সাংবিধানিক সংস্কার : ধর্মনিরপেক্ষতা
অধ্যাপক ডক্টর আবু সাইয়িদ, সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

ইতিহাসে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের একটি চিঠিতে সুন্নি ওমরাহকে উষ্মা প্রকাশ করে লিখেন ‘জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? প্রশাসনের কাজকর্মে ধর্মের নাক গলানোর কী অধিকার আছে? তোমাদের জন্য তোমার ধর্ম আমার জন্য আমার।’ মেবারের রানা রাজসিংহকে প্রেরিত একটি পত্রে আওরঙ্গজেব বলেন, ‘যে রাজা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখায়, সে স্রষ্টার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়’
সম্প্রতি বিভিন্ন ভাষ্যে বিশিষ্টজনরা সংবিধান থেকে জাতির পিতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ সম্পর্কে ব্যক্তিক পর্যায়ে চিন্তা-চেতনার উপস্থাপন এবং আদর্শিক পরিমণ্ডলকে আরও গভীরভাবে পর্যালোচনার পথধারা বিস্তৃত করবে, এ প্রত্যাশায় লেখাটি।
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক দিনে আসেনি। হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছে। আত্মপরিচয়ের উদ্বোধন যেমন ঘটেছে তেমনি দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু ৯ মাসের বৃত্তে আবদ্ধ নয়। রক্তস্নাত সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা ধারণ করেছি দর্শন, সামাজিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের প্রতীতি। তারই পর্যায়ক্রমিক মাত্রিকতায় আমরা অর্জন করেছি মানব-মুক্তির জয়ধ্বনি। অর্জন করেছি জনগণের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, সংকট ও স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাকে। জনগণের অপরিসীম এই শক্তির বিজয়গাথা বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিফলিত। এগুলো হলো রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ও দর্শন। রাষ্ট্রের মূলনীতি বাদ বা বাতিল করা যায় না। কালিক পরিক্রমায় এর ব্যাখ্যা ও বিস্তৃতি হতে পারে।
২. সংবিধান শুধুমাত্র কতগুলো শব্দগুচ্ছ বাক্য বা অনুচ্ছেদের সমাহার নয়। প্রতিটি দেশের সংবিধান সে দেশের জনগণের অভিপ্রায় ও প্রত্যাশা এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে সংরচিত। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি দীর্ঘদিনের হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রাম এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মবলিদানের মাধ্যমে সামরিক শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র, মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বদলে ধর্মনিরপেক্ষতা, শোষণমুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মৌলিক দর্শন ও লক্ষ্য।
৩. ’৭২ সালের সংবিধানের মূল আদর্শ বা রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। পেছনের দিকে তাকালে ঐতিহাসিকভাবেই দৃশ্যমান হবে এই মৌল নীতিগুলো পর্যায়ক্রমে বিকশিত হয়েছে। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি ও আবুল ফজলের লেখা থেকে জানা যায়, দিল্লির মুসলিম শাসকরা চিরায়ত ইসলামী নীতি অনুসরণ করতেন না। ফিরোজ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে জিয়াউদ্দিন বারানি ফিরোজ শাহ তুঘলক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অপরাধীদের শাস্তি বিধান কিংবা রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ফিরোজ শাহ ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত হতেন না। রাজকার্যের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে শরিয়তবিরোধী হলেও সেটা প্রয়োগ করতেন।’ ঐতিহাসিক মোহাম্মদ হাবিব তাঁর ‘দি পলিটিক্যাল থিউরি অব দি দিল্লি সুলতানাত’ বইতে লিখেছেন, কোনো অর্থে মুসলিম সুলতানগণ ধর্মীয়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁরা ইসলামী শরিয়তকে অনুসরণ করতেন না। তাঁরা রাষ্ট্রীয় আইন বা জাওয়াবিৎ ধারা পরিচালিত হতেন। জাওয়াবিৎ হলো রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য বিধি-ব্যবস্থা। এটা কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় বা ওলিমাদের থেকে সৃষ্টি নয়। সম্রাট আকবর ছিলেন প্রথাগত শরিয়তবিরোধী। সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজীর উক্তি ছিল, ‘শরিয়ত যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, সেখানে আমার নির্দেশই কার্যকর থাকবে।’ তবাক-ই আকবরী গ্রন্থে ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিন লিখেছেন, ‘গিয়াসউদ্দিন বলবন রাষ্ট্রের বিষয়টিকে ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিতেন।’ সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দুদের প্রতি অন্য সম্রাটদের মতো উদার বা সহনশীল ছিলেন না বলা হয়। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের একটি চিঠিতে সুন্নি ওমরাহকে উষ্মা প্রকাশ করে লেখেন ‘জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? প্রশাসনের কাজকর্মে ধর্মের নাক গলানোর কী অধিকার আছে? তোমাদের জন্য তোমার ধর্ম আমার জন্য আমার।’ মেবারের রানা রাজসিংহকে প্রেরিত একটি পত্রে আওরঙ্গজেব বলেন, ‘যে রাজা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখায়, সে স্রষ্টার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়।’
৪. ভারতবর্ষ বা এই জনপদে মুসলিম শাসকরা দেশ দখল করেছিলেন, রাজ্য পত্তন করেছিলেন, অন্য ধর্মে হাত দেননি। এ দেশে সুফি-সাধকরা যে উদার মানবতাবোধ, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক নীতি প্রচার করেছিলেন তার ফলেই অন্য ধর্মের নিগৃহীতজনরা খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি কোরআনের সুরাগুলো আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও মানবিকতা দ্বারা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমার নামাজ পড়া অর্থহীন হবে যদি তোমরা মানুষের সেবা না করো।’ এখানে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ নেই, নেই হিংসা বিদ্বেষ। ধর্মে বল প্রয়োগ নেই।
৫. অষ্টম সংশোধনী আলোকে পঞ্চাদশ সংশোধনীতেও বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র-ধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ এই সংশোধনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধর্মের নামে ধাপ্পাবাজি দেওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার লক্ষ্যে এই সংশোধনী সংযোজিত হয়। ’৭২ সালের সংবিধানে এরূপ অনুচ্ছেদ ছিল না। ‘ভোটের রাজনীতি’র দিকে তাকিয়ে ভিন্নভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। যা ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধর্মের নামে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো, যেমনটি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এই মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’ এর মর্মবাণী হলো, রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার।
সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা; (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান; (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার; (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শটি যুক্ত হয়েছে যার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সম্প্রীতির বন্ধনে যা চিরায়িত। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিম ও নৃ-জনগোষ্ঠী পারস্পরিক যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির উদার মিলনমেলার উৎসবে পরিণত হয় তার মধ্যে বড় হয়ে ওঠে মানবিকতার সুমহান আদর্শ।
৬. কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় অতিক্রম করলেও রাষ্ট্রীয় চার নীতির মর্মবাণী বাস্তবায়ন করা যায়নি। কালেভদ্রে তা উচ্চারিত হয় মাত্র। ফলে রাষ্ট্র বিকাশের ধারায় আমরা কাঙ্ক্ষিত ধারায় অগ্রসর হতে পারছি না। আমাদের মননশীলতায় রাখতে হবে ধর্মচর্চা, ধর্মীয় আদর্শ অনুসরণ, শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচার এবং মানবাধিকার ও মানব মর্যাদার মর্মবাণী। এগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম অনুষঙ্গ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিকভাবে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সমতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয় সংহতি দৃঢ় করে।
৭. পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানে গ্রথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পার্থক্য বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানপ্রণেতা ও ফাউন্ডিং ফাদার জেফারসন কয়েক বছরব্যাপী সেকুলারিজমের পক্ষে জোর প্রচারণা চালান। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘Secularism means a wall between state and the religion.’ অর্থাৎ ‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি দেয়াল তুলে দেওয়া।’ কিন্তু বাংলাদেশে এই সংজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। এখানে সব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। রাষ্ট্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা করে থাকে। এমনকি ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের জন্য রাষ্ট্র আর্থিক আনুকূল্য দিয়ে থাকে। সরকারিভাবে ছুটি পালিত হয়।
৮. ইদানীং কেউ কেউ বলে থাকেন, ভারতীয় সংবিধান অনুসরণে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা চলে এসেছে। কথাটি সত্য নয়। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে রচিত ও গৃহীত। অন্যদিকে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনার সঙ্গে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। কোনো ধর্মকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দানের অর্থ হলো অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা। ধর্মীয় সংকীর্ণতা কী মারাত্মক পরিণতির দিকে একটা জাতিকে পরিচালিত করতে পারে, ভারত-বিভাগ তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং ব্যক্তি-দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আলোয় অতীতের গ্লানি, মানবিক অপমান, অমর্যাদা নিরসনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বগ্রাসী দৌরাত্ম্য প্রতিহত করতে এই নবপ্রভাতে ঘোষিত হবে, ‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে।’
লেখক : ’৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী, লেখক ও গবেষক