কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের সম্ভাব্য উদ্যোগ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী । সূত্র : আমাদের সময়, ২৪ মার্চ ২০২৫

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের সম্ভাব্য উদ্যোগ

অতি সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন। সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তাদের এ সফর দীর্ঘদিনের বিরাজিত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুগান্তকারী বার্তা বহন করছে। লাখো রোহিঙ্গাকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র রমজান মাসে ইফতার গ্রহণ অবর্ণনীয় এক দৃশ্যপট তৈরি করেছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারাও এতে যারপরনাই অনুপ্রাণিত। ‘রোহিঙ্গাদের সহায়তা বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব’ গুতেরেসের এই বক্তব্যে আশাহত রোহিঙ্গাদের হৃদয়ে নতুন প্রত্যাশা উচ্চকিত হয়েছে। ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আরও ভালো পরিবেশ চায়। দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য অনেক দেশ সম্প্রতি নাটকীয়ভাবে মানবিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে মানবিক সহায়তার মধ্যে খাবারের রেশন কমাতে হয়েছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যত দেশ সম্ভব আমি কথা বলব, যাতে করে ফান্ড পাওয়া যায় এবং এর চেয়ে আরও খারাপ পরিস্থিতি না আসে।’ যেহেতু বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়, এ জন্য মিয়ানমারে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন।

 

 

অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জরুরি তহবিলের অভাবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য রেশন কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মারফত জানা যায়, রোহিঙ্গাদের জন্য পূর্ণ রেশন চালিয়ে যেতে এপ্রিলে ১৫ মিলিয়ন ডলার এবং বছরের শেষ পর্যন্ত মোট ৮১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এ মাসের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা জোগাড় করতে না পারলে ১ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানো হতে পারে। বর্তমানে একজন রোহিঙ্গা মাসে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যের খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে, যা কমিয়ে ৬ ডলারে আনা হবে। ফলে প্রতি বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ টাকা থেকে কমে হবে ৮ টাকা। এতে আগে থেকেই বিরাজিত খাদ্যসংকট ও অপুষ্টি আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। প্রসঙ্গত ডব্লিউএফপির বাংলাদেশ মুখপাত্র কুন লি গণমাধ্যমে বলেন, ‘মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে অনুদান সংকটের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান কমে আসছে। এর আগে ২০২৩ সালে তহবিল ঘাটতিতে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে প্রথমে ১০ মার্কিন ডলার এবং পরে ৮ মার্কিন ডলারে করা হয়। পরবর্তী সময়ে তা আবার বাড়ানো হয়।’

 

 

এ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা নেতাসহ অধিকাংশ রোহিঙ্গার দাবি, অর্থ সহায়তা কমিয়ে আনলে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জনজীবন বিপর্যস্ত হতে পারে। কারণ এত অল্প টাকায় তারা না খেয়ে মরবে। বাড়তে পারে খুন-ধর্ষণ-মাদক, মানব পাচার-ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ। উল্লেখ্য, খাদ্য সহায়তায় বরাদ্দ কমার ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। সামজিক মাধ্যম এক্স-এ দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, ‘যদি শিবিরগুলোতে দাতাদের সহায়তা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়, যা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে তা বাংলাদেশ সরকার, সাহায্য সংস্থা ও শরণার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধা, রোগ ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়বে।’

 

 

বিজ্ঞজনদের দাবি, খাদ্যসংকট দেখা দিলে রোহিঙ্গাদের জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশের মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে অসংখ্য রোহিঙ্গা দেশের জনগোষ্ঠীর ভেতরে মিশে গেছে। শুধু তাই নয়, নানা উপায়ে তাদের অনেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মধ্য দিয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরেও। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটার বিষয়টিও অমূলক নয়। আরও রয়েছে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরির আশঙ্কা। আর সেই সুযোগে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখতে চায়, তাদের কাছ থেকে তারা অস্ত্র সহায়তা পাবে। সেসব অস্ত্র তারা ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে।

 

 

এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিত করার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক। ভবিষ্যতে আরও বন্ধের প্রক্রিয়াধীন। এতে দৈনিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত কর্মকর্তাদের অভিমত, ইউএসএআইডির তহবিল স্থগিত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তারা সবাই ২০-২৫ শতাংশ সেবা হ্রাস করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওগুলোর কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে জানা যায়, বৈদেশিক সাহায্য স্থগিত হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় ও জীবনরক্ষাকারী সেবাসহ বেশ কিছু সেবা বন্ধ হয়ে গেছে, যা রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটিতে প্রভাব ফেলছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কিছু সহায়তা স্থগিতাদেশ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে এর প্রভাব স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে কী হতে পারে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সময় লাগবে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছে ডব্লিউএফপি।

 

 

আমাদের সবার জানা, রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। অধিকাংশ রোহিঙ্গা পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং কিছুসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলিতেই বসবাস করতে পছন্দ করত। এ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এ ছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

 

 

রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার পরিচালিত বর্বরতম অভিযানে নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। বিগত ১৪ মাসেও মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন একাধিক শহরের পতন হওয়ায় আরও প্রায় ৭০ হাজার শরণার্থী অনুপ্রবেশ করেছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের (রাখাইন) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধুনিক লিখিত ভাষাই হলো রোহিঙ্গা ভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত, যার সঙ্গে চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া ভাষার মিল রয়েছে।

 

 

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে চট্টগ্রামের ভাষায় রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের মাতৃভূমিতে পাঠানোর আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লার হাছে দোয়া গরি, সামনর ঈদত যেন অনারা নিজর বাড়িত যাইয়েরে ঈদ গরিত ফারন।’ জাতিসংঘ মহসচিব নানা ব্যস্ততার মধ্যেও তাদের প্রত্যাবাসনের দায়িত্ব নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এত কিছুর ভিতর অনারার দায়িত্ব হত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা গরের আজিয়া ইয়ত উপস্থিত থাকনর মাধ্যমে ইয়ান বুঝিত পাইত্য লাইগন্য। কত গুরুত্ব দিয়ে তাইন। এত দুরততুন আইয়েরে অনারার লাই ইফতার গরিব আর অনারার খুঁজ-হবর লইব। দুঃখগান বুঝিত পরিব যাতে তাইন ইয়ানর সমাধান গরিত পারে। হাজেই বেয়াক্কুনর পক্ষত তো শুকরিয়া জানাই।’ নিজেদের ভাষায় প্রধান উপদেষ্টার কণ্ঠে উচ্চারিত আশাজাগানিয়া আকাক্সক্ষাগুলো রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার আবেগকে প্রাণবন্ত করেছে। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এই দুই মহান ব্যক্তির ভ্রমণ তাদের বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ নানামুখী কার্যকারিতা, তাদের ইচ্ছা-আগ্রহ নিয়ে আলাপচারিতা নতুন এক অধ্যায় তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

 

 

অসমর্থিত সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৬-১৭ লক্ষাধিক। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভরণ-পোষণ, আশ্রয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সাবলীল জীবনযাত্রা অটুট রাখা বিরল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের নাগরিক, বিশেষ করে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়াসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এদের অবস্থান নানা কারণে প্রচণ্ড অসহনীয় হলেও, তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে না। বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তারা মানবিকতার অপূর্ব উপমা রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞ মহলের মতে, জাতিসংঘ সত্যিকার আন্তরিক হলে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানদের অব্যাহত চাপে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে যথাযথ পুনর্বাসন অবশ্যই কার্যকর হবে। এটি প্রত্যাশিত যে, কাক্সিক্ষত সহযোগিতা চলমান রেখে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন ও পূর্ণ নাগরিক মর্যাদায় তাদের অবস্থানকে স্থায়ী করার প্রচেষ্টাই হোক জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

 

 

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী