কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সাতচল্লিশ থেকে চব্বিশ

অভ্যুত্থানের অর্জনকে ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে ঐতিহাসিকতা এটিএম নুরুল আমিন [প্রকাশ : বণিক বার্তা, ১৯ আগস্ট ২০২৫]

সাতচল্লিশ থেকে চব্বিশ

ইতিহাসবোধ ও সচেতনতার বিবেচনায় আমরা কতটা অখেয়াল ও অসাবধান, তার একটি বড় উদাহরণ হলো প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতার পর আমরা যে স্বাধীনতা ব্রিটিশ বা ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হলাম তার কোনো মাইলফলক আমাদের ইতিহাসে না থাকার মতো, নেই তার উদযাপন। ভারত এ ঐতিহাসিক দিনকে উদযাপন করে ১৫ আগস্ট, পাকিস্তান করে ১৪ আগস্ট। কী কারণে ইংরেজ শাসন ও গোলামি থেকে আমাদের মুক্তি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে বাদ হয়ে গেল সে প্রশ্ন কেউ করেনি। আজও করে না। একসময় না হয় ভীতির জন্য করা হয়নি। এখনো কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই।

 

 


ইতিহাস থেকে এ বিচ্যুতির একটি অব্যক্ত কারণ হতে পারে যে ১৪ আগস্টকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস মনে করা হয়। এ ধারণা ভ্রান্ত, কেননা পাকিস্তান ২৩ মার্চকে  পালন করে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে আর সঠিকভাবেই ‘১৪ আগস্টকে’ পালন করে  ‘ইয়াম-এ-আযাদি’  দিবস হিসেবে। কাজেই  ‘১৪ আগস্টকে’ ব্রিটিশদের পরাধীনতা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন না করার কোনো ঐতিহাসিক কারণ নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে এক রাষ্ট্র গঠন ও তা পরিচালনার ব্যর্থতা ভিন্ন এক ইতিহাস। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ওই প্রচেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হলো। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলো। ২৫ মার্চ নির্ধারণ হলো  ‘স্বাধীনতা দিবস’ এবং ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’। সেই সঙ্গে পরিত্যক্ত হলো ২০০ বছরের ইংরেজ গোলামি থেকে মুক্তির মাইলফলক। অথচ ইতিহাস থেকে বিচ্যুত না হয়ে সহজ সমাধান হতে পারত ‘১৪ আগস্টকে ব্রিটিশ ভারত থেকে মুক্ত হওয়ার দিন’ হিসেবে পালন করার বিধান রাখা।

 

 


এখানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে এক রাষ্ট্র গঠনের ঐতিহাসিক অপরিহার্যতা, সে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতা ও ২৫ মার্চের ভয়াল রাত থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে কয়েক লাখ মানুষের জীবনদান, এসব নিদারুণ বাস্তবতার কারণে আমাদের ইতিহাস থেকে মুছে গেছে ১৯৪৭ সালের অর্জন। এ অর্জনকে ইতিহাস থেকে বাদ দিলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তিকেই শুধু বাদ দেয়া হয় না বাদ দেয়া হয় এ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ভিত্তিকে। ১৯৭১-এ আমাদের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ অর্জনের পর পরই মনীষী আবুল ফজল বলেছিলেন, হয়তো লিখেছিলেনও, ‘পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না’। ১৯৭৩ বা ১৯৭৪ সালে, আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির লেকচারার হয়েছি, আবুল ফজল একটি একক বক্তৃতা দেন। ওই বক্তৃতায় তিনি যথাযথভাবে এ কথার ব্যাখ্যা দেন। আমাদের বয়সের মানুষ বা আমাদের থেকে দীর্ঘ আয়ুর মানুষ যারা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি দেখেছেন বা তা নিয়ে লেখালিখি পড়েছেন, তাদের কাছে এ বিষয় পরিষ্কার না থাকার কারণ নেই যে শুধু ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে মুক্তিই নয়, বাংলাদেশের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ। আজ রাজনৈতিকভাবে একটি মুক্ত পরিবেশে আছি বলে এ কথাগুলো বলতে পারলাম। ২০২৪-এর অর্জন যে কত বড় এটিও তার দিকনির্দেশনা করে।

 

 

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১-কে কেন্দ্র করে। অবশ্যই ৭১ হঠাৎ করে আসেনি। ১৯৪৭ সালের অর্জনের পর পরই ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা অভাবিত বিজয়, কে ভেবেছিল ১৯৪৭-এর সাত বছরের মধ্যে  ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রদানকারী দলটি এভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। ২৩৭টি ‘মুসলিম আসনের’ মধ্যে  ‘মুসলিম লীগ’ দলটি পায় মাত্র নয়টি, আর ‘যুক্ত ফ্রন্ট’ পায় ২২৩টি। ভোট দেয়ার অধিকার পেলে এ দেশের নাগরিকরা তাদের ভোটের অধিকার কীভাবে প্রয়োগ করে, তা দেখা গেছে ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্ত বাংলা বা অবিভক্ত বাংলার তিনজন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হওয়ার ইতিহাসে। এ তিন নেতাই ব্রিটিশ ভারত ও পরবর্তীকালে পাকিস্তান শাসনামলেও ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ও ‘নিখিল পাকিস্তানের’ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আর যিনি ক্ষমতায় না গিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং রাজনীতিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি হলেন মওলানা ভাসানী। এ ধারাবাহিকতার পরও আমাদের ইতিহাস থেকে ১৪ আগস্ট কীভাবে মুছে গেল তা একটি বিস্ময়। অবশ্য বড় কারণ ১৯৭১। ২৫ মার্চের ভয়াল রাত, নয় মাসের মৃত্যু, জীবন বাঁচানোর জন্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে আশ্রয় এবং তাতেও রক্ষা না হলে প্রতিবেশী দেশের একই ভাষাভাষী অঞ্চলে গিয়ে এ দেশের মানুষ বেঁচেছে। 

 

 

এ নিষ্ঠুর বাস্তবতার আঘাতে আমাদের ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে শুধু ১৪ আগস্ট নয়, ২০০ বছরের ইংরেজ গোলামি থেকে মুক্তির দিনক্ষণ। নতুন অর্জনের এ সময় আমাদের নির্মোহভাবে ইতিহাসের মাইলফলকগুলোকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টকে আমাদের ব্রিটিশ ভারত থেকে মুক্ত হওয়ার দিবস হিসেবে না পালন করার কোনো ঐতিহাসিক কারণ নেই। এমনকি এ দিনকে (১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট)  ‘স্বাধীনতা দিবস’ ও ১৯৭১-এর ২৬ মার্চকে আমাদের  ‘জাতীয় স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত ও উদযাপন করা যায়। আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যে রাষ্ট্রকাঠামো  গড়ে উঠেছিল তা শুধু অবাস্তবই ছিল না, তা সুযোগ করে দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের বা পূর্ব  বাংলায় জাতীয় (বাঙালি জাতির) শোষণের। এর থেকেই আমাদের মুক্তি হয় রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এ মুক্তি এনে দিয়েছে বিজাতীয় শোষণের অবসান। তাই এ দিবস যথার্থই ‘জাতীয় স্বাধীনতা দিবস’। এ পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা একদিকে ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছিন্নতা পরিহার করতে পারি এবং আমাদের একাত্তরের অর্জনকে সঠিক ঐতিহাসিক নিরিখে ‘জাতীয় স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত ও পালন করতে পারি।

 

 

যে ভূমি,  সীমানা ও জনগণ নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন—বাংলাদেশ—১৯৭১ পার হতে হতেই বিভক্তি নেমে এল। প্রথম বিভক্তি পরিলক্ষিত হলো ‘মুজিববাদ’ ও ‘বৈজ্ঞানিক’ সমাজতন্ত্রের মধ্যে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে সরকার গঠিত হলো তার মূলমন্ত্র ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার’ টিকে থাকল না সদ্যমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে। শাসনতন্ত্রে গৃহীত হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। চিন্তা করা হলো না  সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের মতো ঐক্য স্থাপনকারী হলো কিনা এ চার মূলনীতি।  ধর্মনিরপেক্ষতা বা  সমাজতন্ত্র কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য? কোনো রাজনৈতিক দল সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কর্মসূচি নির্বাচনে গিয়ে বিজয়ী হয়ে সে অনুসারে ‘সরকার’ পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু কোনো দলের কর্মসূচি বা নীতি তো রাষ্ট্রের  নীতি হতে পারে না। এর অনিবার্য পরিণতি হলো বিভক্তি—যে বিভক্তি দলের সঙ্গে দলের বা দলীয় কর্মসূচির বিভিন্নতা নয়, রাষ্ট্রের আদর্শ নিয়ে বিভক্তি। এর অনিবার্য পরিণতিতে গঠিত হলো একদল ও একদলীয় সরকার। ফলে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দল একাকার হয়ে গেল। 

 

 

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ হলো চরম মূল্যে ও সামরিক শাসনের মাধ্যমে, যার কণ্ঠে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে কণ্ঠ আবার শোনা গেল। বহুদলীয় ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি আবার প্রতিষ্ঠিত হলো। মোটামুটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতি চলার পথে আবার জের পড়ল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যা ও এরশাদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে।  ১৯৮১-৯০ সাল সামরিক শাসক এরশাদ দেশ চালাল। সব রাজনৈতিক দলের  ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে শুধু এরশাদ থেকে পরিত্রাণই হলো না, জাতি পেল একটি নতুন সনদ। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দল গ্রহণ করল এমন একটি  নির্বাচন প্রক্রিয়া, যাতে নির্বাচনকালীন সরকার হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বল্পকালীন নিরপেক্ষ সরকার। যাদের মূল দায়িত্ব স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা। তিনটি নির্বাচন—১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধান দুটি দল সরকার গঠন করে দেশ শাসনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রাখল। 

 

 

বাংলা প্রবাদের ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’ কথাকে প্রমাণ করে ২০০৬ সালে নির্বাচনের আগে দেশের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে লগি-বৈঠার শক্তি প্রয়োগে ছয়জন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে দেশে সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। দুই বছর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর চলে জেল-জুলুম ও নির্যাতন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার জন্য চাপের মুখে সামরিক শাসকরা বাধ্য হয় নির্বাচন দিতে। শেখ হাসিনা  ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতেই ক্ষমতা ধরে রাখার ফন্দি-ফিকির বের করার কাজে লেগে যান।  ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তিন-তিনটি নির্বাচনের ফলাফলে তার দৃঢ় উপলব্ধি হয়, সংবিধানসম্মত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার দলের ক্ষমতা এক নাগাড়ে (বাস্তবতা ছিল কোনো দলই) এক টার্মের বেশি স্থায়ী হবে না। তাই দেশের আইন বিশেষজ্ঞ, সর্বদলীয়  সংসদীয় কমিটি, সব বিরোধী  রাজনৈতিক দল ও জনগণের অভিমতকে উপেক্ষা করে ১৯৯১-এর রাজনৈতিক সমঝোতা ও  নিজের ‘আন্দোলনের ফসল’—নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন  বিধান বাতিল করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে ভোটারবিহীন এক ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ‘এক দলীয়’ শাসনের মর্মান্তিক পরিণতির অভিজ্ঞতাও স্মরণ না করে  ‘এক ব্যক্তি’র শাসনকে শ্রেয় মনে করলেন। ভয়-ভীতি ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিবেকবান মানুষকে চুপ করার প্রয়াস চালালেন। নির্মমভাবে অত্যাচার চালানো হলো বিরোধী দলের ওপর বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দল দুটির ওপর। জঙ্গি নাম দিয়ে বা নাটক সাজিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীর ওপর চাপিয়ে দেয় অস্বাভাবিক জীবন। 

 

 

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রজ্ঞাময়ী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন ও জনগণের বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে প্রিয় হয়ে ওঠেন, সে নেতাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে না দিতে পারলে একনায়কত্ব চালানো সম্ভব নয় জেনে তার বিরুদ্ধে চলে নানা চক্রান্ত। একপর্যায়ে অমূলক মামলার মাধ্যমে নেয়া হয় জেলে। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ‘বিএনপি-জামায়াত’ হয়ে ওঠে একটি গালি। বেগম জিয়া জেলে, তারেক রহমান বিদেশে নির্বাসিত, জামাত নেতৃত্বকে তো ফাঁসিকাষ্ঠে নিয়ে শেষ করা হয়েছে। আর কে থাকে? ড. মোহাম্মদ ইউনূস—যে একটি নাম (তার কাজের মধ্যমে), বাংলাদেশের পরিচিতি ও মর্যাদাকে এক অনন্য পরিচিতির শুরু হয় একের পর এক মামলা। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি যে চোখের পানি ফেলেন, তা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তাও দেখেন! 

 

 

 

আঠারো বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতি, জরা-মৃত্যুতে ক্ষয়িষ্ণু স্ট্যান্ডিং কমিটি—এক অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলভাঙনের সব চেষ্টা রুখে দিলেন, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে একক প্রচেষ্টায় আন্দোলনের এক পর্যায়ে ধরে টেনে আনলেন ড. কামাল হোসেন ও কাদের সিদ্দিকীর মতো আওয়ামী ঘরানার রাজনীতিবিদদের। একটি বড় সফলতা বোধ হয় প্রখ্যাত জাসদ নেতা আসম আব্দুর রব, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহমুদুর রহমান মান্না ও জোনায়েদ সাকির মতো প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ বাম নেতাদের ও তাদের স্ব-স্ব দল ও জোটকে নিয়ে ১৯৯০-৯১ স্টাইলে যুগপৎ আন্দোলন সৃষ্টি করা।  বিএনপির হাজার হাজার কর্মী ও বিভিন্ন স্তরের নেতাদের অসহায় অবস্থা, জেল-জুলুম, তুলে নিয়ে যাওয়া, আয়নাঘর ভীতি  ও বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করতে পারা মির্জা আলমগীরের চোখের পানি এ দেশের তরুণ-তরুণী, বয়স্ক-বৃদ্ধ, বাম-ডান সব মানুষকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে সংবেদনশীল করে তোলে। 

 

 

 

রাজনীতিতে তরুণদের প্রয়োজন, এ আহ্বানের কোনো এক পর্যায়ে ২০১৮-তে ঘটে যায় এক বিস্ময়। হাজার হাজার স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে আসে, তাদের দুই সহপাঠীর অসহনীয় মৃত্যু দেখে। এ যেন ২০২৪-এর পূর্বাভাস। যা সম্ভব হচ্ছিল না ১৫ বছরের অবিরাম সংগ্রামে, তা সম্ভব করে দিল চাকরির কোটাবিরোধী আন্দোলনে। এ আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করল শাসকের একটি কথা—মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাকবে না, তবে কি কোটা হবে রাজাকারদের জন্য! এ যেন কাজ করল ফরাসি বিপ্লবে রানীর যে কথা—রুটি না থাকলে কেক তো খেতে পারে! মুহূর্তের মধ্যে স্বৈরাচার পতনের স্লোগান তৈরি হয়ে গেল—তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। এক আবু সাঈদ-এক মুগ্ধ থেকে সৃষ্টি হলো অগণিত আবু সাঈদ-মুগ্ধ। যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মনে করা হতো রাজনীতি-আন্দোলন বিমুখ, তারা নেমে এল হাজারে হাজারে। মা নেমে এলেন কোলের শিশুকে নিয়ে! এ দৃশ্য দেখে একজন  প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্লেষক বলেছেন, ‘যখন দেখলাম, মা তার কোলের সন্তান নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এসেছেন, তখনই বুঝতে পারি হাসিনার দিন শেষ!’

 

 

২০২৪ জুলাই—নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হলো, স্বৈরাচার পালিয়ে গেল ৫ আগস্ট। আমাদের এ ভূখণ্ডে যারা বাম  বা একসময় নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত বা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, এগারো দফা আন্দোলন বা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেখেছেন বা পরিচালনা করেছেন, তাদের কাছেও অবাক বিস্ময় হওয়ার কথা ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনে সমন্বয়কদের ভূমিকা। এ আন্দোলন ও সমন্বয়কদের নিয়ে বই লেখা শুরু হয়েছে। তারা নিজেরাও লিখবেন। তখনই জানা যাবে, কী পটভূমিতে তারা এগিয়ে এলেন ও কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। 

 

 

এবার ফেরা যাক ২০২৪-এর অর্জনকে ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে ঐতিহাসিকতাবোধের প্রয়োজনে। হাসিনার মতো শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করাই একটি বিশাল অর্জন। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ও গঠনের সর্বজনীন নীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করা কোনো কম অর্জন নয়, যা ১৫ বছর ধরে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং যা সম্ভব হয়েছিল ভয়-ভীতি-সন্ত্রাস-জেল-জুলুম ও তাবেদার গোষ্ঠী সৃষ্টি করে। যে বিষয়ে সাবধানতা প্রয়োজন, তা হলো যে পরিবর্তন বাস্তবসম্মত, তার জন্যই মনোযোগ দেয়া। স্বাপ্নিক হওয়ার মূল্য অনেক বেশি।

 

 

 

এ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের ছোট দেশে সমস্যার অন্ত নেই। অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, আয় করার কাজের অভাবে সন্তানদের শিক্ষা দিতে না পারা, অর্থের অভাবে রোগমুক্তির জন্য চিকিৎসা দিতে না পারা নিয়ে এ দেশের শতকরা ৯০-৯৫ জন মানুষের জীবন। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ ও প্রসারিত করার কাজে নিয়োজিত ও  বিকশিত হোক রাজনীতিবিদ ও শাসন-প্রশাসনের সবার মেধাশক্তি। সর্বোপরি, মানুষের আচরণ পরিবর্তনের জন্য দরকার ‘মানুষকে আইন-কানুন অনুসরণ’ করায় বাধ্য করা,  ‘অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে-বা-না-দিয়ে’ সর্বোপরি মানুষের মধ্যে ‘নৈতিকতা-নীতিবোধ ও ন্যায্যতা’ প্রসারে বাবা-মা ও সব স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা।

 

 

এটিএম নুরুল আমিন: ইমেরিটাস অধ্যাপক