কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

রেমিট্যান্সের ওপর ট্রাম্পের করারোপ, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

সৈয়দ ফারুক হোসেন [ সূত্র : সময়ের আলো, ২৮ মে, ২০২৫]

রেমিট্যান্সের ওপর ট্রাম্পের করারোপ, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রেমিট্যান্স আয়ের অন্যতম বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ৩৯৪ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। তার আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল। সে অর্থবছরে ২৯৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। ওই বছর সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে আরব আমিরাত থেকে, ৪৬০ কোটি ডলার। বিশেষত ছোট অঙ্কের রেমিট্যান্স যারা পাঠাবেন, তাদের প্রভাবিত করবে।
 
 
 
বাণিজ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের পর এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপ করতে যাচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস বাজেট কমিটিতে অনুমোদিত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’-এর ক্ষমতাবলে এ করারোপ করা হবে। এই আইনে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছাড়া যেকোনো অভিবাসীর পাঠানো টাকার ওপরই করারোপ করা হবে।
 
 
অর্থাৎ যারা গ্রিন কার্ডধারী কিংবা এইচ-১বি বা অন্যান্য কাজের জন্য ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন তারাও এই করের আওতায় পড়বেন। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো এই করের ক্ষেত্রে কোনো ন্যূনতম সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। অর্থাৎ এক ডলার রেমিট্যান্স পাঠালেও তার ওপর কর প্রযোজ্য হবে। এমনকি এই করের ক্ষেত্রে ন্যূনতম অর্থ ছাড় নেই। অর্থাৎ দশ ডলার পাঠালেও এর ওপর পাঁচ শতাংশ কর কাটা হবে। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এবং রাজস্ব আয়ের নতুন উৎস খুঁজছে। সে ধারায় ট্রাম্পের এই কর প্রস্তাব।
 
 
 
ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্য, প্রবাসীরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ উপার্জন করে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাঠানোর কারণে দেশ থেকে অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে। এ প্রবাহ বন্ধ করা এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াতে রেমিট্যান্সে কর বসানো হলো। এতে অভিবাসন ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে দাবি ট্রাম্পপন্থিদের।
 
 
 
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। আর তা হলো, দেশের ভেতরের করদাতাদের সন্তুষ্ট করা এবং অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানের বার্তা দেওয়া। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে বিশ্বব্যাপী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
 
 
 
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্য দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে কর বসাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আইন প্রস্তাব করেছেন, তা পাস হলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে হুন্ডির মতো অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হতে পারেন প্রবাসীরা। এর ফলে রিজার্ভের জন্য বড় ধাক্কার কারণ হবে। এর আগেও ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশকে প্রভাবিত করেছিল। এখন রেমিট্যান্সেও কর আরোপ হলে তা একই ধারার অংশ বলেই ধরা হচ্ছে।
 
 
 
বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক থেকে সবচেয়ে বেশি ডলার আসে এই যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আবার রেমিট্যান্সও এখন সবচেয়ে বেশি আসছে এই দেশ থেকে। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরেই বড় সংকটে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন বা রিজার্ভ নিয়ে। সেই রিজার্ভের উৎস রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স। আর এই দুই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আমদানির ওপর তার পাল্টা শুল্ক স্থগিতে যেটুকু স্বস্তি মিলেছিল, তা উবে যাচ্ছে রেমিট্যান্সে শুল্ক আরোপের ঘোষণায়। ফলে শঙ্কার চিন্তা বাড়বে রিজার্ভের। এ আইন কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশিসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
 
 
 
রেমিট্যান্সের ওপর কর বসিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আইন করলে প্রবাসীদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে। তাতে ‘অনানুষ্ঠানিক উপায়ে’ দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়ে যাবে। গত কয়েক দিনে রেমিট্যান্সের প্রবাহ তুলনামূলকভাবে ভালোই বেড়েছে, যা এ মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য দরকার। তা ছাড়া ডলার বাজার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এই নতুন আইন পাস হলে অবশ্যই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। এ ক্ষেত্রে করের কোনো ছাড় সীমা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ যেকোনো অঙ্কের অর্থ পাঠালেই কর দিতে হবে।
 
 
 
তবে কেউ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলে তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। ব্যাংকিং চ্যানেলে বাড়তি ৫ শতাংশ করারোপ হলে তো তখন অনেকেই পাঠাবেন না। বিকল্প হিসেবে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাবে। তাতে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর। কারণ মাঝে রেমিট্যান্স আসা কমেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিরা যারা নিয়মিত দেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকেন পরিবারের ব্যয় মেটাতে বা বিনিয়োগের জন্য তারা আগের মতো পুরো অর্থ পৌঁছে দিতে চাইলে তখন খরচ করতে হবে বাড়তি ডলার। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২৩ সালের তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক তিন লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন।
 
 
 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রেমিট্যান্স আয়ের অন্যতম বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ৩৯৪ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। তার আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল। সে অর্থবছরে ২৯৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। ওই বছর সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে আরব আমিরাত থেকে, ৪৬০ কোটি ডলার। বিশেষত ছোট অঙ্কের রেমিট্যান্স যারা পাঠাবেন, তাদের প্রভাবিত করবে। বিদেশের নীতিগত চ্যালেঞ্জ হলেও দেশে এর গুরুতর প্রভাব থাকবে। আমাদের জন্য এটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বৃহত্তম রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ।
 
 
 
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন। এর কারণ এটি রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যয় হ্রাসে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। এটি শুধু বাংলাদেশের ব্যাপার নয়। ক্ষতির শিকার হতে যাওয়া সব দেশের সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তোলা উচিত। বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগের সময় প্রবাসীরা রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের এযাবৎকালের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অন্যতম জ্বালানি হলো রেমিট্যান্স।
 
 
 
 
এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির প্রধান নায়ক, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা প্রতিকূল পরিবেশে অমানবিক পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন। যে রেমিট্যান্সের প্রতিটি স্তরে রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ আর দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাইকে দূরে রেখে হাসিমুখে শ্রমে-ঘামে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিনের পর দিন প্রেরণ করে আসছেন আমাদের অভিবাসী ভাই-বোনেরা। রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই দেশের রিয়েল হিরো। অল্প বয়সে বিদেশ গিয়ে, কাছের মানুষ দূরে রেখে, শখ-আহ্লাদ ভুলে গিয়ে, দিন-রাত কাজ করে, প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে থাকার দুঃখ বুকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে আপন মানুষকে ভালো থাকতে ও ভালো রাখতে তারা দেশে এ অর্থ প্রেরণ করে থাকেন। রেমিট্যান্স আহরণে সরকারের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। রফতানি আয়ের সঙ্গে তুলনা করলে যোগ-বিয়োগের হিসাবে প্রবাসীদের প্রেরিত এ আয়কেই আমরা প্রধান আয় হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
 
 
 
রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দেশের রিয়েল হিরো রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা এবং সর্বোপরি আমাদের অভিবাসী ভাই-বোনেরা বিদেশে অবস্থান করেও দেশপ্রেমের যে উদাহরণ রেখে চলছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আমাদের প্রবাসী আয় আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। প্রবাসী আয় হলো দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস।
 
 
 
 
এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না বা কোনো দায় পরিশোধ করার দরকার পড়ে না। রফতানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধেও ডলারের প্রয়োজন হয়। সার্বিকভাবে প্রবাসী আয় বাড়ালে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
 
 
 
 যেহেতু মানুষ তাদের আয়ের ওপর কর দেওয়ার পর রেমিট্যান্স পাঠায়, তাই সেই রেমিট্যান্সের ওপর আবার করারোপ করা অন্যায্য হবে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস, এর প্রভাব খুবই বেশি হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি হবে। এটি আমাদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহে একটি বিশাল আঘাত হানবে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে দ্রুত ডলার আয়ের বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রবাসীদের জন্য বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠানো সহজ ও লাভজনক করে তুলতে হবে। তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে।