কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে কৌশলগত চুক্তি

ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে কৌশলগত চুক্তি

গত ১৭ জানুয়ারি মস্কোতে রাশিয়া ও ইরানের প্রেসিডেন্টদের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে একটি বিস্তৃত কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ইরান ও রাশিয়া উভয়েই কার্যত পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের জেরে এক অভিন্ন উদ্বেগ প্রশমনে যৌথভাবে ভবিষ্যতে একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার করল। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা খাত উল্লেখ রয়েছে। চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো দুই দেশের মধ্যে এমন এক অঙ্গীকার, যার ফলে একে অপরের হামলাকারীদের অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করবে না।

 

 


তবে এ ক্ষেত্রে গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশ ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্কের চেয়ে এই চুক্তিটির ভিন্নতা হচ্ছে সে দেশগুলোকে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি সহায়তা দেওয়ার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ইরানের ক্ষেত্রে রাশিয়া এই বিষয়টিকে উহ্য করে যাওয়ার কী কারণ, সেসব বিশ্লেষণ করতে গেলে এই মুহূর্তে এটিই বলা যায় যে বিষয়টি এখানে প্রকাশ্য না থাকলেও একে অপরকে অপ্রকাশ্য সহযোগিতা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই।

 

 

ইরানের মধ্যপ্রাচ্যের নীতির বরাবর সমর্থক রাশিয়া এবং ইরানকে মুখ্য করেই মূলত রাশিয়া প্রকাশ্যে না থেকেও সেখানকার রাজনীতিতে এক ধরনের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ার সরকার পতনের পর ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার এ ধরনের নতুন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার বিষয়টির মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারি।

 

 


আজ থেকে ১৪ বছর আগে আরব বসন্তকে কেন্দ্র করে যখন মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক দেশের সরকার পতন ঘটেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু চেষ্টা করেও এবং সরাসরি সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়েও প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে তাঁর ক্ষমতা থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল রাশিয়া। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার শক্তির মূল উৎস ছিল ইরান। সুতরাং এর মধ্য দিয়ে আমরা ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত সম্পর্কের ইতিহাস খুঁজে পেতে পারি।

 

 

বর্তমান সময়ে এসে বৈশ্বিক রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে কৌশলগত চুক্তিরাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো একদিকে রাশিয়াকে এবং অন্যদিকে ইরানকে পরাস্ত করতে জোটবদ্ধ হয়েছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান অনেকটাই ধরাশায়ী অবস্থায় রয়েছে। রাশিয়াকে একাই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে গোটা পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তবে এখানেও ইরানের এক ধরনের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।

 

 

পশ্চিমা শক্তিগুলো অনেক দিন ধরেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের পক্ষ থেকে রাশিয়ার কাছে ড্রোন এবং অন্যান্য অস্ত্র বিক্রির অভিযোগ করে আসছে। সুতরাং উত্তর কোরিয়া ও বেলারুশের তুলনায় এই চুক্তির গুরুত্ব কোনো অংশেই কম থাকার কারণ নেই। এখানে ইরানের সঙ্গে আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র দিয়ে একে অপরকে সহায়তা না করার বিষয়টি চুক্তিতে উল্লেখ না থাকার আরো কারণ হচ্ছে, এই মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধে বিপর্যস্ত রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়া ইরানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সরাসরি হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে তা মোকাবেলা করা কঠিন।

 

 

বিষয়টিকে বরং এমনভাবে উপস্থাপন করা, যার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে একটি বার্তা দেওয়া যে তারা ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে পশ্চিমারা প্রক্সি যুদ্ধ করছে এবং এই যুদ্ধকে আরো উসকে দিচ্ছে, যা রাশিয়াকে নিজের টিকে থাকার স্বার্থে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য করছে।

 

 

এই চুক্তি স্বাক্ষর বিশ্বকে আরো ‘ন্যায়সংগত এবং ভারসাম্যপূর্ণ’ করবে বলে মন্তব্য করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। এটি দিয়ে কার্যত রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধ শক্তিগুলোর বর্তমান অবস্থাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। ২০ বছর মেয়াদি এই কৌশলগত চুক্তির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে পারস্পরিক সামরিক মহড়ার বিধান যুক্ত করেছে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং সংস্কৃতিসহ অপরাপর স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় এই চুক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকবে।

 

 

এটি এত দিন ধরে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতার সম্পর্ককে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ যেমন দিয়েছে, একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এই মর্মে একটি বার্তাও দিয়েছে যে ইরানের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে হলে রাশিয়াকেও বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান সময়ে রাশিয়া ও ইরান অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে, এটিও একটি বড় বার্তা।

 

 

অনেক দিন ধরেই ইরান পশ্চিমা দেশগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আছে। ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ইরান। এই ইরানের সহায়তায়ই পরিচালিত হয়ে আসছে ইসরায়েলবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী, যারা মার্কিন এবং পশ্চিমাদের ভাষায় ‘সন্ত্রাসী’, তাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ ইরান। এ ক্ষেত্রে এসব প্রক্সি গোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবং পশ্চিমা রক্তচোখকে মোকাবেলা করতে হলে ইরানের আরো শক্তি অর্জন প্রয়োজন।

 

 

যেহেতু ইরান ও রাশিয়া জোটবদ্ধ পশ্চিমা শক্তির তুলনায় অনেকটাই দুর্বল, তাই একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক জোটবদ্ধতা তাদের সমন্বিতভাবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সহয়তা করতে পারে। পশ্চিমা শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য না রেখে এ ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টির প্রয়াস এটি। আর সে জন্যই এই চুক্তিকে নিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ‘আমরা একটি বহুপক্ষীয় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার পথে এগোতে চাই এবং এই পথের উদ্দীপক শক্তি হলো এই চুক্তি।’ এটির মধ্য দিয়ে ইরান নতুন করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আরো চাঙ্গা করবে কি না, সেটিও একটি বিবেচনার বিষয়। এ জন্যই হয়তো তারা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ছায়া প্রত্যাশা করেছিল।

 

 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে এমন এক সময় এ ধরনের বিস্তৃত কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মাত্র তিন দিনের মাথায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় ফিরেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি গাজা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানার ঘোষণা দিয়েছিলেন, একই সঙ্গে পরোক্ষভাবে ইরানের প্রতি অনেকবারই কঠিন হুঁশিয়ারি প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর আগের মেয়াদে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন তিনি। তাঁর সময়েই ইরানের বিপ্লবী গার্ডের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়।

 

 

 তিনিই ইরানের বিরুদ্ধে তাদের বিজ্ঞানী এবং সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ‘দায়িত্ব গ্রহণের আগে গাজা যুদ্ধ বন্ধ না হলে এর জন্য দায়ীদের নরকের স্বাদ নিতে হবে’—এ ধরনের উক্তির মধ্য দিয়ে তিনি ইরানকেই ইঙ্গিত করেছেন। জানা গেছে, বর্তমান অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান ও নিরাপত্তাকে সুসংহত করতে ইরান এখন পুরোদমে তার পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এবং পরমাণু বোমা তৈরির অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে। এমন অবস্থায় ইসরায়েলকে রক্ষা করতে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ হুমকি মোকাবেলায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে আর কোনো ধরনের ছাড় দিতে চাইবে না।

 

 

তড়িঘড়ি করে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে হামাসকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে, হিজবুল্লাহও এখন নতুন করে হামলা সংঘটিত করার মতো অবস্থায় নেই। হামাস ও হিজবুল্লাহকে নেতৃত্বশূন্য করে যুদ্ধ বন্ধ চুক্তি করে ইসরায়েলের এখন একটিই লক্ষ্য এই অঞ্চলে তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। মধ্যপ্রাচ্যে এই মুহূর্তে ইরানকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দেওয়ার মতো কোনো রাষ্ট্র নেই। এই একলা চলো নীতি নিয়ে সামনের দিনগুলো ইরানের জন্য অনেক কঠিন হবে।

 

 

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো। আগের মেয়াদে তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকার কথা তিনি যদি বিবেচনায় রাখেন, তাহলে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সখ্য ট্রাম্পের পছন্দ না হলেও তিনি খুব একটা কঠিন নীতি গ্রহণ না-ও করতে পারেন। তবে এর জন্য ইরানের ভূমিকারও গুরুত্ব রয়েছে। তাকে তার পরমাণু কর্মসূচি থেকে সরে আসতে হবে।

 

 

এটি যদিও ইরানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, তবে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে উভয়ের জন্যই এটি ভালো হবে। এটির জন্য অবশ্যই ভূমিকা পালন করতে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। সুতরাং সব কিছু বিবেচনায় নিলে এই মুহূর্তে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার চুক্তি ইরানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য একটি দর-কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

 

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়