সেভেন সিস্টার : ভারতের অ্যাকিলিস হিল
মেজর (অব.) মনজুর কাদের [প্রকাশ: নয়া দিগন্ত, ১২ জুন ২০২৫]

ভারত স্বাধীনতা লাভ করার সময় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনে’ (যা নেহরু ডকট্রিন নামেও পরিচিত) আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। মূলত ‘অখণ্ড ভারত’-এর ধারণা থেকেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ নীতির উদ্ভব হয়েছে। ভারত এ নীতি অনুসরণ করে প্রতিবেশী ছোট ছোট জাতিরাষ্ট্রগুলোর সর্বনাশ ঘটাতে থাকে। ভারত ১৯৪৭-৪৮ সালে জম্মু-কাশ্মীর (১৬,৩০৯ বর্গমাইল), ১৯৪৮ সালে জুনাগর (৩,৩৩৭ বর্গমাইল) ও হায়দরাবাদ (৮২,৬৯৮ বর্গমাইল), ১৯৬১ সালে গোয়া (১৪২৯ বর্গমাইল) এবং ১৯৭৫ সালে সিকিম (২৭৪০ বর্গমাইল) দখল করে নেয়।
‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর সঙ্গে ভারতের সখ্য
১৯৪৭ সালের আগে থেকেই ভারত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। ভারতে বলশেভিকদের প্রভাব থাকায় সোভিয়েতপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে; নেহরু এরপর সোভিয়েতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ভারত ‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর চেতনায় সম্প্রসারণবাদ নীতি অনুসরণ করে।
পাকিস্তান হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু
অপরদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে (সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের বিরুদ্ধ শক্তি) আবির্ভূত হয়ে উন্নাসিকতায় গা ভাসিয়ে দেয়। কারণ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবশালী পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়।
পাক-ভারত যুদ্ধ
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ মীমাংসার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন মধ্যস্থতা করার আহ্বান জানালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে এক চুক্তি সই করেন।
রাজনীতিতে ভুট্টোর আবির্ভাব : শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবি উত্থাপন
তাসখন্দ চুক্তির সময় জুলফিকার আলী ভুট্টো সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সংস্পর্শে আসেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু পাকিস্তানকে বিভক্তির নীলনকশা তৈরি করেন। তাসখন্দ চুক্তির ২৫ দিন পর (১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে (এককভাবে পার্টিকে না জানিয়ে) শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৬ দফা দাবি’ পেশ করেন। এদিকে ভুট্টো ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পনামতো পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নামে দল গঠন করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচন : ন্যাপের (ভাসানী) নির্বাচন বর্জনের সুফল পায় আওয়ামী লীগ
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ভুট্টোর দল পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এদিকে মওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল করার সুযোগ করে দিলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সার্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তা সত্ত্বেও তাদের ওপর ক্ষমতা অর্পণে ভুট্টো আপত্তি তোলেন। উদ্দেশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পনামতো পাকিস্তান বিভক্ত করে পশ্চিমাংশে প্রধানমন্ত্রী হবেন ভুট্টো এবং পূর্বাংশে ক্ষমতায় আসবেন শেখ মুজিব।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সার্বিকভাবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এর দোসর সম্প্রসারণবাদী ভারতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত পাকিস্তান দ্বিখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এবং এর আদলে গড়া ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কেজিবির সহায়তায় সুচতুর ভুট্টো খেলতে থাকে
পরিকল্পনামাফিক ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতীয় বাহিনীর কাছে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। অপরদিকে ভুট্টোর তত্ত্বাবধানে শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টোর যে দোস্তি হয়, তা বাস্তবে দেখা যায় যখন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিশেষ একটি বিমানে করে ভুট্টো ঢাকায় পৌঁছান। ভুট্টোকে সেদিন যেভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, সেটি তুলে ধরতে ১৯৭৪ সালের ২৮ জুন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় আট কলামব্যাপী প্রধান শিরোনাম করা হয়েছিল ‘ঢাকায় ভুট্টোর অভূতপূর্ব সংবর্ধনা’। এছাড়া দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় ভুট্টোর আন্তরিক অভ্যর্থনা’।
খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজে সেদিন ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। ভুট্টো বিমান থেকে নামার সময় ১৯ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানানো হয়। শেখ মুজিব ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে। ২৮ জুন প্রকাশিত ইত্তেফাকের খবরে বলা হয় : ‘সবার আগে বাংলার মাটিতে তাঁহাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনাব ভুট্টো তাঁহাকে জড়াইয়া ধরেন ও কোলাকুলি করেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন : চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার মতবাদ উপস্থাপন করেন, সব প্রাসঙ্গিক খেলোয়াড়কে সুবিধা প্রদান এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য বৈদেশিক নীতিকে কূটনীতি এবং সামরিক শক্তির সংমিশ্রণের ওপর নির্ভর করতে হবে। এটি মূলত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ভার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে তার মিত্রদের ওপর স্থানান্তরিত করে। এর মাধ্যমে শক্তিশালী মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার লাভ করে। এ মতবাদের কারণে ১৯৭১ সালে পুঁজিবাদের নেতা যুক্তরাষ্ট্র এবং এর প্রতিপক্ষ কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি হয়, যা বিশ্বরাজনীতির গতিপথ বদলে দেয়।
মাহেন্দ্রক্ষণ
ভারত মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভারত যুদ্ধ বাঁধিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। ৯২ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণে ভুট্টোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে সম্প্রসারণবাদী ভারত।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা
১৯৭২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের জনগণ যখন বুঝতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার হলো ভারতের পুতুল সরকার; দলটির জনসমর্থন এ কারণে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা, সৈনিক ও বেসামরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় ভারত ভিন্নপথ ধরে।
রক্ষীবাহিনী গঠন : একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম
ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জলপাই রঙের ইউনিফর্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্ষীবাহিনীর তৈরি করে শেখ মুজিব এগিয়ে চলেন। বিপদের সময় রক্ষীবাহিনীর ছত্রছায়ায় যাতে ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পড়তে পারে, এ ছিল তার পরিকল্পনা। এ শক্তির মদদপুষ্ট হয়ে মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসনব্যবস্থার বাকশাল কায়েম করেন।
সামরিক অভ্যুত্থান
চারদিকে যখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরুণ মেজরদের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে, ফলে ভারতের পুতুল সরকারের পতন হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। আধিপত্যবাদী শক্তি ৩ নভেম্বর পালটা অভ্যুত্থান করলে ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম আবারও সেনাবাহিনীর প্রধান হন। এ বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর-উত্তম (স্বাধীনতার ঘোষক) সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন।
আধিপত্যবাদী শক্তি বুঝতে পারে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে, একসময় উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলবে। আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট কিছু দেশদ্রোহী জিয়াকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে হত্যা করে।
১/১১-এর অভ্যুত্থান : ভারতের মদদপুষ্ট ফ্যাসিস্টের উত্থান
জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তথাকথিত ১/১১-এর অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদী শক্তিকে এমন সুযোগ করে দেয়, যার ফলে তাঁবেদার পুতুল আওয়ামী লীগ আবারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফ্যাসিস্টে রূপান্তরিত হন, সব আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সব অংশকে ব্যবহার করেন। ফলে বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ভারতের প্রাপ্তি : উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলন নস্যাৎ
শেখ হাসিনা ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দেওয়ায় বাংলাদেশ একদিকে যেমন নিঃস্ব হতে থাকে, অপরদিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলন নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়। ভারতকে উত্তর-পূর্বাংশের বিদ্রোহীদের দমনের জন্য প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হতো। বাংলাদেশে পুতুল সরকারের কারণে ভারতের এ অর্থের সাশ্রয় হয়। সে কারণেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি, তারা সারা জীবন মনে রাখবে’।
জনগণের প্রতিক্রিয়া
ফ্যাসিস্ট ক্ষমতায় থাকলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ যে ভারতের একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হবে, তা সর্বস্তরের মানুষ বুঝতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তিকে পরাভূত করেছে।
ড. ইউনূসের ‘ল্যান্ডলকড’ থিয়োরি : উত্তেজিত ভারত
সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে সেভেন সিস্টার সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ল্যান্ডলকড’ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি ভয়াবহ উৎকণ্ঠায় পড়ে যায়। এ অবস্থায় ভারত সরকার মুখরক্ষার জন্য তার দেশবাসীকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে বাংলাদেশকে বাইপাস করে উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলো সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য এক অবাস্তব কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়নের গল্প শোনাচ্ছে।
ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার না করে মিয়ানমারের সঙ্গে ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প’-২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্য স্থির করেছে, তবে তা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে ব্যাপক সংশয় রয়েছে। কারণ, গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের বড় অংশই সে দেশের সামরিক জান্তা সরকারের হাতছাড়া হয়ে গেছে। মিয়ানমারের রাখাইনের পানিপথ এবং স্থলপথ ব্যবহার করে নয়াদিল্লি বিকল্প পথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছে, যার ৮০ শতাংশের বেশি জায়গা সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমারের ওপর চীনের সার্বিক প্রভাব থাকায় এ প্রকল্প যে ভারতের আফগানিস্তানে বিনিয়োগের মতো ভাগ্যবরণ করবে, তা সবাই জানে; শুধু ভারত বোঝে না।
অরুণাচল রক্ষার জন্য ভারতের অবাস্তব পরিকল্পনা
সমুদ্রপথ ছাড়াও ভারত দুর্গম অঞ্চল দিয়ে সড়কপথ নির্মাণ করে আসাম দিয়ে মেঘালয় এবং অন্যান্য রাজ্যে পণ্য পরিবহণের পাশাপাশি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের মোকাবিলায় আরও সুদৃঢ় ভারতীয় সেনার অবস্থান নিশ্চিত করতে চাইছে। এটিও একটি অবাস্তব পরিকল্পনা। ভারতের অরুণাচল রাজ্যঘেঁষা চীন সীমান্তে উঁচু পাহাড় এলাকা রয়েছে। এসব জায়গায় চীন শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। চীন অরুণাচল প্রদেশ অঞ্চলে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) খুব কাছে রাস্তা তৈরি করেছে। এ রাস্তাগুলো চীনের জন্য কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ; যা দ্রুত সৈন্য মোতায়েন এবং ইয়াংৎসে মালভূমির গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় সহজে প্রবেশ করতে পারবে। চীন টাংউ নিউ ভিলেজ থেকে এলএসি রিজ-লাইনের ১৫০ মিটারের মধ্যে পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছে। এছাড়া দেশটি তিব্বতের ব্রহ্মপুত্র ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে, যা অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে বিতর্কিত সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও বেশি প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তাই চীনের দৃষ্টির মধ্যে থাকা পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা তৈরি করে চীনের মোকাবিলা করা ভারতের পরিকল্পনা অবাস্তব ছাড়া কিছুই না।
অরুণাচল এলাকার পাশে আসাম ও মেঘালয় দিয়ে সড়কপথ নির্মাণ এবং বঙ্গোপসাগর দিয়ে নৌপথ এবং কালাদান দিয়ে উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলোয় যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা যদি ভারত করতেই পারে, তাহলে বাংলাদেশকে আবারও করায়ত্ত করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে কেন? এ প্রশ্ন এখন উঁকি দিচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মনে। উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলো (সেভেন সিস্টার) হলো ভারতের অ্যাকিলিস হিল। বাংলাদেশের মানুষ আগে ভারতের আচরণের রহস্য তেমনভাবে বোঝেনি। কিন্তু জোর করে শেখ হাসিনাকে দশকের পর দশক ক্ষমতায় রাখায় ভারতের পরিকল্পনার রহস্য প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের জনগণ বুঝতে পারে, ভারতের দুর্বলতা আসলে কোথায়।
‘অ্যাকিলিস হিল’ হলো অ্যাকিলিসের গোড়ালি। এটি একটি রূপক শব্দ, যা একটি নির্দিষ্ট দুর্বলতাকে বোঝায়। একজন ব্যক্তির সামগ্রিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও একটি জায়গায় দুর্বলতার জন্য তাকে পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ শব্দগুচ্ছটি গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি অ্যাকিলিসের বীরত্বগাথা থেকে এসেছে। অ্যাকিলিস তার গোড়ালি ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশে দুর্ভেদ্য ছিলেন। কিন্তু শত্রু পক্ষ যখন তার শরীরের দুর্বল অংশের কথা জানতে পারে, তখন তারা গোড়ালিতে তির নিক্ষেপ করে, বীর অ্যাকিলিস মারা যান।
বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক ভালো রাখলে অ্যাকিলিস হিলের খোঁজ কেউ করত না। এখানেই ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি রাজনীতিতে বরাবরই ভুল খেলেছে। এজন্য বারবার তাদের খেসারত দিতে হচ্ছে।
মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ-সদস্য