রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ
মো. আরিফ উল্লাহ [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২২ মে ২০২৫]

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন কারণে এখনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যকার সংঘাত বা দ্বন্দ্ব এখনো শেষ হয়নি। যতক্ষণ না পর্যন্ত জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের কর্তব্য হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার এবং জান্তা বাহিনীর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়।
এক্ষেত্রে আরাকান আর্মিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন, কেননা ইতিমধ্যে রাখাইন প্রদেশ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে জনমত তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়াকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ জোন তৈরির লক্ষ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবুও প্রত্যাবাসন না হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছা : রোহিঙ্গারা চায় মিয়ানমার সরকার যেন তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও বসতভিটার নিশ্চয়তা দেয়, তাদের যাতে তারা আর কখনো আগের মতো আবারও অত্যাচারিত হয়ে নিজ জন্মভূমি ছাড়তে না হয়। অন্যদিকে রোহিঙ্গা তরুণরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না, তারা তৃতীয় কোনো দেশে স্থায়ীভাবে থাকতে চায়।
আইনি প্রতিবন্ধকতা : মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন ১৯৮২-এর ৩ নম্বর ধারা অনুসারে মিয়ানমার তার জনগণকে ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করে নাগরিকত্ব দিয়েছে, যেখানে ১৯৪৮ সালের আগে থেকে বসবাসরত মানুষকে পূর্ণ নাগরিকত্ব বা National Races বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকার এই শ্রেণির জন্য ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী নিয়ে একটি তালিকা করে কিন্তু এই তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে যারা নাগরিক হতে আবেদন করেছিল তাদের ‘সহযোগী নাগরিকত্ব’ বা Associate Citizenship বলা হচ্ছে। শেষ স্তরে যারা বিদেশি কিন্তু ১০ বছর বা তার বেশি সময় বৈধভাবে বসবাস করছে, তাদের প্রাকৃতিকীকৃত নাগরিকত্ব বা Naturalized Citizenship হিসেবে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা ১৯৪৮ সালের আগে থেকে বসবাস করলেও তাদের কোথাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বরং তাদের থেকে পূর্বপুরুষের কাগজপত্র নিয়ে, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়।
আরাকান আর্মির মতবাদ : আরাকান আর্মির কাছ থেকে রোহিঙ্গারা ইতিবাচক সাড়া আশা করেছিল, কিন্তু আরাকান আর্মি যে মতবাদে বিশ্বাস করে তা কখনো রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নয়। তারা মনে করে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি মুসলিম শরণার্থী। অন্যদিকে তাদের দাবি, বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করে।
সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ : বাংলাদেশ একটি টেকসই প্রত্যাবাসন চায়, যাতে এই সংকটের একটি চিরস্থায়ী সমাপ্তি ঘটে, পুনরায় যেন এমন মানবিক বিপর্যয় না ঘটে। এ সমস্যা থেকে কিছু সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ তুলে ধরা হলো :
বহুপক্ষীয় সমাধান : প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিবর্তে বহুপক্ষীয় সমাধান খুঁজতে হবে, সুতরাং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশের সমন্বয়ে। যদিও ভারত, চীন ও রাশিয়া মানবতার চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থে একটু বেশি মনোযোগী এবং ইতিমধ্যে তারা বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ মিয়ানমারে করেছে। তবুও তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করতে হবে।
‘সেইফ জোন’ তৈরি : মিয়ানমার কোথায়, কীভাবে, কোন কোন সুবিধা প্রদান করবে, এর স্থিতিশীলতা কতটা নিশ্চিত, চুক্তি ভঙ্গ করলে এর প্রতিকার কী হবে এসব বিষয়ে আগাম অবহিত করবে এরপর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন : আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ ছাড়া মিয়ানমার কখনোই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না, তাই ক্রমাগত রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে লবিং করতে হবে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের নিজের অধিকারে জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়াজ তুলতে হবে।
আইনগত বাধা নিরসন : মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন ১৯৮২ Burma Citizenship Law, 1982-এর যুক্তিসংগত সংশোধনী নিশ্চিত করা যেখানে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব ও বসবাসের মর্যাদা ফিরে পায়।
কফি আনান কমিশনের প্রস্তাব : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪, ৭৫ ও ৭৬তম অধিবেশন, রাখাইন রাজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা কমিশন তথা কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে।
আন্তর্জাতিকীকরণ : বাংলাদেশ যদি এই ইস্যু সমাধানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক জোট বা অন্তর্জাতিক কোন প্ল্যাটফর্মে জোরদারভাবে তুলে ধরতে পারে, তাহলে এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের পথ দেখবে, যেমন যেসব মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়ার মতো পরাশক্তি দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়।
বাংলাদেশে কত রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, এর সঠিক তথ্য সরকার কিংবা জাতিসংঘ কারও কাছে নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এদের বিচরণ। বাংলাদেশ ‘রিফিউজি কনভেনশন’ ১৯৫১-তে স্বাক্ষর না করেও এত বিশাল একটি জাতিকে আশ্রয় দেওয়া যেমন মহৎ কাজ, ঠিক তেমনি নিজ দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। হুমকির মুখে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প ও জননিরাপত্তা। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে, তাদের মানবাধিকারের সব অধিকার সুন্দরভাবে ভোগ করবে, যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী