রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও জান্তা-আরাকান আর্মি জটিলতা
এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনো জটিল। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সঙ্কটের মূল কারণগুলোর মোকাবেলা করা এবং প্রত্যাবর্তনকারীদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিশ্চিত করার ওপর এর সফলতা নির্ভরশীল-মাসুম খলিলী। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ২২ এপ্রিল ২০২৫

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদ ও চ্যালেঞ্জ দু’টিই সামনে চলে আসছে। ২০২৫ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের একটি প্রাথমিক লক্ষ্য রয়েছে, তবে এটি বাস্তবায়ন নানা কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ-সংক্রান্ত ২০২৫-২৬ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে (জেআরপি) স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ওপর দৃষ্টি দেয়া হয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও হোস্ট রাখাইন সম্প্রদায় উভয়ের জন্য সুরক্ষা ও সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনো জটিল। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সঙ্কটের মূল কারণগুলোর মোকাবেলা করা এবং প্রত্যাবর্তনকারীদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিশ্চিত করার ওপর এর সফলতা নির্ভরশীল।
প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জ
জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে স্বেচ্ছায় এবং নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর সাথে ইউএনএইচসিআর এবং আইওএম-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে জড়িত। এই প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারে সঙ্ঘাত, চলমান সহিংসতা এবং রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশের অভাব উল্লেখযোগ্য বাধা।
এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যাতে তাদের অধিকার খর্ব হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে ফেরত না যায় তা নিশ্চিত করা এবং মিয়ানমারের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের একটি টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে অব্যাহত সহায়তা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। জেআরসি রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং হোস্ট রাখাইন সম্প্রদায়ের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোতে অ্যাক্সেস নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে চায়। এ ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব, ভূমির অধিকার এবং জীবিকার সুযোগের মতো সমস্যাগুলোর সমাধানসহ মিয়ানমারে পুনঃএকত্রীকরণের পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা মানবিক সঙ্কটের জন্য ২০২৫-২৬ যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনাটি গত ২৪ মার্চ শুরু করা হয়। এতে একটি বার্ষিক তহবিল সংগ্রহের দলিল এবং মানবিক সম্প্রদায় কিভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হোস্ট সম্প্রদায়ের মূল্যায়ন ও বিদ্যমান প্রয়োজনের প্রতি সাড়া দেবে সে বিষয়ে বিভক্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ রয়েছে।
২০২৫-২৬ জেআরপির প্রথম বছরে জাতিসঙ্ঘ এবং এর অংশীদাররা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অগ্রাধিকারমূলক চাহিদা ও শরণার্থী সঙ্কট সপ্তম বছরে প্রবেশ করার সাথে সাথে তাদের আতিথ্যকারী বাংলাদেশী সম্প্রদায়গুলোকে মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
২০২৫ জেআরপি কক্সবাজার ও ভাসানচরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং উখিয়া ও টেকনাফের বাংলাদেশী স্বাগতিক সম্প্রদায়সহ ১৪ লাখ ৮০ হাজার লোকের কাছে পৌঁছানোর জন্য সাড়ে ৯৩৪ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার অনুরোধ করেছে। ২০২৫ জেআরপি ১১৩ জন অংশীদারকে একত্রিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে জাতিসঙ্ঘের সংস্থা, বাংলাদেশী এবং আন্তর্জাতিক এনজিও। এদের প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশের জাতীয় সংগঠন।
জেআরপির পাঁচ মূল ফোকাস
২০২৫ সালের জেআরপিতে পাঁচটি মূল উদ্দেশ্য ফোকাস করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের/এফডিএমএনদের দ্রুত, স্বেচ্ছায় এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করা। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা শরণার্থী/এফডিএমএন নারী, পুরুষ, মেয়ে ও ছেলেদের সুরক্ষা এবং স্থিতিস্থাপকতা শক্তিশালী করা। তৃতীয়ত, প্রয়োজনে জনসংখ্যার জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদান করা এবং হোস্ট সম্প্রদায়ের কল্যাণে কাজ বৃদ্ধি করা। চতুর্থত, দুর্যোগঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা। পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা।
২০২৫ সালে আরাকান আর্মির সাথে জড়িত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের শর্তাবলি জটিল এবং বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে আরাকান আর্মির নিয়োজিত হওয়ার ইচ্ছা, রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আইনি স্বীকৃতি এবং অধিকারও রয়েছে। এর মধ্যে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আরাকান আর্মিকে সম্পৃক্ত করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তবে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে প্রয়োজনীয় শর্ত প্রতিষ্ঠার দিকে অর্থপূর্ণ অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরাকান আর্মির ভূমিকা ও শর্ত
আরাকান আর্মি (আআ) রাখাইন রাজ্যের একটি প্রভাবশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী, যার ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টিতে বাস্তব নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের সময় তাদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। বিমসটেক সম্মেলনের সাইড লাইনে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানের সাথে মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনার পর প্রথমপর্যায়ে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্তের পর আরাকান আর্মি ও এর রাজনৈতিক সংগঠন ইউএলএ ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি চিঠি দেয়। বাংলাদেশের কাছে দেয়া এই চিঠিতে সাতটি শর্তের উল্লেখের কথা জানা যায়। এতে বিমসটেক বৈঠকের সাইড লাইনের সভায় মিয়ানমারের সরকারের সাথে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার যা কিছুই বলুক না কেন বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না।
চিঠিতে উল্লিখিত আরাকান আর্মির সাতটি শর্তের মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, আরসা ও এর সাথে যুক্ত সব গোষ্ঠীর সশস্ত্র কার্যক্রম আরাকানে বন্ধ করতে হবে। সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা পুরোপুরি ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের কাজ হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাবাসিতদের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, স্বাস্থ্যপরিচর্যা কেন্দ্র, শিক্ষা অবকাঠামো সংবলিত নিরাপদ জোন তৈরি করতে হবে। এর নিরপেক্ষতা ও মান বজায় রাখার জন্য তাতে আন্তর্জাতিক তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তৃতীয়ত, প্রত্যাবাসিতদের জীবন-জীবিকার জন্য যথোপযুক্ত ভকেশনাল ট্রেনিং ও চাকরি সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর ও সমন্বিত হতে পারে। চতুর্থত, অতীতে সৃষ্ট সঙ্ঘাত সংঘর্ষ ও ঘৃণামূলক কার্যক্রমে সৃষ্ট দূরত্ব দূর করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। পঞ্চমত, সশস্ত্র সংগঠনের সাথে সম্পর্কহীনদের চিহ্নিত করে বেসামরিক নাগরিকদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে। ষষ্ঠত, প্রত্যাবাসন কাঠামো সৃষ্টির সাথে সাথে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়ক্রমিকভাবে ছোট ছোট গ্রুপে আন্তর্জাতিক তদারকির মাধ্যমে পুনর্বাসন কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সপ্তমত, স্থানীয় (রাখাইন) ও মুসলিম (রোহিঙ্গা) উভয় সম্প্রদায়কেই পরিকল্পিত পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের পরে এবং দুই মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আগে দেয়া আরাকান আর্মির এই চিঠিতে তাদের অবস্থান বেশ নমনীয় বলে মনে হয়। এই চিঠিতে রোহিঙ্গাদের সামরিক সরকার যেভাবে রোহিঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করেছে সেভাবে না করে মুসলিম সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলেও তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের অঙ্গীকারই চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
সম্ভবত বাংলাদেশ সরকার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের আরাকান আর্মির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পরামর্শ গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনের ভেতরে নিরাপদ জোন গঠনের জন্য হয় আরাকান আর্মির সাথে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, নয়তো সামরিক জান্তা সরকারের সাথে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মিকে পরাজিত করে এই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শেষোক্ত বিষয়টি বাংলাদেশের বাস্তবতার জন্য খুব বেশি ভায়াবল হবে বলে নানা কারণে মনে হয় না। প্রথমত, রাখাইন থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, ভরণ-পোষণ ও তাদের ইস্যু নিয়ে বৈশ্বিক ফোরামে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার পশ্চিমা দেশ এবং ওয়াইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো। তাদের কেউই জান্তার সাথে মিলে আরাকান আর্মিকে পরাজিত করার প্রকল্পে সায় দেবে বলে মনে হয় না। আর সেটি না হলে বাংলাদেশের পক্ষে এ ধরনের কাজে যুক্ত হওয়া কঠিন হবে।
পশ্চিমের এজেন্ডা
আরাকান রাজ্যকে স্বাধীন ও মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করার এজেন্ডা সম্ভবত পশ্চিমাদের রয়েছে। আমেরিকান কংগ্রেসে বার্মা আইন পাসসহ এই অঞ্চলে তাদের নানা ধরনের সম্পৃক্ততায় সেটি মনে হতে পারে। আর আরাকান স্বাধীন দেশ হলে বৈরী মিয়ানমারের বাস্তবতায় দেশটির বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রয়োজন। মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তদারকিতে নিরাপদ জোন গঠন এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য মানবিক করিডোর করতে হবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয় সম্প্রদায়ের সহায়তার জন্য এ ধরনের মানবিক করিডোর প্রদানের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো বাংলাদেশের সাথে কথাবার্তা শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নাগরিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসহ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং স্বতন্ত্র আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্তি ও চ্যালেঞ্জ দু’টিই রয়েছে। প্রাপ্তি হলো রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে। আর চ্যালেঞ্জের বিষয়টি হলো আরাকান আর্মিতে বাংলাদেশের পাহাড়িদের মধ্য থেকে যে রিক্রুটমেন্টের বিষয় জানা যাচ্ছে তাদের সেখানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। কোনো সশস্ত্র গ্রুপ যাতে বাংলাদেশের পাহাড়ে সক্রিয় হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় যুক্ত না হয়ে পড়ে সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন হবে।
যুদ্ধ-আক্রান্তদের জন্য মানবিক করিডোর
গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকার এবং আরাকান আর্মি (আআ) অবিলম্বে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য মানবিক সহায়তা এবং আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সহজতর করা উচিত বলে উল্লেখ করেছিল ‘ফরটিফাই রাইটস’। জাতিসঙ্ঘের মতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পাঁচ লাখ ১৯ হাজারেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষের জরুরি খাদ্য, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সরবরাহের প্রয়োজন রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বারা মার্কিন বৈদেশিক সাহায্যে সাম্প্রতিক ঘাটতি মানবিক সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফরটিফাই রাইটসের মানবাধিকার সহযোগী এজাজ মিন খান্ত বলেছেন, ‘অধিকার-সম্মানকারী দেশগুলোকে মিয়ানমারের অভাবী সম্প্রদায়ের জন্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদানের সুবিধার্থে সব সম্ভাবনা অন্বেষণ করা উচিত। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর সব সম্প্রদায়ের জন্য অত্যাবশ্যক সাহায্য ও কাজকে সহজ করবে। এটি করতে ব্যর্থ হলে অনেক প্রাণহানি হতে পারে।’ জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে মাত্র তিনটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে একটি হলো সিটওয়ে টাউনশিপ, যার মধ্যে রয়েছে রাজধানী-সিত্তে একটি প্রধান বন্দর শহর। এটি জান্তাকে কার্যকরভাবে মিয়ানমারের অন্য জায়গা থেকে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করতে সক্ষম করে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, রাখাইন রাজ্যের প্রায় ২০ লাখ মানুষ রাজ্যের পরিস্থিতির কারণে অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : জরুরি পদক্ষেপ না নেয়া হলে এখানকার ৯৫% জনসংখ্যা বেঁচে থাকার সঙ্কটে পড়বে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ব্যাপক হ্রাস, আকাশছোঁয়া দাম, ব্যাপক বেকারত্ব এবং বর্ধিত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিজেদের রক্ষা করা তাদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বাণিজ্য রুট বন্ধ এবং সাহায্যের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাখাইন গভীর মানবিক দুর্ভোগের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ফরটিফাই রাইটস বলেছে, মিয়ানমারের সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার সাথে সাথে, মানবিক প্রবেশাধিকার ও বাণিজ্যকে সহযোগিতা ও সহজতর করার জন্য বাংলাদেশ এবং আরাকান আর্মিকে অবশ্যই আরো জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অগ্রাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান একটি পাবলিক সেমিনারে বলেছিলেন : ‘যে দিন আরাকান আর্মি আমাদের সীমান্তে তার পতাকা তুলেছিল, আমি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যে এটি একটি নতুন বাস্তবতা- আপনাকে তাদের মোকাবেলা করতে হবে।’
গত ৪ মার্চ, ২০২৫-এ প্রচারিত স্কাই নিউজের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির বিষয়ে আরাকান আর্মির সাথে আলোচনার কথা বলেছে।
মানবিক করিডোরগুলো মনোনীত এবং নিরাপদ রুট যা মানবিক ত্রাণের নিরাপদ উত্তরণের সুযোগ দেয়। রাখাইন রাজ্যে বেসামরিক নাগরিকদের মৌলিক পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর থেকে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উচিত। যুদ্ধের আইন নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মিয়ানমারের পরিস্থিতির জন্য প্রযোজ্য এবং রাখাইন রাজ্যে সঙ্ঘাতের পক্ষগুলোকে বেসামরিক ও মানবিক সহায়তা কর্মীদের সুরক্ষা দিতে বাধ্য করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করা একটি যুদ্ধাপরাধ এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা যেতে পারে। এজাজ মিন খান্ত বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্কট বিশ্বব্যাপী জরুরি মনোযোগ ও পদক্ষেপের দাবি রাখে। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর সঙ্ঘাত দ্বারা প্রভাবিত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য একটি লাইফলাইন হবে।’
শেষ কথা
রাখাইন রাজ্যে চলমান সঙ্ঘাত ও অস্থিতিশীলতা, বিশেষ করে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘাত, প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি স্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিবেশ অপরিহার্য। একই সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবশ্যই মিয়ানমারে তাদের আইনগত মর্যাদা এবং অধিকার স্বীকৃত থাকতে হবে, যার মধ্যে নাগরিকত্ব এবং তাদের বাড়ি ও জীবিকা ফিরে পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ ধরনের স্বীকৃতি ছাড়া প্রত্যাবাসনকে অবিরত রাষ্ট্রহীনতায় একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ইউএনএইচসিআর স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেছে, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করা বা না করার অধিকার রয়েছে। এ জন্য প্রত্যাবাসন অবশ্যই টেকসই হতে হবে, মিয়ানমারে তাদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য শরণার্থীদের পর্যাপ্ত সম্পদ এবং সহায়তা প্রদান করতে হবে। আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিশ্চিত করতে এবং তাদের প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে জাতিসঙ্ঘ, ইইউ এবং অন্যান্য দেশসহ আন্তর্জাতিক অভিনেতাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে মানবিক সহায়তা প্রদান, প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করা ও মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান আর্মির সাথে জড়িত হওয়া।