সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও আমার ভাবনা
আবু এন. এম. ওয়াহিদ । সূত্র : কালবেলা, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

দেশ এবং রাষ্ট্র এ দুটো শব্দকে একই অর্থে ব্যবহার করা যায়, আবার তাদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম তফাত নির্ণয় করাও সম্ভব। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে দেশ এবং রাষ্ট্র এক ও অভিন্ন, কারণ রাষ্ট্র গঠন করতে দরকার হয় ভূখণ্ড, মানুষ, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। দেশের বেলাও তাই। তবে কর্মতৎপরতা ও কার্যকারিতার দিক থেকে এ দুটো ধারণা এক নয়। বরং আলাদাই।
যে দেশের সরকার স্বাধীনভাবে তার সার্বভৌমত্বের চর্চা ও প্রয়োগ করতে পারে না এবং জনগণের দুয়ারে দুয়ারে সুবিচার পৌঁছে দিতে পারে না সেটা দেশ হতে পারে, কিন্তু তাকে আমি রাষ্ট্র বলতে একেবারেই নারাজ। আর সম্ভবত এ অর্থেই সম্প্রতি ঢাকার এক টিভি টকশোতে প্রবীণ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেছিলেন, ‘একাত্তরে আমরা একটি দেশ পেয়েছি, রাষ্ট্র পাইনি।’
আমার প্রশ্ন, আজও কি পেয়েছি? বলাই বাহুল্য, দেশ পাওয়া যত সহজ, তাকে তিলে তিলে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা তার চেয়ে অনেক কঠিন। আক্ষেপ, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কোনো ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল বা জোট দেশটিকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পরিশুদ্ধ প্রত্যয় নিয়ে মাঠেই নামেনি। তাইতো আপনার আমার প্রিয় জন্মভূমি ‘দেশ’ ছিল। ‘দেশ’ই রয়ে গেল। ‘রাষ্ট্র’ আর হলো না।
এবার আসুন, বাংলাদেশে কেন সার্বভৌত্বের স্বাধীন অনুশীলন এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তা আরেকটু খোলাখুলিভাবে বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমে আসি সার্বভৌমত্বের কথায়। আমাদের মতো দেশে সার্বভৌমত্বের বিষয় একটি ‘বাতকে বাত’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমান পৃথিবীতে দুইশোরও বেশি স্বীকৃত স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র আছে।
তারা জাতিসংঘের সদস্যও বটে। তাদের মধ্যে আবার পাঁচটি রাষ্ট্র সবার মাতবর। তারা বিশ্ব সংস্থায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। তাদের প্রত্যেকের হাতে আছে শক্তিশালী ‘ভিটো’ শক্তি। এবার দেখুন, এ ক্ষমতাবলে তারা কী না করতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটি হয়। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হয়, পাঁচ মোড়লের যে কারও পছন্দ না হলে, সে একা তুড়ি মেরে নিমেষে তা উড়িয়ে দিতে পারে।
ব্যস, এ বাস্তবতায় আপাতত মনে হতে পারে, এই পাঁচটি দেশই বুঝি সত্যিকারভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম আর কেউ নয়। না, আসলে তাও নয়। বিষয়টির আরেকটু গভীরে গিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, তারাও ইচ্ছেমতো তাদের সার্বভৌমত্ব চর্চা করতে পারে না। তারা কেন, বড়দের বড় বর্তমান দুনিয়ার দুই পরাশক্তি আমেরিকা এবং চীন তাদের সার্বভৌমত্বেরও সীমাবদ্ধতা আছে। এর ব্যাখ্যায় একটু পরেই আসব। তার আগে দেখে নিই দেশ কিংবা রাষ্ট্র হিসেবে ছোটরা কেন এত বড় জাতীয় গুরুদায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারে না।
একই কথা আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায়, ছোট দেশগুলোর কেউই পূর্ণরূপে তার আপন আপন সার্বভৌমত্বের অধিকার আদায় করতে পারে না। কারণ তারা ছোট। তারা গরিব। সামরিক শক্তিতে তারা দুর্বল। তার চেয়েও বড় কথা, তারা পরাধীনতা ও হীনম্মন্যতার মানসিকতায়ও ভোগে থাকে। ছোটরা সবসময় বড় কিংবা পরাশক্তি সমূহের কাছ থেকে একদিকে নানা ধরনের সুবিধা নিয়ে থাকে। আবার অন্যদিকে বড়দের চাপে হরহামেশা নিষ্পেষিতও হতে থাকে। এর মধ্যে যেসব দেশ যত বড়, যত সবল, যত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা তাদের সার্বভৌমত্বকে ততটাই স্বাধীনভাবে অনুশীলন ও ব্যবহার করতে পারে অথবা অন্তত করার চেষ্টা করতে পারে। আর শর্তসাপেক্ষে, যে দেশ তার এই অধিকার যত দৃঢ়তার সঙ্গে, যত বেশি প্রয়োগ করতে পারে, সে ততটাই স্বাধীন। ততটাই সার্বভৌম। ততটাই রাষ্ট্র নামের যোগ্য।
আজকাল বিশ্ব পরিস্থিতি এমন, কোনো দেশই শতভাগ তার সার্বভৌমত্বের সদ্ব্যবহার করতে পারে না। আর তাই চূড়ান্ত বিচারে, কেউই ষোলো আনা ‘রাষ্ট্র’ নামের উপযুক্তও নয়। উদাহরণস্বরূপ অন্যদের কথা বাদই দিলাম, সার্বভৌমত্বের নামে বর্তমান দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কেউই যাচ্ছেতাই করতে পারে না, কারণ একজনকে একটি ‘অ্যাকশন’ নেওয়ার আগে দশবার ভেবে দেখতে হয় অন্যজন কীভাবে তার পাল্টা ‘রিঅ্যাকশন’ দেখাবে।
এসব যুক্তির বলে, বোধগম্য কারণেই, অন্য সব ছোট দেশের মতো বাংলাদেশকেও তার সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের আগে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশের স্বার্থের দিকে যত্নবান থাকতে হয়। এই কঠিন বাস্তবতার কারণে আমরা না হয় আপাতত আমাদের পবিত্র সার্বভৌমত্বকে শিকেয় তুলে রাখলাম।
এখন আসি পরের প্রশ্নে। বাংলাদেশের সরকারগুলো কেন জনগণকে ন্যায়বিচার ও সুশাসন দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে? আপন দেশে আপন নাগরিকের জন্য সুশাসন সুবিচার চর্চা করতে তো কোনো পরাশক্তি সরাসরি মানা করে না। সরাসরি করে না বটে, তবে পরোক্ষভাবে করে। যদি ধরে নিই করে না, তাহলে নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়, বিচার বিভাগকে সত্যিকারভাবে স্বাধীন করে দিলে এবং দেশপ্রেমিক, যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় বসিয়ে দিলে, আস্তে আস্তে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। আর যে সমাজে সুবিচার শিকড় গাড়ে সেখানে দুর্নীতি ঠাঁই পায় না। খুন-গুম, রাহাজানি চলতে পারে না।
নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ইত্যাদি সহজেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পেলে সমাজে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো বিশেষ সময়ে বা জায়গায় অনাচার, অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তবে তা সর্বগ্রাসী হতে পারে না। দীর্ঘস্থায়ী হওয়ারও সুযোগ পায় না। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে বাংলাদেশে সুশাসন ও ন্যায়বিচার হয় না কেন? হয় না, তার কারণ অতি সহজ।
কোনো সরকারই এ ব্যাপারে আন্তরিক ও অঙ্গীকারবদ্ধ নয়। একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় বসেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাবে, ‘তাহারা ক্ষমতারোহণ করিয়াছে’। প্রাসঙ্গিক দল বা জোট কস্মিনকালেও মনে করে না, তারা দেশ ও জনগণের সেবা করার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব পেয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে, তাই তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো—ক্ষমতার অনুশীলন করা। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অর্থবিত্ত ও প্রতিপত্তি অর্জন করা। ক্ষমতাকে ধরে রাখা। যতটা সম্ভব দীর্ঘস্থায়ী করা। যুগের পর যুগ সব দলই এ ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করে দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
এবার আসি অন্য কথায়, পাঁচ শক্তিধরের এক বা একাধিক অথবা নতুন কোনো উঠতি মোড়ল যদি তার নিজের স্বার্থে একটি বিশেষ দল বা জোটকে অন্য দেশের ক্ষমতায় বসিয়ে রাখতে চায়, সেটাও সম্ভব। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্যাটার্ন রাষ্ট্রের আশকারায়, ক্লায়েন্ট দেশের সরকার ন্যায়নীতির পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কীভাবে? সে ব্যাখ্যা কি আর খুলে বলার দরকার আছে?
গণতান্ত্রিক দেশে সুনীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে সাংবিধানিক ভারসাম্যের (চেক অ্যান্ড ব্যালান্স) কিছু ব্যবস্থা থাকে। সেই অনুযায়ী সরকারের তিনটি অঙ্গ অর্থাৎ আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি ও কার্যকর পারস্পরিক জবাবদিহি থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে এই ভারসাম্য বজায় রাখা অসম্ভব। কারণ, নির্বাহী বিভাগ প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে। সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়। গোয়েন্দা বাহিনী ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে লালনপালন ও নিয়ন্ত্রণ করে।
এ ছাড়া সরকারের হাতে থাকে প্রাইভেট পেটোয়া বাহিনী। তাই কথায় বলে, ‘সরকারের হাত অনেক লম্বা। অনেক শক্তিশালী’, যার কাছে প্রধান বিচারপতিও ধরাশায়ী। তার ওপর বাংলাদেশে সরকার পরিচালনায়, ‘রুলস অব বিজনেসের’ নামে এই সাংবিধানিক ভারসাম্যকে এরই মধ্যে লন্ডভন্ড করে ফেলা হয়েছে। কাগজে-কলমে যাই থাকুক, দেশের পুরো শাসনব্যবস্থা একটি জোট নয়, একটি দল নয়, একজন ব্যক্তি ও একটি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়ে থাকে। সেই ব্যক্তিটি আর কেউ নন। তিনি পরম পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী।
সবদিকে তার দৃষ্টি যায়। সবদিকে তার ক্ষমতার হস্ত প্রসারিত। তার কথাই আইন। তার নির্দেশ সবার শিরোধার্য। এই অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্তি পেতে হলে সংবিধানে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজকে সম্প্রসারিত করতে হবে। শুধু সংসদ সদস্য নয়, বরং সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সব নির্বাচিত প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রীকে পূর্ণ ক্ষমতা, দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা দিয়ে বসাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও সব বিভাগের যাবতীয় ব্যাপারে নাক গলানো থেকে বিরত রাখতে হবে। মন্ত্রিসভায় তিনি অন্য মন্ত্রীদের মতোই একজন মন্ত্রী—শুধু তফাত হবে তিনি ‘ফাস্ট অ্যামংস্ট ইকুয়েলস’।
নির্বাচনে ‘উইনার্স টেক অল’ এই নীতি থেকেও দেশকে সম্পূর্ণরূপে সরে আসতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে বটে, তবে দেশ পরিচালনায় সংখ্যালঘুদের কথাও কার্যকরভাবে আমলে নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে, ‘রুলস অব বিজনেসের’ খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। এমন আইন করতে হবে যাতে কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীগুলোকে দলীয় ঠাঙ্গারে বাহিনীতে পরিণত করতে না পারে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। আমি শুধু কিছু সমাধানসূত্র ধরিয়ে দিলাম। এ নিয়ে আরও গভীর ও বিস্তারিত চিন্তাভাবনা ও আলাপ-আলোচনার অবকাশ তো রয়েছেই।
লেখক: টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
সম্পাদক, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াস