রণশক্তিতে ভারত-পাকিস্তান
[সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৮ মে, ২০২৫]

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে। তখন থেকেই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সে আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হলো। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ১৫ দিন পর গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টায় পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছে ভারত। পাকিস্তানও দ্রুত পাল্টা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে দুই দেশের বৃহৎ পরিসরে আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এখন চরমে। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় সে সম্ভাবনা আরও বেড়েছে।
সমর বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের পর এবারই চিরবৈরী দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেবারই প্রথমবারের মতো পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ্যে এসেছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের শঙ্কা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি। প্রাসঙ্গিকভাবে তাই ভারত-পাকিস্তানের সামরিক শক্তি কেমন ও কতটা তীব্র সে প্রশ্ন ঘুরে ফিরছে। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার সূচক (জিএফপি) ২০২৫’ অনুসারে উভয় দেশের সামরিক সক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সমরক্ষেত্রে পাকিস্তানের থেকে ভারত এগিয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতায় বৈচিত্র্য রয়েছে। যা ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতায় খুব একটা পিছিয়েও নেই ইসলামাবাদ।
সামরিক র্যাংকিং ও সক্ষমতা সূচক : ‘জিএফপি ২০২৫’-এ ৬০টির বেশি বিষয়ের (জনশক্তি, সামরিক সরঞ্জাম, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থা ইত্যাদি) ভিত্তিতে ১৪৫টি দেশকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, সামগ্রিক র্যাংকিংয়ে ভারত বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ। সক্ষমতা সূচকে স্কোর ০.১১৮৪ (০.০০০০ মানকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়)। অন্যদিকে ০.২৫১৩ স্কোর নিয়ে এ তালিকার ১২তম স্থানে আছে পাকিস্তান। ভারতের বড় জনসংখ্যা, বৃহত্তর প্রতিরক্ষা বাজেট ও বিস্তৃত পরিসরের সামরিক সম্পদের প্রতিফলন এই র্যাংকিং। তবে পাকিস্তান ছোট অর্থনীতির ও নানা সীমাবদ্ধতার পরও ভারতকে মোকাবিলায় কৌশলগত বিষয়গুলোয় মনোযোগী। ফলে নির্দিষ্ট খাতগুলোয় প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে দেশটি।
প্রতিরক্ষা বাজেট : ভারতের সামরিক বাজেট (২০২৫-২৬) ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলার (যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর তৃতীয়)। এটি জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ। এ ব্যয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। আর পাকিস্তানের বাজেট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এ ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বৈদেশিক সামরিক সহায়তা ১০ কোটি ডলার।
সেনা সংখ্যা : ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি (বিশ্বে দ্বিতীয়)। ভারতের সক্রিয় সেনা ১৪ লাখ ৬০ হাজার। রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৬০ হাজার। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার। সব মিলিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতে মোট সামরিক জনবলের সংখ্যা ৫১ লাখ। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ কোটি ২০ লাখ (বিশ্বে পঞ্চম)। সক্রিয় সেনা ৬ লাখ ৫৪ হাজার। রিজার্ভ সেনা ৬ লাখ ৫০ হাজার। মোট সামরিক সদস্যের সংখা সব মিলিয়ে ১৭ লাখ।
স্থলবাহিনী : ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ৩ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। দুদেশের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৯৯ সালে প্রচলিত ঘরানার যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। ভারতের ট্যাংক ৪ হাজার ৬১৪টি। সাঁজোয়া যানের সংখ্যা ১ লাখ ৫১ হাজার ২৪৮টি। কামান ৯ হাজার ৭১৯টি। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে প্যারা এসএফ, ঘাতক ফোর্স, এমএআরসিওএস। আর পাকিস্তানের ট্যাংক ৩ হাজার ৭৪২টি। সাঁজোয়া যান ৫০ হাজার (আনুমানিক)। কামান ৪ হাজার ৪৭২টি (৩৭৫ স্বয়ংক্রিয় হাউইটজারসহ)। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি), এসএসজি নৌ ও স্পেশাল সার্ভিস উইং। এগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট হলেও সমীহ করার মতো। তবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি ও মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর বা রকেট লঞ্চারের সংখ্যায় এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি সংখ্যা ৬৬২, ভারতের ১০০। পাকিস্তানের মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর ৬০০, ভারতের ২৬৪।
বিমানবাহিনী : ভারতের বিমানবাহিনীর অধীনে রয়েছে ৩১টি স্কোয়াড্রন। প্রতিটি স্কোয়াড্রনে ১৭ থেকে ১৮টি যুদ্ধবিমান থাকে। বিপরীতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রয়েছে ১১টি স্কোয়াড্রন। ভারতের মোট বিমান ২ হাজার ২২৯টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৫১৩ থেকে ৬০৬টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এসইউ৩০ এমকেআই, রাফায়েল, তেজস। রয়েছে এস ৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। রাশিয়া থেকে ২০২১ সালে পাওয়া এস-৪০০ বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এটি মাল্টি-এএসএ রাডার ব্যবহার করে, একসঙ্গে ১০০টি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে এবং একই সঙ্গে ৩৬টিতে আঘাত হানতে পারে। এই রাডারব্যবস্থার শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তু শনাক্তকরণের পাল্লা ৬০০ কিলোমিটার। হেলিকপ্টার আছে অ্যাপাচি ও চিনুক। আরও আছে চারটি ‘এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল (এইডব্লিউঅ্যান্ডসি)’ ব্যবস্থা। গত কয়েক বছরে ভারতের বিমান বাহিনীতে বড় সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয়েছে ফ্রান্স থেকে আনা রাফাল যুদ্ধবিমান। এই বিমান পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম।
পাকিস্তানের মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯ থেকে ১ হাজার ৪৩৪টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৩২৮ থেকে ৩৮৭টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, জেএফ-১৭ থান্ডার, মিরেজ থ্রি/ফাইভ। আছে ভারতের চেয়ে বেশি যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী হেলিকপ্টার (এএইচ১এফ কোবরাসহ)। এইডব্লিউঅ্যান্ডসি আছে সাতটি, যা ভারতের চেয়ে বেশি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর দুটি অস্ত্র হলো- যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা এফ-১৬ এবং চীনের সহায়তায় তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার।
নৌবাহিনী : ভারতের জাহাজ রয়েছে ২৯৪টি। বিমানবাহী রণতরী আছে ২টি। সাবমেরিন ১৮টি (পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আইএনএস আরিহান্টসহ)। ডেস্ট্রয়ার ১৩টি। ফ্রিগেট ১৪টি। প্যাট্রোল নৌযান ১০৬টি। যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী বিমান ৭৫টি (নৌবাহিনীর)। নৌবাহিনী সদস্য সংখ্যা ৬৭ হাজার ৭০০। পাকিস্তানের জাহাজ ১২১টি। সাবমেরিন ৮টি। ফ্রিগেট ৯টি। প্যাট্রোল নৌযান ১৭টি। এ বাহিনীর যুদ্ধবিমান ৮টি। নৌবাহিনী সদস্য সংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০। ভারতীয় নৌবাহিনী তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী ও গভীর সমুদ্রে অভিযান চালানোর উপযোগী।
পারমাণবিক সক্ষমতা : ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী। তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলে এ সক্ষমতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে সুইডিশ থিংক ট্যাংক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন বলছে পারমাণবিক ওয়ারহেডের দিক থেকে দুটি দেশ প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নি–থ্রি/ফাইভ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, মিরেজ ২ হাজার ও রাফায়েল এবং সামুদ্রিক প্রতিরক্ষায় পারমাণবিক সাবমেরিন আইএনএস আরিহান্ট। পারমাণবিক অস্ত্র আগে ব্যবহার না করার নীতির পক্ষে ভারত। তবে এ ধরনের হামলার শিকার হলে ব্যাপক আকারে প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে দেশটি।
তবে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যায় ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৫০। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে আছে শাহিন টু/থ্রি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাত্র, এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, বাবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশটি ‘ফুল স্পেকট্রাম ডেটারেন্স’ নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী। এ নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে আগেভাগে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে দেশটি।
ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা : পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে ক্রুজ, ট্যাকটিক্যাল ও স্বল্প-মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ট্যাকটিক্যাল ক্ষেপণাস্ত্র যেমন হাতাফ-১ ও নাসের ৬০-১০০ কি.মি দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ২০০-১০০০ কি.মি দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। আর মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ১৫০০ কি.মি-২৭৫০ কি.মি দূরত্বে পৌঁছতে সক্ষম। অন্যদিকে ভারতের পৃথ্বী সিরিজ ক্ষেপণাস্ত্র ২৫০-৬০০ কি.মি দূরের লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। অগ্নি সিরিজ ১২০০-৮০০০ কি.মি পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে। এছাড়া আছে নির্ভয়া ও ব্রহ্মোস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্রহ্মোস পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। ২০২২ সালে একটি ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র ভুলবশত পাকিস্তানে গিয়ে পড়েছিল। ২০২৪ সালে ভারত সফলভাবে একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যার রেঞ্জ ১৫০০ কি.মির বেশি এবং এটি আকাশ, স্থল ও জলপথ, সব জায়গা থেকে আঘাত হানতে সক্ষম।