কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সফল্যের চেয়ে ব্যর্থতা বেশি

ড. মো. মোরশেদুল আলম [প্রকাশিত: জনকণ্ঠ, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫]

সফল্যের চেয়ে ব্যর্থতা বেশি

আমাজান নদীর কাছে অবস্থিত ব্রাজিলের বেলেম শহরে ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ তথা কপ৩০-এর মূল লক্ষ্য ছিল গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালীকরণ। সাধারণত কপ৩-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমাধান, নীতিনির্ধারণ, প্রতিশ্রুতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করা। ১৯৯৫ সালে জার্মানির বন শহরে প্রথম কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের কপ সম্মেলনের স্লোগান ছিল বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আর সম্মেলনের থিম ছিল অভিযোজন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর, জলবায়ু অর্থায়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার।

 

 

তবে জীবাশ্ম জ্বালানির মতো গ্রিন হাউস গ্যাসের অন্যতম প্রধান উৎস নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য ছিল এবারের সম্মেলনে। আমাজান অঞ্চলে সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাজানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ইচ্ছা ছিল। কয়লা, তেল আর গ্যাস পোড়ানোর মধ্য দিয়ে ক্রমেই অঞ্চলটির বৈশিষ্ট্য বদলে ফেলা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার রোধ এবং বন নিধন ঠেকানো এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্বের প্রভাবশালী জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিকারক রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপক বাধার মুখে আলোচনা ভেস্তে যায়। দূষণের প্রভাব কমাতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোকে অর্থ সহায়তা বিষয়ক নামমাত্র একটি চুক্তির মাধ্যমে এবারের জলবায়ু সম্মেলন সমাপ্ত হয়। কপ২৮-এর ‘ফসিল জ্বালানি থেকে সরে আসার’ সিদ্ধান্তই শুধু পুনর্ব্যক্ত হয়েছে, নতুন বা শক্তিশালী চুক্তি যুক্ত হয়নি। ব্রাজিল আলাদা করে একটি স্বেচ্ছা রোডম্যাপ প্রদান করলেও তা মূল চুক্তির বাইরে। 
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ২০৩৫ সালের মধ্যে অর্থ সহায়তা ৩ গুণ বৃদ্ধির বিষয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলো একমত পোষণ করে। কিন্তু এই অর্থ কতটা সরকারি আর কতটা বেসরকারি, তা স্পষ্ট নয়।

 

 

 

ধনী রাষ্ট্রগুলো আগের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিতেও পিছিয়েছে। ব্রাজিল ১২৫ বিলিয়ন ডলার তহবিল চালু করেছে বন রক্ষায় উৎসাহ প্রদান করতে। ব্রাজিলের প্রস্তাবিত বন উজাড় রোধের রোডম্যাপও চূড়ান্ত চুক্তিতে স্থান পায়নি। অথচ সম্মেলন চলাকালীন আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। তাদের জমিতে কৃষি, তেল অনুসন্ধান, অবৈধ খনন ও কাঠ কাটার প্রকল্প বন্ধের দাবি জানায়। শুধু আর্থিক সহায়তা নয়; তাদের চাওয়া ছিল ভূমি ও জীবিকা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী সমাধান আসেনি। দ্য গার্ডিয়ান প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো এক বছরে ১২ হাজার কোটি ডলার পাবে। ধনী রাষ্ট্রগুলো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর জন্য গত বছর ৩০ হাজার কোটি ডলার প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল, সেখান থেকেই এই তহবিল আসবে। তবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো প্রত্যাশা করেছিল, ৩০ হাজার কোটি ডলার থেকে নয়; বরং তাদের জন্য বাড়তি ১২ হাজার কোটি ডলারের ঘোষণা আসবে।

 

 

 

এতে তারা অনেকটা আশাহত হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলেছে, ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ২.৩ থেকে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে। যদি এমনটি হয়, তা হলে শুধু মানবজাতি নয়; সমগ্র পৃথিবীই এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর উত্তাপ ঘোষণা দিয়ে হ্রাস করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন তাৎক্ষণিক অর্থ ছাড়। ফসিল জ্বালানির ব্যবহার কমানোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। পৃথিবীর উত্তাপ কমানো মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কপ৩০ এ ক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধন করেছে। বিশেষ করে বন সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে।

 

 

 

তবে প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবে রূপান্তর করা না যায়, তা হলে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। তিন দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিল। আর এই সুযোগে বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলায় চীন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। জলবায়ু বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্পের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জলবায়ু পরিবর্তন লড়াইয়ে চীনের অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি নতুন বাস্তবতার প্রতিফলন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তি থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো প্রতিনিধি দল পাঠাননি।

 

 

 

অথচ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী রাষ্ট্র। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রিন হাউস গ্যান নির্গমনকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। 
আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্তি ৪০০ কোটি টন নির্গমন বাড়তি করবে। এটা সত্যি হলে, পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের বার্ষিক নির্গমনের সমতুল্য। অর্থাৎ গত ৫ বছরে সমগ্র পৃথিবীতে বাতাস, সৌর ও অন্যান্য দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে যা সাশ্রয় হয়েছে, তা দ্বিগুণ অকার্যকর হয়ে যাবে। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী যে একাগ্রতা এসেছে, সেসব উদ্যোগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা এ প্রসঙ্গে বলেন, এখন সময় এসেছে অস্বীকারকারীদের নতুন করে পরাজিত করার। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুক্তভোগী ৮০টির বেশি দেশ ও অঞ্চল এবারে চুক্তিতে জ্বালানি তেল, কয়লা ও হ্রাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রত্যাশা করেছিল। এই দাবির পক্ষে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য। তবে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতো শীর্ষ জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও রপ্তানিকারক রাষ্ট্রগুলো সম্মেলনের শুরু থেকে এই দাবির বিরোধিতা করে আসছিল। এটা নিয়ে শেষ মুহূর্তে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল।

 

 

 

শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ভিন্নমতের কারণে সম্মেলন ঘিরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরিসংখ্যানে জানা যায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়া পৃথিবীব্যাপী ৫৫ শতাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। আর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর এতে ভূমিকা একেবারেই নগণ্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধি সর্বনিম্ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ হচ্ছে, এই লক্ষ্য ধরে রাখার জন্য যে পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্রাস নির্গমন কমানো প্রয়োজন, রাষ্ট্রগুলো তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যক্রম এবং বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেসের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। তবে জাতিসংঘের এই জলবায়ু সম্মেলনে নির্ধারিত সময়ে চুক্তি করা সম্ভব না হলেও বর্ধিত সময়ে সর্বস্মতিক্রমে একটি চুক্তি হয়েছে। এতে ১৯৪টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সম্মত হয়েছে। চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য অর্থ সহায়তা বৃদ্ধি করার জন্য বলা হলেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি জীবাশ্ম জ্বালানি বিষয়ে সরাসরি কোনো কিছু বলা হয়নি। তা ছাড়া চুক্তিটি বাধ্যতামূলক না হয়ে স্বেচ্ছাভিত্তিক হওয়ায় কোনো রাষ্ট্র চাইলে চুক্তি থেকে সরে আসতে পারবে। সম্মেলনের এমন সিদ্ধান্তে কলম্বিয়া, পানামা, উরুগুয়ের মতো কয়েকটি রাষ্ট্র চটেছে। সম্মেলনের নেতৃত্ব নিয়েও রাষ্ট্রগুলো প্রশ্ন তুলেছে।

 

 

 

 

তবে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ভবিষ্যতে বৈশ্বিক পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সম্ভব হবে বলে ব্রাজিল আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিনিধি না পাঠানোয় ব্রাজিলের এমন আশাবাদ নিয়ে সংশয়ও রয়েছে বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 
জলবায়ু সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে করিয়া দো লাগো বলেছেন, অনেকের এবারের সম্মেলন থেকে বড় বড় লক্ষ্য অর্জনের আকাক্সক্ষা ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হবে, অনেকেই এমন আশা করেছেন। তাদের হতাশ করতে চান না বলে তিনি মন্তব্য করেন। কপ সম্মেলন গত ৩০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক পদক্ষেপ এই সময়ে কিছুটা অগ্রগতি এনেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণ হয়েছে। জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এ পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়। তাই কপ সংস্কারের দাবি জোরালো হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কপের হালনাগাদ করা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে জলবায়ু সম্মেলন মেলার মতো হয়ে পড়েছে বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন।

 

 

 

 

সম্মেলনগুলোতে শুধু আলোচনাই হয়। লক্ষ্য বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। তবে কেউ কেউ বর্তমান সময়টাকে কপ৩০-এর সংস্কারের জন্য উপযুক্ত মনে করেন না। পেরুর আবহওয়া মন্ত্রী মানুয়েল পুলগার ভিদাল মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে জলবায়ুবিরোধী রাজনীতির উত্থান হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন নীতির দুর্বল করার প্রবল পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কপ৩০-এর সংস্কার সাধন করলে উল্টো ক্ষতি হতে পারে বরে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন। জলবায়ু সম্মেলনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে এবারের সম্মেলনের আয়োজক দেশ ব্রাজিলও হতাশা প্রকাশ করেছে। প্রতিশ্রুতি নয়, বরং পুরানো প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগ প্রদানের বিষয়ে জোর দিয়েছে দেশটি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কপ৩০ এখনো প্রমাণ করে পৃথিবীর উত্তাপ কমাতে বিশাল ফান্ড প্রয়োজন।

 

 

 

কিন্তু এখনো তা ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে আটকে রয়েছে। তবে সম্মেলনের ইতিবাচক দিক হচ্ছে বন সংরক্ষণে অগ্রগতি, স্বাস্থ্য খাতে তহবিল, ৫৩টি রাষ্ট্রের ঐক্য ও কার্বন বাজারকে সুশৃঙ্খল করার প্রচেষ্টা। সম্মেলনের প্রতিশ্রুতিগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দ্রুত অর্থ ছাড়, সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও ফসিল জ্বালাানি হ্রাসের রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে না। 

 

 


পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই জনসমক্ষে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা সুরক্ষিত মূল্যবোধ রক্ষার কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী এসবের বরখেলাপ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা, খরা, দাবানল বেশি হচ্ছে। ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার দারনা শহরে সংঘটিত বন্যা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এর ফলে অন্তত ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল হ্রদ টিটিকাকা ক্রমশই শুকিয়ে যাচ্ছে; যা হ্রদের তীরে থাকা ৩০ লাখ মানুষের জীবিকায়নে সংকট সৃষ্টি করছে। বিশ্বব্যাপী এলনিনোর প্রভাবে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসকে ভারতে ১২৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। জলবায়ুর প্রভাবে ২০২৫ সালের মধ্যেই থেমে যাবে আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোত, অ্যান্টার্কটিকার পৃথিবীর বৃহত্তম বরফখণ্ড গলে ও সরে গিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, আমাজান শুকিয়ে যাচ্ছে প্রভৃতি। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের ৮৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

 

 

 

 

ঘূর্ণিঝড় ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যায় খুবই সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জলবায়ুর এ পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে একবিংশ শতাব্দী শেষে বিশ্ব থেকে অন্তত ৪৩টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যাবে। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির আওতায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০৩০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন বিশ্ব   নেতৃবৃন্দ। এ লক্ষ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সামলাতে ২০২৫ সাল নাগাদ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে বড় অর্থনীতির দেশগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা করতে সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু এর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। দ্রুত ঘনীভূত হতে থাকা জলবায়ু সংকটের সঙ্গে কপ প্রক্রিয়ার এই শম্বুকগতি এর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বর্তমান কপ প্রক্রিয়া দ্রুত পরিবর্তন আনতে সক্ষম নয় কিংবা দেশগুলোকে পদক্ষেপ নিত বাধ্য করার সামর্থ্য রাখে না।

 

 

 

বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রশমন এবং অর্থায়ন উভয় ক্ষেত্রেই তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা প্রায়শই নিত্য নতুন ধারণা এবং অস্পষ্ট সমাধান নিয়ে হাজির হয়; যা অতি বিপদাপন্ন দেশগুলোর অগ্রাধিকার চাহিদাকে বাধাগ্রস্ত করে। উন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করতে ব্যর্থ হলে জলবায়ু অর্থায়ন প্রকৃত অর্থে কোনো কাজে আসবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সহনশীল পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। 

 

 

 


১৭৬০ সালে সূচনা হওয়া প্রথম শিল্পবিপ্লব অনেক পথ পেরিয়ে বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে পৌঁছেছে বিশ্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সত্ত্বেও শিল্পবিপ্লব থেমে থাকার উপায় নেই; বরং অচিরেই আমরা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে পৌঁছাব। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচতে আমাদের প্রশমন এবং অভিযোজনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশমন পদক্ষেপ হিসেবে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এ জন্য বিকল্প জ্বালানি যেমন : প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর ও বায়োবিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। কার্বন শোষণের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে সবুজায়নের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়