কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে গুজব ছড়ানো বন্ধ হোক

মিজানুর রহমান সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৬ নভেম্বর ২০২৪

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে গুজব ছড়ানো বন্ধ হোক

ভ্রমণপিয়াসিদের মধ্যে সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণ অনেকটা স্বপ্নের মতো। নীল আকাশের সঙ্গে সাগরের নীল জলের মিতালি সারি সারি নারকেলগাছ এ দ্বীপকে করেছে অনন্যা। ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করা জিরিয়া, জৌরালি, গুরিন্দা, গাঙচিল, পানচিল, বাটানসহ আরো অন্যান্য অনেক পাখির সমাগম এ দ্বীপে। সারা দিনে এদের  কিচির মিচির শব্দ আর প্রাণচাঞ্চল্যে  ভরে থাকে এ দ্বীপ।

একসঙ্গে কয়েক শ পাখির ওড়াউড়ি আকাশে চক্কর দিয়ে আবার এসে পানিতে নামা এবং পানিতে ডানা ঝাপটানোর অসাধারণ সেই  দৃশ্যপটে মুগ্ধতায় মন ভরে যায়। এর আকর্ষণে আমাদের বারবার যেতে ইচ্ছে করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। কক্সবাজার যাওয়ার এখন বেশ ভালো ব্যবস্থা আছে। ঢাকা থেকে ট্রেন যোগাযোগ কক্সবাজারে  স্থাপিত হওয়ায় দ্বীপটিতে ভ্রমণের আকর্ষণ অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
প্রতিবছর লাখ লাখ লোকের যাতায়াতে দ্বীপটি ভারাক্রান্ত। পরিবেশ বেসামাল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বর্তমান সরকার এই আকর্ষণীয় দ্বীপটিতে যাতায়াত সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। এটাকে পুঁজি করে অনেকে গুজব ছড়াচ্ছে।
সমুদ্রের  লীলাভূমিটি রক্ষা করাও সবার দায়িত্ব। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কিভাবে আমরা পেলাম এটা অবশ্যই সবার জানা দরকার।

 

সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ, যা মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণে এবং কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গকিলোমিটার একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা, যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলো ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গকিলোমিটার।

এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার।

 

স্থানীয় ভাষায় সেন্ট মার্টিনকে নারিকেল জিঞ্জিরা বলে ডাকা হয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। সেন্ট মার্টিন কিভাবে আমাদের হলো, এই নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন এবং অধ্যাপক মোস্তফা কামাল পাশা। তাঁদের গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় ৫০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে ওঠে। এর ১০০ বছর পর উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।

গবেষণা থেকে জানা যায়, ২৫০ বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে এ দ্বীপটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা এ দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিত। তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেছিল জাজিয়া। পরে নারিকেল জিঞ্জিরা হিসেবে পরিচিতি পায়।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। যদিও সে সময়টিতে ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। তার পরও সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে জানায়।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, খ্রিস্টান সাধু  মার্টিনের নামে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৮৯০ সালে কিছু মৎস্যজীবী এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। এদের কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক ছিল। ধীরে ধীরে এটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে মিয়ানমার সরকার একটি জনসংখ্যাবিষয়ক মানচিত্রে সেন্ট মার্টিন সে দেশের অংশ হিসেবে দেখিয়েছিল বলে অভিযোগ করে বাংলাদেশ। তখন ঢাকায় নিযুক্ত মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে জরুরি তলব করা হয়েছিল এবং কড়া প্রতিবাদ জানানো হয় তারা ভুল স্বীকারও করে।

দ্বীপটিতে ভ্রমণপিয়াসিদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিক অনেক আবাসিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ১৭ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে থাকার জন্য ১৫০টি হোটেল রিসোর্ট হয়েছে। সেন্ট মার্টিনে যেহেতু শুকনা সিজনে যাওয়া যায় তাই অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।

কক্সবাজারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে লোকজনের মাত্রাতিরিক্ত সমাগমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো যাচ্ছে না। এক গবেষণায় জানা যায়, পর্যটকদের কারণে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি লবণাক্ত বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কচ্ছপের আবাস ধ্বংস, প্লাস্টিকের ব্যবহার, পলিথিন পেপার, মিঠা পানির সংকট, জোয়ারে সমুদ্রের ভাঙনসহ নানা বিপদ দেখা দিয়েছে। দ্বীপে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ১০ হাজারের মতো থাকলেও কয়েক লাখ পর্যটক থাকেন। পর্যটকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট যেখানে-সেখানে ফেলার কারণে প্রচুর কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে। কিছুদিন হলো দ্বীপে আরেকটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে, মাছির মতো মারাত্মক ক্ষতিকর সাদা পোকার উৎপাত বেড়েছে। এই পোকা দ্বীপের গাছপালা ধ্বংস করছে। দুর্লভ প্রকৃতির অনেক গাছ ছিল,  সেগুলো ধ্বংসের পথে। প্রায় ৪০০ নারকেলগাছ ধ্বংস করেছে এ বিষাক্ত পোক, কিন্তু তা নির্মূল করা যাচ্ছে না।

বিগত সরকার দ্বীপ বাঁচানোর জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৯৯ সালে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। সেন্ট মার্টিনে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারের উদ্যোগে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসকে একটি সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা শেষে জানায়, দ্বীপটিতে কোনোভাবেই পর্যটকদের রাতে থাকার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। শীতে পর্যটন মৌসুমে দিনে এক হাজার ২৫০ জনের বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।

শেখ হাসিনা সরকারের সময় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং টেকসই পর্যটন নীতিমালা শীর্ষক মিটিং হয় ২০২৩ সালের ২৩ জুন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে দিনে ৯০০ পর্যটককে সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হবে। আগ্রহীদের মাথাপিছু সরকারকে এক হাজার টাকা করে রাজস্ব দিতে হবে। দ্বীপে হোটেলে রাত যাপন করলে দিতে হবে দুই হাজার টাকা। নভেম্বর ২০২৪ থেকে কার্যকর করার কথা ছিল।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের ব্যাপারে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। সে আলোকে ২২ অক্টোবর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির একটি সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেসসচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, সরকার সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই চার মাস সেখানে পর্যটক সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নভেম্বরে পর্যটক যেতে পারবেন, কিন্তু রাতযাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে যেতে পারবেন এবং রাতযাপন করতে পারবেন, তবে দুই হাজারের বেশি পর্যটক প্রবেশ করতে পারবেন না। তবে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার থাকবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান চলবে। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিন একটি প্রবাল দ্বীপ, তাই এ দ্বীপের পরিবেশগত বৈচিত্র্য ধরে রাখতে বছরের চার মাস সেখানে পর্যটক সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পদক্ষেপগুলো গ্রহণ না করলে দ্বীপে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে। মূলত এ কারণে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়েছে কক্সবাজার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিবেশ ও পর্যটন উন্নয়ন জোট। এদের স্বার্থ হোটেল ব্যবসা। এদের মনোভাব হলো, ‘সেন্ট মার্টিন গোল্লায় যাক সমস্যা নেই, কিন্তু ব্যবসা হতে হবে।’ শেখ হাসিনা ভারত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও বিভ্রান্তমূলক বক্তব্য বলছেন, ইউনূস সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে সামরিক ঘাঁটি করার জন্য চুক্তিপত্র করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টির প্রতিবাদও জানিয়েছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট খবর। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সামরিক ঘাঁটি করার উপযুক্ত নয়। কারণ এটি একটি প্রবাল দ্বীপ। বিমান ঘাঁটি করার মতো উপযুক্ত দ্বীপ এটি নয়। ভারী সামরিক যান চলাচল করলে এই দ্বীপ তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে। ভারত মহাসাগরে যেসব সামরিক ঘাঁটি হয়েছে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারের নিচে নেই, সেন্ট মার্টিন মাত্র ১৫ বর্গকিলোমিটার। সামরিক  ঘাঁটি কী করে হবে? সামরিক ঘাঁটির বিষয়টি রাজনৈতিক রসিকতা ও গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যেন গুজবে কান না দিই।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট