কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সীমান্ত উত্তাপ থেকে বৈশ্বিক উদ্বেগ

উম্মুল ওয়ারা সুইটি। সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০১ মে ২০২৫

সীমান্ত উত্তাপ থেকে বৈশ্বিক উদ্বেগ

কাশ্মীর হলো ইতিহাস, রাজনীতি এবং যুদ্ধের আবর্তে বন্দি এক ভূখণ্ড। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার মূল কেন্দ্র এই অঞ্চল। ২২ এপ্রিল পাহালগামে ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর পর, দক্ষিণ এশিয়ায় আবারও উত্তেজনার ঢেউ উঠেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ, চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্য রক্ষানীতির মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিতে এক নতুন অনিশ্চয়তার যুগের সূচনা ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বিশ্লেষণ করব বর্তমান উত্তেজনার কারণ, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা।

 
 
 

কাশ্মীর সংকটইতিহাসের পুনরাবৃত্তি : কাশ্মীর ইস্যুর শিকড় ১৯৪৭ সালে, যখন ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয় এবং প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় (১৯৪৭-৪৮)। পরবর্তী সাত দশকে দুই দেশ তিনবার (১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৯৯) সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে, যার প্রতিটির কেন্দ্রে ছিল কাশ্মীর। ভারত কাশ্মীরকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে, যেখানে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল (যা ২০১৯ সালে বাতিল করা হয়)। অন্যদিকে পাকিস্তান কাশ্মীরকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হিসেবে নিজের দাবি করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে প্রচার চালিয়ে আসছে। পাশাপাশি, কাশ্মীরের মধ্যে থেকেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাধীনতার দাবি করে, যারা ভারত কিংবা পাকিস্তান, কোনো পক্ষকেই একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চায় না। ফলে রাজনৈতিক, সামরিক এবং মানবাধিকার সংকট ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে। যে কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের পরিস্থিতি।

 

 

পাহালগাম হামলানতুন অচলাবস্থা : ২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটক নিহত হন। ভারত অভিযোগ করে, হামলাকারীরা পাকিস্তান থেকে মদদপ্রাপ্ত। পাকিস্তান তা অস্বীকার করে এবং নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানায়। তবে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল কড়া সীমান্তে সেনা সংখ্যা বাড়ানো, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস, সিন্ধু বা ইন্দাস পানি চুক্তির বাস্তবায়ন স্থগিত, বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত, আকাশপথ সীমিতকরণ। ভারতীয় সেনাপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি কাশ্মীরে সফর করে কড়া বার্তা দেন ‘ভারত তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কোনো ছাড় দেবে না।’

 

 

পাকিস্তানের পাল্টা কৌশল : পাকিস্তানও দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্পূর্ণ স্থগিত, আকাশপথ বন্ধ করে দেয়, সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন, জাতিসংঘ ও ওআইসির (ঙওঈ) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন চাইছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দাবি করেছেন, ভারত ‘আঞ্চলিক শান্তি বিপন্ন করছে’ এবং পাকিস্তান আত্মরক্ষার সম্পূর্ণ অধিকার সংরক্ষণ করে।

 

 

 

চীনের দৃশ্যপটপাকিস্তানের বিশ্বস্ত মিত্র : চীন এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে। সম্প্রতি চীন ও পাকিস্তানের যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তোলা হয় যা ভারত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। চীনের আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপসমূহ : পাকিস্তানের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় চুক্তি সম্প্রসারণ, পাণ্ডা বন্ড ইস্যুর অনুমোদন, চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (ঈচঊঈ) প্রকল্পে নতুন বিনিয়োগ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে তদবির, চীন মূলত চাইছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আধিপত্যের প্রতিরোধ এবং ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লি ঘনিষ্ঠতাকে ব্যালেন্স করা।

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাভারসাম্য রক্ষার কৌশল : যুক্তরাষ্ট্র প্রথমদিকে কাশ্মীর হামলার নিন্দা জানালেও দুপক্ষকে ‘দায়িত্বশীল সমাধান’ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বারবার বলেছে, ‘আমরা চাই ভারত ও পাকিস্তান সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিরসন করুক।’ কিন্তু বাস্তবে ওয়াশিংটন : ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্প্রসারণ করেছে (অটকটঝ-এর এশিয়ান সংস্করণ গঠনের আলোচনায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে), পাকিস্তানের ওপর চাপ বজায় রেখেছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘আরও দৃশ্যমান’ পদক্ষেপের জন্য, চীনা প্রভাব রুখতে ভারতকে আঞ্চলিক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে এগিয়ে নিচ্ছে, পাকিস্তান এটিকে ‘ভারতপ্রীতি’ হিসেবে দেখে ক্ষুব্ধ।

 

 

আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা : কাশ্মীর সংকটের পাশাপাশি আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তেও নতুন উত্তেজনা : পাকিস্তান বলছে, আফগানিস্তানের তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (ঞঞচ) সদস্যরা সীমান্ত পার হয়ে হামলা করছে। প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়েছে। তালেবান সরকার এই হামলার প্রতিবাদ করে বলেছে, এটি আফগান সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। এর ফলে দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সম্পর্ক ভয়াবহভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অশনিসংকেত।

 

 

 

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ : বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় চারটি বড় ধারা স্পষ্ট : ভারত এখানে আঞ্চলিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায়; যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন লাভ করছে।  পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সমর্থন খুঁজছে, তারা চীনের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতবিরোধী ঘাঁটি গড়তে পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে।

 

 

ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দৃশ্যপট : ১. ভারত-পাকিস্তান সীমিত সামরিক সংঘর্ষ : যদিও উভয় দেশ পারমাণবিক শক্তিধর, তবে সীমিত সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে কাশ্মীর সীমান্তে।

২. আঞ্চলিক মেরুকরণ : ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ধরনের দুটি ব্লক গঠনের সম্ভাবনা বাড়ছে।

৩. অর্থনৈতিক বিপর্যয় : অঞ্চলের উত্তেজনা আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পর্যটন খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

৪. আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার সম্ভাবনা : বিশ্বের বড় শক্তিগুলো (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) হয়তো সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে।

 

 

সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতে সম্ভাব্য প্রভাব : এটাও দুই দেশের মধ্যে একে অপরকে ঘায়েল করার অস্ত্র। আসলে কি ভারত সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ করতে পারবে? তবে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করলেও এর প্রভাব পড়বে। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি (ওহফঁং ডধঃবৎং ঞৎবধঃু-ওডঞ) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির অধীনে : ভারতের দখলে থাকা তিনটি পূর্বের নদী (বিয়াস, রবি, শতদ্রু) ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার পায় ভারত। পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত হয় তিনটি পশ্চিমের নদী (সিন্ধু, ঝেলম, চেনাব)। ভারত পশ্চিম নদীগুলো থেকে সীমিত পরিমাণ পানি ব্যবহারের অনুমতি পায় (সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাল খনন ইত্যাদি সীমায়িত উদ্দেশ্যে) তবে পানিপ্রবাহ বন্ধ বা বাধা দেওয়া নিষিদ্ধ। এটি বিশ্বের অন্যতম সফল আন্তঃদেশীয় নদী-ব্যবস্থাপনা চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে দীর্ঘকাল। যুদ্ধকালেও (১৯৬৫, ১৯৭১, কারগিল ১৯৯৯) এই চুক্তি বলবৎ ছিল।

 

 

২২ এপ্রিল পাহালগাম হামলার পরে, ভারতের তরফ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, তারা সিন্ধু পানি চুক্তি পর্যালোচনা বা স্থগিত করতে পারে। এমনকি ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে কার্যকর পরামর্শ হয়েছে। ভারতের অভিযোগ পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হওয়া সত্ত্বেও শান্তিচুক্তির সুফল পাচ্ছে, এটি অনৈতিক। ফলে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ একটি কৌশলগত চাপের হাতিয়ার হতে পারে। এতে করে  পাকিস্তানের পানি সংকট তীব্র হবে। পাকিস্তানের মোট চাষযোগ্য জমির ৮০% সিন্ধু নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। পানির প্রবাহ কমে গেলে দেশটি ভয়াবহ কৃষি ও খাদ্যসংকটে পড়বে। এখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকিতে পড়বে। খাবার পানি সংকট দেখা দেবে। ফলে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়বে, এটা নিশ্চিত। পানি যুদ্ধের হুমকি বাস্তবে পরিণত হতে পারে। পাকিস্তান এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে, কিংবা ভারতের বিরুদ্ধে আরও কঠিন কূটনৈতিক ও সামরিক অবস্থান নিতে পারে। বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করবে চুক্তি মানতে।

 

 

 

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত বা বাতিল করা হলে তা শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে। ‘পানির ওপর কূটনীতি’ হয়ে উঠবে এক নতুন সংঘাতের ক্ষেত্র। সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিলের সম্ভাবনা যেমন দক্ষিণ এশিয়াকে নতুন পানি যুদ্ধের ঝুঁকিতে ফেলবে, তেমনি ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক ভারসাম্য স্পষ্টত ভারতের অনুকূলে থাকলেও, পারমাণি বক শক্তির কারণে প্রকৃত যুদ্ধ সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। সুতরাং, ভবিষ্যৎ উত্তেজনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে কূটনৈতিক সংযম ও জলবণ্টন চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখা। পানি, শক্তি ও অস্ত্র তিনটি ক্ষেত্রেই উত্তেজনার ব্যবস্থাপনা ছাড়া, আঞ্চলিক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। কাশ্মীর শুধু একটি ভূখণ্ড নয় এটি দক্ষিণ এশিয়ার পুরো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। আজকের বিশ্বে যেখানে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর, সেখানে কাশ্মীর সংকট দক্ষিণ এশিয়াকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা ছাড়া, এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়। অতএব, এই মুহূর্তে কূটনৈতিক সংযম ও সুবিবেচনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। অন্যথায়, দক্ষিণ এশিয়া ফের রক্তাক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মুখোমুখি হবে।

 

 

লেখক: সাংবাদিক