কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্যতা

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা। সূত্র : আমার দেশ, ২১ এপ্রিল ২০২৫

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্যতা

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অবশেষে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে – এমন একটা স্বস্তির আবহ যখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে, তখন রোহিঙ্গারা এ নিয়ে কী ভাবছে? তারা কি আশ্বস্ত হয়েছে যে তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে? বিশেষ করে যারা মিয়ানমার সরকারের যোগ্যতার সূচকে দেশে ফেরার জন্য ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হয়েছে, সেই ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা কি জানে যে তারা দেশে ফিরতে যাচ্ছে?

 

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হয়তো আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো মিয়ানমারের সামরিক শাসক কি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে, নাকি রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই হয়েছে বলে তারা ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছে মাত্র? বিমসটেকের সাইডলাইন বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আসলে তারা কী বলেছে?
 
 
 
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা-বিষয়ক উচ্চ-প্রতিনিধি মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনকালে জানিয়েছেন, ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই সম্পন্ন হয়েছে এবং মিয়ানমার সরকার নিশ্চিত করেছে, এখন এরা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য যোগ্য। এ সময় মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী মাথা নেড়ে সম্মতি দেন। এরপর মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী জানান, এই রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করবেন। উভয়ের কথোপকথনটি হয়েছে জনসমক্ষে।
 
 
বিষয়টিকে অনাবশ্যক আবেগের দৃষ্টি দিয়ে নয়, বরং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে যা বোঝা যায় তা হলো, মিয়ানমার সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে (নিজের মুখে তা না বললেও জনসমক্ষে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছেন) এবং এ বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা না দিলেও বাংলাদেশের সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
 
 
লক্ষণীয়, ষষ্ঠ বিমসটেকের বৈঠকে গত চার দশকের মধ্যে বাংলাদেশের হয়ে রোহিঙ্গা বিষয়ে সবচেয়ে বলিষ্ঠ অবস্থান নেওয়া মানুষটি কথা বলেছেন। আজ থেকে বহু বছর পর যদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্যের ইতিহাস লেখা হয়, সেখানে যে কটি বিষয় স্থান পাবে, তার মধ্যে একটি হলো অত্যন্ত উপযুক্ত একজন মানুষকে রোহিঙ্গা সংকট সামলানোর জন্য সরকার গঠনের মাত্র চার মাসের মধ্যে দায়িত্ব দেওয়া, যিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে জাতিসংঘের সদর দপ্তর – সব জায়গায় রোহিঙ্গাদের জন্য এবং বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছেন। গত ১৬ বছরে এভাবে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ কথা বলেননি।
 
 
রোহিঙ্গা সংকটের মতো জটিল বিষয় নিয়ে যে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্রের নিবিড়ভাবে কাজ করা প্রয়োজন, সেটিই আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা কেবল জেনেছিলাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারত, চীন ও জাপানের কাছ থেকে কত সফলভাবে স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ যেখানে ফেরার কথা, সেখানকার সরকার ছাড়া আর সবার সঙ্গেই তিনি কথা বলতেন।
 
 
আর এ জায়গাতেই বর্তমান সরকারের সঙ্গে পার্থক্য। সমস্যার সমাধান যার কাছ থেকে আসতে হবে, তার সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কথা বলেছে। আর পূর্ববর্তী সরকারের তল্পিবাহকেরা আমেরিকা থেকে শুরু করে অনেক সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে করমর্দনপূর্বক হাসি বিনিময় করেছেন এবং বলেছেন, রোহিঙ্গাদেরকে ফিরে যেতেই হবে; কিন্তু সেজন্য কী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, তা নিয়ে ভাবেননি মোটেও। এভাবেই দিন, মাস ও বছর গেছে। রোহিঙ্গাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ও কক্সবাজারের দুর্দশা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দপ্তরের সংখ্যা ও কিছু সুবিধাভোগী মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। বাড়েনি শুধু নিজ ভূমিতে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা। মানবতার আড়ালে অন্য যেসব অগ্রাধিকার কাজ করেছে, সেসব বিষয়ে তাদের মুখোশ ৫ আগস্টের পর উন্মোচিত হয়েছে।
 
 
ভূ-রাজনীতিকে পুঁজি করা বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী অজুহাত ও তৃতীয় দেশের রাজনৈতিক কু-প্ররোচনায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার জন্য যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে লেগে গেল আট বছর। তাও আবার সব রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা নিরূপণ সম্পন্ন হয়নি। অবশ্য জুলাই বিপ্লব না হলে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে কাঠামোতে আছে, তা না থাকলে এতটুকুও হতো না। সুতরাং মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিলেও যতটুকু বলেছে, ততটুকুতে স্বস্তি পাওয়া স্বাভাবিক।
 
 
কিন্তু আমরা যতই আশাবাদী হতে চাই, মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তিতে-আলোচনায়-সিদ্ধান্তে কি আমরা সত্যিই শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে পারি? আসলেই কি শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার তার দেশের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে ফিরিয়ে নেবে? মিয়ানমারের অতীত আচরণ যারা জানেন, তারা উপলব্ধি করতে পারবেন এ প্রশ্নের যৌক্তিকতা। তর্কের খাতিরে এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ-বাচক ধরে নিলেও বাস্তব প্রতিকূলতা ও ঝুঁকিগুলোকে অগ্রাহ্য করা চলে না।
মানতেই হবে, মিয়ানমার সরকারকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করানোর কৃতিত্ব বাংলাদেশের। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে যে দুটি বন্দোবস্ত সম্পাদিত হয়েছিল, তার কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি ছিল না। কেউ কেউ অবশ্য ওগুলোকে চুক্তি বলে থাকেন; কিন্তু ইংরেজিতে দুটোকেই বলা হয়েছে arrangment, agreement নয়। আমাদের দেশের যাবতীয় ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে হস্তক্ষেপকারী যে দেশ, তার মধ্যস্থতায় সম্পাদিত এ বন্দোবস্তের বিষয়াদি কেবল কাগুজে দলিল হিসেবে এতদিন ছিল। অথচ এর আলোকেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার দেশে ফেরার জন্য ‘যোগ্য’ হয়ে ওঠার স্বীকৃতি আনতে পেরেছে।
 
 
শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার তার দেশের মানুষকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবে কি না, সে প্রশ্ন উদয় হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো, রোহিঙ্গাদের যে বাসভূমি তা আজ আর রোহিঙ্গাদের নেই। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই এবং তা মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নির্দেশেই হয়েছে। তা হলে রোহিঙ্গারা কোথায় ফিরে যাবে বা একই সরকারের ওয়াদাকে কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে?
 
 
দ্বিতীয়ত, বৃহৎ শক্তিগুলো যেহেতু মানবতার চেয়ে বাণিজ্যে অধিক আগ্রহী, মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগকৃত বিপুল অর্থে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হয়, এরকম কোনো কিছু মিয়ানমার সরকার করবে না। বৃহৎ শক্তিগুলোও তা মেনে নেবে না।
তা ছাড়া মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন কি রোহিঙ্গাদের জন্য সংশোধন করতে মিয়ানমার সরকার প্রস্তুত? সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করার কথা বিবেচনায় রাখছে কি? যদি সে আইন সংশোধিত হওয়ার আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়, তা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে নিগৃহীত পরবাসী করে রাখবে।
 
 
প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক ঘোষণার পর থেকে তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন এক রকম স্থগিত হয়ে আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে দেশে ফেরার আকুতি যতটা তীব্র, এ দেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ ততটাই অনুপস্থিত। তরুণ রোহিঙ্গা যাদের জন্ম বাংলাদেশে, তারা তাদের পূর্বপুরুষের মতো মিয়ানমারের প্রতি টান অনুভব করে না। যে দেশ কখনো নিজের চোখে দেখেনি, তার প্রতি টান থাকার কথা নয়। তাদের অধিকাংশের ইচ্ছা, বাংলাদেশ তাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠিয়ে দিক এবং তাদের মধ্য থেকেই অনেকে মিথ্যা পাসপোর্ট ব্যবহারের মাধ্যমে সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে গেছে এবং যাচ্ছে। প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনায় তাদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে বৈকি।
 
 
আর যা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, তা হলো – কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ প্রত্যাবাসনে কী ভূমিকা পালন করবে? তাদের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ নিশ্চয়ই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেবে না।
 
 
 
 
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, মিয়ানমার সরকারের নাজুক অবস্থার কথা যে সারা বিশ্ব জানে, এটা মিয়ানমার সরকারও মানে। সুতরাং রোহিঙ্গা সংকট নিরসনকে একটা টোপ হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রতিবেশী বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের চেষ্টা তারা করতেই পারে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে জায়গায় রোহিঙ্গাদের নেওয়া হবে, তা আজ আর মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। এর নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মি, যাদের বিরুদ্ধে কেবল সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের অভিযোগ নয়, নাফ নদী থেকে বাংলাদেশের মাছ ধরার নৌকা ও জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়াকে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত করার অভিযোগ রয়েছে।
 
 
 
 
মিয়ানমার সরকারকে দিয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করানো গেলেও আরাকান আর্মি এ শব্দটি এখনো বলতে নারাজ। ১৩ এপ্রিল আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সরকারকে সাতটি শর্ত দিয়ে যে পত্র পাঠিয়েছে, সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের অভিহিত করেছে ‘বাংলাদেশের (চট্টগ্রামের) মুসলিম শরণার্থী’ হিসেবে। মানবিক করিডোর তৈরির ব্যাপারে তারা এখনো আপত্তি না জানালেও রোহিঙ্গাদের যদি রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে আরাকান আর্মির দখলকৃত স্থানে রোহিঙ্গারা কীভাবে নিরাপদ থাকবে? আরাকান আর্মি বাংলাদেশে সক্রিয় তিন রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে (আরসা, আরএসও, এআরএ) নিষ্ক্রিয় করতে বলেছে বাংলাদেশ সরকারকে। নিঃসন্দেহে কঠিন শর্ত, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আরাকান আর্মির দখলকৃত এলাকায় রাখাইনদের সঙ্গে সম্প্রীতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বসবাসকে সম্ভব করার জন্য বাংলাদেশ যদি দূরদৃষ্টির সঙ্গে কৌশল অবলম্বন না করে, তা হলে রোহিঙ্গাদের আবারও ফিরে আসা অবধারিত।
 
 
 
 
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একসময় বিদায় নেবে। মিয়ানমার জান্তা সরকারও অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে না। এনইউজি কিংবা আরাকান আর্মি, কিংবা অন্য যে-ই ক্ষমতায় আসুক – রোহিঙ্গারা যদি সত্যিই প্রত্যাবাসিত হয়, তবে তাদের মানবাধিকার রক্ষার কোনো শর্ত ভবিষ্যতে মিয়ানমার লঙ্ঘন করলে তার পরিণতি কী হবে, সে কৌশলও জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশকেই নিতে হবে।
 
 
বাংলাদেশ অবশ্যই চীন ও জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা করবে, এটা অনুমেয়। কিন্তু জাতিসংঘের এখনো এমন কোনো রেকর্ড নেই যে, কোনো শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে তাদের সম্মতিতে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিয়ে সেখানে তাদের বসবাসকে স্থিতিশীল রূপ দিতে পেরেছে। আর চীন যেহেতু সবকিছুর আগে নিজের স্বার্থ দেখে এবং সেজন্য মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও সরকারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়কেই এ পর্যন্ত অস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে মিয়ানমারের নিজের নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখার জন্য, সেহেতু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তির ওপর নির্ভর করবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে চীন কেমন ভূমিকা রাখবে।
 
 
একটা দেশে সরকারি উদ্যোগ ও নীতির বাস্তবায়ন তখনই জোরদার হয়, যখন সে দেশের মানুষের সমর্থন সেখানে থাকে। বাংলাদেশের জন্য পরিতাপের বিষয় হলো Ñ এদেশের রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা অনেক বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিলেও রোহিঙ্গা বিষয়ে তারা নিশ্চুপ থাকেন। অবশ্য এই নিশ্চুপ থাকার প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয়েছে বিগত সরকারের আমলে। শুধু রাজনীতিবিদেরা নন, সাধারণ নাগরিকেরাও যেন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা না বলেন, সে ব্যবস্থাই জুলাই বিপ্লবের আগ পর্যন্ত কায়েম ছিল। ‘রোহিঙ্গা’ বিষয়টিকে একটি ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। তাই আমরা ফিলিস্তিনের সমর্থনে যতটা সোচ্চার হই, রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে তার সিকি ভাগ মনোযোগও দিই না। আমাদের ঘাড়ের ওপর যে একটি গাজা বসে আছে, যেমনটি বলেছেন রোহিঙ্গা-বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি, তা আমরা বুঝতেই পারি না।
 
 
অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনার এজেন্ডায় রেখেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেন প্রহসনে পরিণত না হয়, যেন রোহিঙ্গাদের সম্মতিতে হয়, যেন নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ হয়, যেন টেকসই হয় – এ নিয়ে সাধারণ মানুষ তথা রাজনীতিবিদদের কণ্ঠ খানিকটা উচ্চকিত হওয়া জরুরি। রোহিঙ্গারা যেন নিজ দেশে নাগরিকের মর্যাদায় অধিকার নিয়ে নিরাপদে বাঁচতে পারে এবং বাংলাদেশও যেন কক্সবাজারে গত দুই দশকেরও বেশি সময় যাবৎ ঘটে যাওয়া পরিবেশ, অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় – নতুন বাংলাদেশে সে প্রত্যাশাকে ধরে রাখতে চাই।
 
 
 
লেখক : সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়