কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন বছর এবং নতুন নাটকীয়তা

ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন বছর এবং নতুন নাটকীয়তা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনা শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এই আলোচনায় রুশ এবং মার্কিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মধ্যকার আলোচনা শেষে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে বলে জানানো হলেও এই আলোচনায় ইউক্রেনকে সংযুক্ত করা হয়নি। ট্রাম্প ও পুতিনের আগ্রহে এই আলোচনায় ইউক্রেনকে রাখা না রাখা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির দিকে তোপ দাগা হয়েছে। তাঁকে স্বৈরশাসক হিসেবে এবং দেশের ভেতর একজন অজনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্পের বিশেষ উপদেষ্টা ইলন মাস্ক।

 

 

 

মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, তা হলো এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাদের দিক থেকে ইউক্রেনকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করা হচ্ছে না। তারা বরং এটিই মনে করছে যে মার্কিন অর্থ সহায়তা বন্ধই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে এই যুদ্ধে এত দিন ধরে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো বিশাল অঙ্কের অর্থ সহায়তা করে এলেও এটি যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত অর্থের তুলনায় অতি নগণ্য। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই ইউক্রেন নিয়ে কোনো না কোনো মন্তব্য করছেন।

 

 

তাঁর সর্বশেষ বক্তব্যে তিনি জানিয়েছেন, ইউরোপ যে অর্থ এত দিন পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে দিয়েছে, সেটি ঋণ হিসেবে দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দেওয়া হয়েছে এই যুদ্ধে সহায়তা হিসেবে। তিনি ভবিষ্যতে আর কোনো অর্থ এর পেছনে খরচ করতে রাজি নন, উপরন্তু তাঁদের দিক থেকে দেওয়া শত শত কোটি ডলার অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা চান তিনি। একই সঙ্গে অন্তত কোনো না কোনো উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যেন তার দেওয়া অর্থের প্রতিদান দেওয়া হয়, তার নিশ্চয়তা চান।

 

 

 

এ ক্ষেত্রে তিনি ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থ কিংবা তেলের অংশীদারির বিনিময়ে তাঁদের দিক থেকে দেওয়া সহায়তার উসুল করতে চান। তিনি অর্থের পরিমাণটা উল্লেখ করতেও ভোলেননি। তাঁর ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া ৩০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ৫০০ কোটি ডলার বাণিজ্য করতে চায় ইউক্রেনে।’ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাওয়া বিরল খনিজ পদার্থের অংশীদারির দাবিকে এরই মধ্যে খারিজ করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। জবাবে ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হলে হয় জেলেনস্কিকে দ্রুত সরে যেতে হবে, নয়তো তিনি ইউক্রেনকে হারাবেন। সে ক্ষেত্রে এর দায় পুরোটাই জেলেনস্কির ঘাড়ে এসে বর্তাবে।

 

 

 

ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন যুদ্ধ বন্ধ ও এর পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে পরোক্ষভাবে অর্থপ্রাপ্তির দিকটি জানানো হয় এবং ইউক্রেনের দিক থেকে তা খারিজ করে দেওয়া হলো। এর আগে তিনি তিন দিনের ব্যবধানে দুই রকমের কথা বলেছেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন যে রাশিয়া এই যুদ্ধ শুরু করেছে। এর তিন দিনের মাথায় তিনি এই যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করে জানিয়েছেন যে ইউক্রেনের এটি শুরু করতে দেওয়া উচিত হয়নি, অর্থাৎ যে ন্যাটোতে যোগদান করা না করা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল, তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ উন্মুক্ত ছিল।

 

 

এর জন্য তিনি কি সত্যি ইউক্রেনকে দায়ী করতে পারেন কি না, সেটি নিয়ে সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে। ইউক্রেন যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে উসকানি এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো নিশ্চয়তা না পেত, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার একার পক্ষে এই যুদ্ধে জড়িত হওয়ার কোনো কারণ থাকত না। একই সঙ্গে এটিও সংগত যে প্রতিবেশী রাশিয়ার দিক থেকে সম্ভাব্য হামলা এবং প্রতিনিয়ত হুমকি মোকাবেলায় তার নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচ্য ছিল। একই সময়ে এখানে ইউক্রেনের স্বার্থের সঙ্গে ইউরোপের স্বার্থের সম্মিলন ঘটেছিল বলেই ইউরোপের পক্ষ থেকে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালানোর যুক্তি স্পষ্ট ছিল। জো বাইডেনের সময়ে কেবল নয়, এত দিন ধরে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে অভিন্নভাবে দেখা হলেও সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ট্রাম্পের অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এক ধরনের বৈপরীত্যের প্রকাশ ঘটছে।

 

 

 

পরিস্থিতি বলছে, ট্রাম্প এত দিন ধরে চলে আসা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অতীতের বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের নানা রকম বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলেও আলোচনার মধ্য দিয়ে এর নিসরন ঘটেছে। এবার ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প ইউক্রেন এবং ইউরোপকে আলোচনার বাইরে রেখেই এর সুরাহা করতে চাচ্ছেন, যার মধ্য দিয়ে কেবল ইউরোপ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়েও তিনি নতুন করে কী ধরনের সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন এটি একটি ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

এদিকে এত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোকে অভিন্ন নীতিমালার আলোকে দেখে এলেও পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করেছে কিছুদিন আগে মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলনের পর থেকে। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে নতুন আগ্রহের দিকটি হচ্ছে, তারা চায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের রক্ষণশীল দলগুলোর মধ্যকার নতুন জোট গড়ে উঠুক। একই সঙ্গে গত ১৯ তারিখে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তিনি এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন মিলে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে একমত হয়েছেন।

 

 

এই ঘটনা ইউরোপের জন্য একটি আকস্মিক ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বিষয়, যা ইউরোপের নিরাপত্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত—এমন একটি জরুরি সিদ্ধান্তের আগে তিনি একতরফাভাবে তাঁর নিজের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে ইউরোপের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংকটের বাইরেও নতুন করে রাশিয়ার উত্থানের মধ্য দিয়ে গোটা ইউরোপের নিরাপত্তাহীনতার বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দপ্তরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করার পর ইউক্রেনের নিরাপত্তার দিকটি ইউরোপকেই সামলাতে হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন কোনো মার্কিন সহায়তা দেওয়া হবে না। এই মুহূর্তে ইউরোপ এ ধরনের বিষয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। সেই সঙ্গে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না—এমন মার্কিন সিদ্ধান্ত ইউরোপের ওপর এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়, যা প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপের দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। 

 

 

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের বক্তব্য ইউরোপকে হতাশ করেছে এবং নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছে। ভ্যান্স কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই ইউরোপকে দায়ী করেছেন এই বলে যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপের দেশগুলো বাকস্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে রোধ করেছে। ভ্যান্সের এই বক্তব্য এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপের সম্পৃক্ততা ছাড়াই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগ থেকে ইউরোপের কাছে এটিই দৃশ্যমান হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউরোপের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে নতুন করে বিনির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলোর কোনো ভূমিকা থাকবে না। 

 

 

সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের উদ্যোগ এবং রিয়াদে রুশ-মার্কিন দুই দেশের মধ্যকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যকার আসন্ন বৈঠকে যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে। এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নতুন মেরুকরণ আসতে যাচ্ছে বলে মনে করছে অনেকেই। পরিস্থিতি যখন এমন অবস্থায়, এশিয়ার দুই শক্তি ভারত ও চীন নতুন এবং পরিবর্তিত এক বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের উত্থানের প্রবল সম্ভাবনা দেখছে। তারাও এটিই ভাবছে যে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের এই সখ্যের মধ্য দিয়ে রাশিয়াই দিনশেষে লাভবান হবে এবং চীন ও ভারতের নতুন করে উত্থান ঘটবে। বিষয়গুলো যে ট্রাম্প একেবারে অনুধাবন করছেন না তা নয়, তাঁর পরিকল্পনা এখনো স্পষ্ট না হলেও এটি ভাবতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে দুর্বল করে রাশিয়াকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে না।

 

 

বিষয়টি এমন হতে পারে যে পুতিনের সঙ্গে সমঝোতার মধ্য দিয়ে তিনি ইউক্রেনের ভূমিতে রাশিয়ার আক্রমণকে বন্ধ করতে সচেষ্ট হবেন এবং বিনিময়ে তিনি ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত রাখতে রাশিয়াকে নিশ্চয়তা দেবেন। প্রশ্ন আসতে পারে, ইউক্রেনের মতো একটি সার্বভৌম দেশে মার্কিন প্রশাসনের এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা কিভাবে সম্ভব। বিষয়টি খুব স্বাভাবিক, এরই মধ্যে জেলেনস্কির নিজ পদে থাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। হয়তো মার্কিন প্রশাসন খুব শিগগির তাঁকে পদ থেকে সরাতে সব ধরনের তৎপরতাই শুরু করবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন পছন্দের একজন এই পদে অভিষিক্ত হতে পারেন। আর ইউরোপকে ইউক্রেনের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব এবং সেই সঙ্গে আর্থিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা বজায় থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় পাওনা হবে দেশটির বিরল খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, যার মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রত্যাশিত আর্থিক অর্জনের বিষয়টির নিশ্চয়তা ঘটতে পারে।

 

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়