়ার ডলার হিসাব জব্দ করা, রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে সুইফট থেকে বহিষ্কার করা এবং এরকম আরও অনেক পদক্ষেপ আমেরিকা এবং তাদের পশ্চিমা মিত্র দেশ একযোগে গ্রহণ করেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ইউক্রেন সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সিযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহযোগিতার প্রশ্নে আমেরিকা এবং ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কোনোরকম মতবিরোধ লক্ষ করা যায়নি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভের পর থেকেই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে, যা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে সুইজারল্যান্ডের দাভোস সভায়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এ সভায় যে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, তা হচ্ছে- (১) লক্ষ্যহীন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমেরিকা আর একটি ডলারও ব্যয় করবে না, (২) আমেরিকা অনতিবিলম্বে রাশিয়া-ইউক্রেনযুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে এবং এ জন্য তারা সবধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত আছে, (৩) আমেরিকা ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করারও বিপক্ষে, কেননা এতে অকারণে ন্যাটোর খরচ বৃদ্ধি পাবে, যা আমেরিকাকেই বহন করতে হবে, (৪) ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র যদি তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ন্যাটোতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে, সে ক্ষেত্রে আমেরিকা তাদের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে, (৫) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এই প্রথমবারের মতো ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্যে এলো এবং (৬) সর্বোপরি ন্যাটোর ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে।
ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধে জোরালো ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার এবং সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোস সম্মেলনে আমেরিকান প্রতিনিধিদের স্পষ্ট বক্তব্য এটাই ইঙ্গিত করে যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর বেশি দিন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা নেই। এ যুদ্ধে রাশিয়া জয় পাবে, নাকি ইউক্রেন জয় পাবে, নাকি উভয় দেশ নিজেদের এক ধরনের মুখ রক্ষার অর্জন নিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি টানবে- তা হয়তো সময় বলবে। তবে যেভাবেই হোক না কেন, এই যুদ্ধ যে একটি পরিসমাপ্তির দিকে চলেছে, সেটা তো ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। শুধু তাই নয়, এ যুদ্ধের ইতি টেনে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে পাশাপাশি সুপ্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে শুরু করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।