কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সার্ক পুনরুজ্জীবনের এখনই সময়

আসিফ হাসান নবী, সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৬ নভেম্বর ২০২৪

সার্ক পুনরুজ্জীবনের এখনই সময়

অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান এর সদস্য হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে।  নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগী, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা, শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কারিগরি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের উদ্দেশ্যে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণের জন্য সার্ক গঠিত হলেও আজ তা বিলুপ্তপ্রায়। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক সংগঠনের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। এই আঞ্চলিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পেছনে বিশ্বরাজনীতিসহ নানা নিয়ামক কাজ করছিল। সেই চিন্তায় সার্ক গঠিত হলেও এটি আজ সময়ের পরিক্রমায় কোমায় চলে গেছে। যদিও সার্কের অনেক সফলতা আছে, পাশাপাশি ব্যর্থতাও অনেক। সার্কের এই ব্যর্থতার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলোর অন্যতম হলো, সার্কের সনদে দ্বিপক্ষীয় কোনো সমস্যা ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা ও রাজনৈতিক অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সার্ক অক্ষম ছিল। অথচ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন করে শান্তি স্থাপন করা আঞ্চলিক শান্তি ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বলা হয় সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। অভিন্ন দক্ষিণ এশিয়ার পরিচয় তুলে ধরতে তিনি সত্তর দশকের শেষদিকে একটি আঞ্চলিক সংগঠন শুরু করার পরামর্শ দেন। তিনি মনে করেছিলেন এ ধরনের সংগঠন হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার একটি সেতুবন্ধন তৈরি হবে। এর আলোকে সাতটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা নয়াদিল্লিতে বৈঠকও করেন এবং একটি আঞ্চলিক সমিতি গঠনের খসড়া করেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের দুঃখজনক মৃত্যুর পরেও এ কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯৮৫ সালে সার্ক চূড়ান্ত এবং স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা হয়েছিল। এ ছাড়াও গঠনের পর থেকে, সার্ক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বেশ কয়েকটি শীর্ষ সম্মেলন এবং বৈঠক করেছে।

 

দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ১০ বছর পর্যন্ত সম্ভাবনাময় সার্কের কোনো কার্যক্রম নেই। ২০১৪-এর নভেম্বরে সার্কের শেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল নেপালের কাঠমান্ডুতে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে পরবর্তী সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভুটান যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশ সে সেময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান নাক গলানোয় সার্কে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে মদত দেওয়ার অভিযোগে ভারত অপারগতা প্রকাশ করে। ভুটান আর আফগানিস্তান একই কারণে সম্মেলন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। দ্বিপক্ষীয় টানাপোড়েনের জের ধরে সে বছর ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ছিল বড় ধরনের আঘাত। যে আকাক্সক্ষা নিয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শুরু, দীর্ঘ ৩৯ বছর পরও সেটি মোটামুটি প্রতীকী সংগঠনই থেকে গেছে। অতীতের বিভিন্ন পর্যায়ে আট জাতির এই জোট বড় দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতায় বারবার হোঁচট খেয়েছে।

 

ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থার (আসিয়ান) তুলনা করা হয়েছে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমানের প্রচেষ্টায় জনগণের কল্যাণ ও পারস্পরিক আস্থার উন্নয়নের জন্য সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও কাক্সিক্ষত সফলতা আসেনি। আসিয়ান ১৯৬৭ সালের আগস্টে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে সার্কভুক্ত দেশগুলো আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মতো সমস্যাগুলো ভাগ করে নেয়। সার্ক দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপি আসিয়ানের চার গুণ। সার্ক এবং আসিয়ান-সম্পর্কিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে সার্ক আসিয়ানের চেয়ে বেশি সফল হয়নি। সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সার্কে বিশ্বের জনসংখ্যার ২২% এবং বিশ্বের অর্থনীতির ৩% রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মানব উন্নয়নের জন্যও প্রচুর সুযোগ রয়েছে।

 

ভারত-পাকিস্তান সার্কের দুটি শক্তিশালী ও অন্যতম সদস্য। এই দুই দেশের মধ্যে জন্মলগ্ন থেকে বিরোধ, অবিশ্বাস ও কাশ্মীর নিয়ে রেষারেষি সার্কের সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভারতের বেশি। এই অঞ্চলের ৭১ শতাংশ ভূখণ্ড, জিএনপির ৭৯ শতাংশ, বাণিজ্যের ৫৯ শতাংশ, জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ ও বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তিশালী রাষ্ট্র দেশ ভারত। সংগত কারণে ভারতের মধ্যে একধরনের আধিপত্যসুলভ মানসিকতা সার্কের ব্যর্থতায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

চীন ও আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের কারণে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি প্রকট হয়েছে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনার জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে প্রভাব বিস্তার অব্যাহত রেখেছে। পাকিস্তান চীনের অন্যতম মিত্র রাষ্ট্র। অন্যদিকে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন কৌশলগত নীতিতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সহযোগী দেশ। এই দুই শক্তিশালী দেশ তাদের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো সিদ্ধান্তকে বিভিন্নভাবে রোধ করে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। যেহেতু ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে রাষ্ট্র দুটির, তা ছাড়াও একে অন্যের প্রভাব বিস্তাররোধে সব সময় চেষ্টা করে, যা সার্কের ব্যর্থতাকে ত্বরান্বিত করেছে।

সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কম শুল্কে বাণিজ্য করা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ সম্মেলনে সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু পরে তা আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনিচ্ছায় সাফটা চুক্তির অকালমৃত্যু ঘটে, যা সার্কের প্রধান ব্যর্থতার একটি; অধিকন্তু, নিয়মিত সার্ক সম্মেলনের আয়োজন করতে না পারার ব্যর্থতাও রয়েছে।

 

সার্কের বিপরীতে ভারতের উদ্যোগে গঠিত হয় বিমেসটেক- যার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার, ভুটান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা রয়েছে। এখানে সার্কের অধিকাংশ রাষ্ট্র থাকলেও নেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ। অনেকেই সার্কের এ অন্ধকার সময়ে বিকল্প হিসেবে বিমেসটেককে চিন্তা করছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিমসটেক সার্কের বিকল্প নয়, পরিপূরক। কিন্তু কিছু রাষ্ট্রকে বাইরে রেখে এই বিমসটেক কতটুকু সফল হবে সে প্রশ্নও থেকে যায়? পৃথিবীর অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান ও আফ্রিকান ইউনিয়নের সফলতা আজ সেসব আঞ্চলিক উন্নয়নে অগ্রসর ভূমিকা পালন করে আসছে। ওই আঞ্চলিক সংস্থার মতো দক্ষিণ এশিয়ার এই আঞ্চলিক সংস্থাও অনেক ভূমিকা রাখতে পারত। এ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মো. ইউনূস সার্ককে পুনরুজ্জীবিত ও গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি সম্প্রতি জাতিসংঘে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সার্ক পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে কথা বলেছেন। শাহবাজ শরিফ এই উদ্যোগে ড. ইউনূসের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং দেশগুলোকে আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া ড. ইউনূস দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গেই সার্কের বিষয়ে কথা বলেছেন। সবাই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। এক সংবাদ মাধ্যমে ড. ইউনূস বলেছেন, সার্কের মতো জোট আঞ্চলিক অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। একটি মহৎ উদ্দেশ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি এখন নিষ্ক্রিয়। দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি, বিপুল জনগোষ্ঠী এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকার পরেও সার্ক কার্যকরভাবে তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তিনি আরও বলেছেন, এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি দুর্দান্ত আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থা হতে পারে।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় বহু বাধা রয়েছে। পাকিস্তান এবং ভারতশাসিত কাশ্মীরে বিভক্ত থাকা কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে বিরোধ ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই বৈরী। অন্যদিকে ইসলামাবাদ চায় সার্ক বৈঠকে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করুক একজন তালেবান কর্মকর্তা। কিন্তু সার্কভুক্ত দেশগুলোর কোনোটিই এখন পর্যন্ত কাবুলের তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সার্কভুক্ত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা কমিয়ে ড. ইউনূসের জন্য পুনরায় সংস্থাটি সক্রিয় করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক গবেষকরা।  তবু বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সার্কের পুনরুজ্জীবন এবং সক্রিয় হওয়া এখন সময়ের দাবি শুধু আঞ্চলিক ক্ষেত্রেই নয়, সার্কের পুনরুজ্জীবন বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।  দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত অগ্রগতি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি একটি ঐক্যবদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ অঞ্চলে রূপান্তরিত করবে বলে সকলে আশাবাদী।

 

লেখক : সহসভাপতি, সার্ক জার্নালিস্ট ফোরাম (বাংলাদেশ চ্যাপ্টার)