কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সামুদ্রিক পর্যটন ও টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ

মো. আশিকুর রহমান অভি আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, কালবেলা

সামুদ্রিক পর্যটন ও টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সমুদ্রসীমা প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার পর এ সীমানা নির্ধারিত হয়। বিশ্বের দীর্ঘতম অবিভক্ত সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্র জীববৈচিত্র্য, ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪৩টি দ্বীপ, উপকূলীয় সংস্কৃতিসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো বিশাল সম্পদ নিয়ে দেশটি সামুদ্রিক পর্যটনের ক্ষেত্রে অনন্য সম্ভাবনা ধারণ করে। তবে, অপ্রতিরোধ্য মানবিক কার্যক্রম ও অপ্রতুল পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের কারণে টেকসই উন্নয়নের পথে নানা চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। খাতটি শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়; বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক পর্যটন থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে গোটা বিশ্বেই বিবেচিত। পাশাপাশি এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। তবে সামুদ্রিক পর্যটনের ক্রমবর্ধমান গণচাহিদা এবং টেকসই উন্নয়নের অভাবে উপকূলীয় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, প্রবাল ধ্বংস এবং সামুদ্রিক দূষণ বৃদ্ধি। এর ফলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পর্যটন খাতের ওপর সংকট সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য টেকসই পর্যটন উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।

সামুদ্রিক পর্যটনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব। অপরিকল্পিত নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাবে এই অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। সৈকতের কাছাকাছি অবকাঠামোগুলো পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রবালপ্রাচীর ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য পর্যটন কার্যক্রমের কারণে হুমকির সম্মুখীন। দ্বীপে অতিরিক্ত পর্যটকের আগমন, প্লাস্টিক দূষণ এবং প্রবালপ্রাচীরের ওপর চাপ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই কারণে এই দ্বীপে জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। সামুদ্রিক পর্যটনের টেকসই উন্নয়নের জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগণ পর্যটনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। পর্যটন খাতের উন্নয়নে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ার ফলে তারা পর্যাপ্ত সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। ফলে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ, যেখানে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন—ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব দুর্যোগের তীব্রতা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামুদ্রিক পর্যটনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা, অবকাঠামোর টেকসই এবং পর্যটন মৌসুমের ওপর এই দুর্যোগগুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ে।

সামুদ্রিক পর্যটনের টেকসই নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। পরিকল্পিত নির্মাণ ও পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব। তদ্ব্যতীত, পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট, পর্যটন কেন্দ্র এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যটকদের জন্য টেকসই পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কড়া পরিবেশগত সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি, প্রবাল রক্ষার্থে অতিরিক্ত পর্যটক প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং দ্বীপে পরিবেশ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা প্রয়োজন। সামুদ্রিক পর্যটন খাতে স্থানীয় সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান এবং স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পর্যটনের সংযোগ ঘটানো সম্ভব। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় পুনরুজ্জীবিত পর্যটন মডেল প্রণয়ন এবং তাতে স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে পুনরুজ্জীবিত পর্যটনের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার দিকেও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পুনরুজ্জীবিত পর্যটন বলতে বোঝায় পরিবেশের পুনরুদ্ধার এবং সম্পদ সংরক্ষণের দিকে মনোনিবেশ। যেমন—বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, উপকূলীয় গাছ রোপণ এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। এতে জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় পর্যটন অবকাঠামোর স্থায়িত্ব বাড়ানো, পর্যটকদের জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতির ব্যবস্থা এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোর দুর্যোগ সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

 

বাংলাদেশের সামুদ্রিক পর্যটন খাতের টেকসই উন্নয়ন শুধু পর্যটকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করাই নয়; বরং স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এ খাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পর্যটন নীতিমালা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্যোগ গ্রহণ এবং স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। উপকূলীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং স্থায়ী পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ সামুদ্রিক পর্যটনের মাধ্যমে আর্থিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে।

 
 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক

 

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা