রাশিয়া কি পোল্যান্ড আক্রমণ করছে
রাশিয়াকে পরাস্ত করতে ইউরোপীয় দেশগুলো ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে আসছে। ইউক্রেন ও পোল্যান্ড একটি কনফেডারেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে-মো: বজলুর রশীদ । সূত্র : নয়া দিগন্ত, ০৭ এপ্রিল ২০২৫

রাশিয়াকে পরাস্ত করতে ইউরোপীয় দেশগুলো ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে আসছে। ইউক্রেন ও পোল্যান্ড একটি কনফেডারেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়া মনে করে, এই কনফেডারেশন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি সামরিক জোট। সমালোচকরা বলছেন, এতে পোল্যান্ড ও ইউক্রেন হয়তো তুরস্ক এবং আজারবাইজানের মতো ‘এক জাতি-দুই রাষ্ট্র’-এর মতো থাকবে। আরো বলা হচ্ছে, ‘একটি স্বাধীন ইউক্রেন ছাড়া, কোনো স্বাধীন পোল্যান্ড হতে পারে না।’ পোল্যান্ড-ইউক্রেন কনফেডারেট রাষ্ট্রে একীভূত হওয়ার পথে রয়েছে। তাই রাশিয়ার জন্য পোল্যান্ড একটি সমস্যা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। পুতিনের কাছে ইউক্রেন শেষ। পুতিন স্পষ্ট বলেছেন, ‘হয় আত্মসমর্পণ করো নতুবা মরার জন্য প্রস্তুত হও।’ এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো যেকোনোভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। নতুবা পুতিন দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু করবেন এবং ন্যাটো ও পশ্চিমা দেশগুলো টার্গেট হবে।
ট্রাম্প রাজনীতিতে অনেক পরিপক্ব হয়েছেন এবং অনেক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি বোঝেন ইউক্রেন প্রায় শেষ, তাই প্রকাশ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর ভার বইতে চায় না। গত ৪ মার্চ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করার তাগাদা দিয়ে আসছেন। যুদ্ধে কয়েক লাখ রুশ ও ইউক্রেনীয় সেনার পাশাপাশি, ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়েছে। কিন্তু জেলেনস্কি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ট্রাম্প কিয়েভের চেয়ে মস্কোর জন্য বেশি সুবিধাজনক শর্তে সঙ্ঘাত সমাধানের চেষ্টা করছেন। এ দিকে রাশিয়া ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। পুতিন এসব জায়গা ছাড়াবেন না। অথচ জেলেনস্কি শান্তি আলোচনার আগে এসব দাবি করে সঙ্ঘাত জিইয়ে রাখছেন। কেননা, যুদ্ধ বন্ধ হলেই ট্রাম্প ও পুতিন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। এই নির্বাচনে জেলেনস্কি আর ফিরে আসবেন না। পুতিন এখনই ইউক্রেনে কেয়ারটেকার সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
ট্রাম্প ইউক্রেনকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার বিনিময়ে মুনাফা অর্জনের ওপর জোর দেন। ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেন আমেরিকার কাছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ ঋণী। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সেখানে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছি, সেই সমমূল্যের বিরল খনিজসম্পদ চাই।’ তাই যেকোনো সময় যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে আর সেটি পোল্যান্ডের জন্য মহা দুর্যোগের শুরু হতে পারে। ট্রাম্প চান, তিনি ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন, যার ফলে আমেরিকা কিয়েভের লাভজনক ‘রেয়ার আর্থ’ খনিজের ওপর বস্তুত অধিকার পাবে। এর ফলে রাশিয়ার তিন বছরব্যাপী আগ্রাসী যুদ্ধে ওয়াশিংটন ইউক্রেনকে যে অস্ত্র পাঠিয়েছিল, তার মূল্য পুষিয়ে নেবে ওয়াশিংটন।
ট্রাম্প ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনকেই দায়ী করেছেন। যুদ্ধের পর থেকে ৭০ লক্ষাধিক ইউক্রেনীয় শরণার্থী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের দলত্যাগী সেনারাও রয়েছে। তারা অর্থের অভাবে শরণার্থীশিবিরে দিন কাটাচ্ছে। রাশিয়ার ভয়ে এবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটির ঘরের কাছের ইউক্রেনের মিত্র দেশ পোল্যান্ড-বেলজিয়াম। সরব বেলজিয়ামের মন্ত্রীরাও। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আট লাখ সেনা আছে। রাশিয়ার আছে ১৩ লাখ।
তুলনামূলকভাবে পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর বর্তমান সদস্য সংখ্যা দুই লাখ। এ দিকে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিনদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা ও জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পোল্যান্ড রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির কারণে তার সেনাবাহিনীর আকার দ্বিগুণ করতে চায়। সেনাসংখ্যা পাঁচ লাখে উন্নীত করতে পোল্যান্ডের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অনেক নারীও সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আসছে। সেনাসংখ্যা পাঁচ লাখে উন্নীত হলে সেটি ইইউর সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনীতে পরিণত হবে। ইউক্রেনের বড় সেনাবাহিনীর সদস্য থাকার পরও রাশিয়ার শক্তিশালী যে হামলা ইউক্রেন সেটি প্রতিরোধ করতে পারেনি। পোল্যান্ড মনে করে, যুদ্ধ শুরু হলে অন্যদের সহায়তার আশায় বসে থাকা কোনো কৌশল হতে পারে না। নিজেকেই সার্বিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আধুনিক অস্ত্র এবং পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে পোল্যান্ড। এই পদক্ষেপটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামরিক ব্যয় পরিকল্পনার সাথে যুক্ত। ইউরোপ ৮০০ বিলিয়ন ইউরো (৮৪০ বিলিয়ন ডলার) পর্যন্ত সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। রাশিয়া এটিকে একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছে, তারা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী টাস্কের মনে করেন, ভবিষ্যতে সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। পোল্যান্ড সামরিক সরঞ্জাম খাতে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উল্লেখযোগ্য ক্রয় ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
এর মধ্যে আছে ৪৮টি উৎক্ষেপণ স্টেশনসহ ৬৪৪টি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, ১৫ বিলিয়ন ডলারের প্রায় ৮০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, ৭৩ বিলিয়ন ডলারের ১৬টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। এ ছাড়াও হাইমার্স রকেট লঞ্চারের একটি বড় অর্ডারও পেশ করা হয়েছে। রয়টার্স নিশ্চিত করছে, পোল্যান্ড তার কৌশলগত ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্ততপক্ষে ১০০ ইউনিট রকেট লঞ্চার সংগ্রহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সামরিক বাহিনী রয়েছে একই জিনিস তারা মাত্র তিন থেকে চার মিলিয়ন ডলারে পায়। একই জিনিস বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র পাঁচ থেকে ছয়গুণ দামে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গুণ বেশি দামে অন্য দেশে মানে পোল্যান্ডে রফতানি করতে যাচ্ছে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে যেই স্কেলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পোল্যান্ড বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র অর্ডার দিয়েছে, নিশ্চিতভাবেই ইউরোপের যে পুরো কর্তৃত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ফেভারে এনে নিজের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাস্তবায়ন এবং প্রভাব বলয় তৈরির জন্য নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করেছে পোল্যান্ড।
বর্তমানে, পোল্যান্ডে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সামরিক কর্মী রয়েছে। এসব বাহিনী ন্যাটোর বর্ধিত ফরোয়ার্ড প্রেজেন্স (ইএফপি) এবং অপারেশন আটলান্টিক রিজলভের অংশ, যার লক্ষ্য ন্যাটোর পূর্বপ্রান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা। অতিরিক্তভাবে, পোল্যান্ড লাটভিয়া, রোমানিয়ায় মোতায়েন এবং একাধিক অঞ্চলে বিমান পুলিশিং অপারেশন-সহ বিভিন্ন ন্যাটো মিশনে অবদান রাখছে। এই সামরিক উপস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলছে। রাশিয়া এটি উপেক্ষা করতে পারে না।
পোল্যান্ডে মোতায়েন ১০ হাজার মার্কিন সেনা ছাড়াও ন্যাটোর আরো কয়েকটি বাহিনী দেশটির প্রতিরক্ষা অবস্থানে কাজ করছে। পোল্যান্ড ন্যাটোর বর্ধিত ফরোয়ার্ড প্রেজেন্স (ইএফপি) এবং বহুজাতিক বিভাগ উত্তর-পূর্ব (এমএনডি-এনই)-এর অধীনে বহুজাতিক ইউনিটকে হোস্ট করে, যার মধ্যে কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, রোমানিয়া, স্পেন, তুরস্ক, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্রের সেনারা রয়েছে। পোল্যান্ডে ন্যাটো প্রশিক্ষণ এবং অপারেশনাল ইউনিটও রয়েছে।
পোল্যান্ডে ন্যাটোর উপস্থিতি আঞ্চলিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে রাশিয়ার হুমকি প্রতিরোধে এবং জোটের পূর্ব অংশকে শক্তিশালী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পোল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান এটিকে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা অবস্থানে একটি ফ্রন্টলাইনে পরিণত করেছে। জোটটি পোল্যান্ডকে পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করেছে, নিশ্চিত করেছে যেকোনো আগ্রাসনের বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করা সহজ হবে।
শত শত বছর ধরে রাশিয়ার সাথে পোল্যান্ডের ঐতিহাসিক উত্তেজনা তার সুরক্ষা নীতিকে আকার দিয়েছে। রাশিয়ান সম্প্রসারণবাদের দ্বারা সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো স্বীকৃতি দিয়ে দেশটি ধারাবাহিকভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান বজায় রেখেছে। ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্সির বর্তমান ধারক হিসেবে পোল্যান্ড সক্রিয়ভাবে ইউরোপীয় সুরক্ষানীতি গঠন করছে, শক্তিশালী ন্যাটো-ইইউ সহযোগিতার পক্ষে পোল্যান্ড বড় সমর্থক। রাশিয়া নিশ্চিত জয় লাভের সব দিক হিসাব করেই হামলা চালাবে।
পোলিশ সরকারের ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন মস্কোতে একটি বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, পুতিনের শীর্ষ সহযোগীরা পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। পুতিনের রাজনৈতিক দলের একজন শীর্ষ সদস্য রাশিয়াকে ইউক্রেনের সাথে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরামর্শ দিয়েছেন। পোল্যান্ড আক্রমণ করা যুদ্ধের এক অংশ। এসব মন্তব্য ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে আরো উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। পোল্যান্ড ন্যাটোর ৩০টি সদস্য দেশের একটি, যার অর্থ হচ্ছে- পোলান্ডকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার রাশিয়ার সম্ভাব্য প্রচেষ্টা ন্যাটোর সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া উসকে দেয়া। পুতিন পোল্যান্ড আক্রমণের কোনো ইঙ্গিত না দিলেও সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। পোল্যান্ডের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাভেল জেবলনস্কি বলেছেন, ‘পুতিন পোল্যান্ডে হামলা চালাতে চান, এটি নিশ্চিত।’ তবে, রাশিয়া পোল্যান্ডে সরাসরি সামরিক আক্রমণ করবে কি না জোর দিয়ে বলা যায় না।
ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুট স্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, পোল্যান্ডের ওপর যেকোনো হামলা হলে জোটের ‘পূর্ণ শক্তি’ দিয়ে ‘ধ্বংসাত্মক’ জবাব দেয়া হবে। সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের পরিবর্তে রাশিয়া পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশলে লিপ্ত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে অভিবাসনকে অস্ত্র করা এবং পোলিশ সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলা। এই পরোক্ষ পদ্ধতিগুলো রাশিয়াকে সরাসরি যুদ্ধের উসকানি না দিয়ে চাপ প্রয়োগের শক্তি দেবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার