কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সিমলা চুক্তি : বাংলাদেশের অনুপস্থিতির ক্ষতি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ কৃতজ্ঞও; তবে সেই কৃতজ্ঞতার সীমা ছাড়িয়ে গত ৫৩ বছরে ভারত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত অনেক স্বার্থ হাসিল করেছে। ভারত সিমলা চুক্তির মাধ্যমে সাময়িক জয় অর্জন করলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি একধরনের অপূর্ণতা তৈরি করেছে। এখন সময় এসেছে, দক্ষিণ এশিয়া নতুন এক সংহতির পথে যাক, যেখানে কোনো পক্ষ বাদ না পড়ে, সব রাষ্ট্রের স্বার্থ সম্মান পায়। সিমলা চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নতুন আঞ্চলিক সম্পর্কগড়ে তোলাই হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া গঠনের পূর্বশর্ত। এতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আরো শক্তিশালী ও স্বার্থনির্ভর হবে-ড. মো: মিজানুর রহমান [সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৫ মে, ২০২৫]

সিমলা চুক্তি : বাংলাদেশের অনুপস্থিতির ক্ষতি

১৯৭১ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক গভীর মোড় এনে দেয়। তখনকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এই যুদ্ধে বন্দী ও ভূখণ্ড প্রশ্নে পরবর্তী কূটনৈতিক মীমাংসার প্রয়াস হিসেবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে ১৯৭২ সালের ২ জুলাই স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি। এই চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নির্ধারণের রূপরেখা তৈরি করলেও এতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে উপেক্ষা করার আর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব একটি জটিল প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করে। সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশকে পক্ষ না করায় যে বহুমাত্রিক ক্ষতি হয়েছে, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।

 
 
 

চুক্তির পটভূমি ও সারাংশ

১৯৭১ সালের যুদ্ধশেষে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতের হাতে বন্দী হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় এবং বাংলাদেশের বিজয় ভারতকে ঐতিহাসিক কূটনৈতিক সুবিধা এনে দেয়। ওই চুক্তির মূল বিষয়গুলোর অন্যতম ছিল, পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী বিনিময়; জম্মু-কাশ্মির সমস্যা এবং ভবিষ্যতের সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনার অঙ্গীকার করা; উভয়পক্ষকে সীমান্তরেখা (Line of Control) মেনে চলা এবং সর্বোপরি শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিবাদ মীমাংসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

 

 

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশীদের জন্য কেবল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠারও সংগ্রাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানি শাসন, বৈষম্য ও দমননীতি থেকে মুক্তির জন্য রক্তাক্ত সংগ্রাম চালিয়েছিল। এই সংগ্রামে ভারত একটি সক্রিয় সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে কৌশলগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক অবদান রাখে।

 

 

 

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী নাগরিক ভারতে আশ্রয় নেয়। এর ফলে ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অভূতপূর্ব চাপ পড়ে। ভারত আনুমানিক ১ দশমিক ৮ থেকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ তৎপরতায় (Sisson & Rose, War and Secession, 1990)। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যুদ্ধে প্রবেশ করে। তিনটি সম্মুখভাগে ভারতীয় প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার সৈন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। যুদ্ধ পরিচালনা, গোলাবারুদ, সরঞ্জাম, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে সামরিক ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার (Nayar, The Story of Bangladesh Liberation, 1974)। স্বাধীনতার পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণে ভারতের কৌশলগত নেতৃত্ব ছিল মুখ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ২০ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের চিত্র প্রচারে ভারত বড় ভূমিকা রাখে। এ কথা সত্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা না করলে শরণার্থী সঙ্কট মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হতো। পাকিস্তানি সেনারা দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিদের পীড়ন করত। স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতো।

 

 

 

সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত না করায় ক্ষতি

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অথচ পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। এই চুক্তির মূল পটভূমিই ছিল বাংলাদেশ। কারণ যুদ্ধ, যুদ্ধবন্দী ও সীমান্ত পরিস্থিতি সব কিছুই ছিল বাংলাদেশের সাথে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত পর্যন্ত করা হয়নি। এটি ছিল বৈষম্যমূলক ও অবিচার। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশকে চুক্তির বাইরে রাখে। চুক্তিতে বাংলাদেশকে না রাখার কারণ হিসেবে ভারত দাবি করে, এটি একটি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

 

 

 

সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশের বিষয়টি উপেক্ষা করায় পাকিস্তান ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, যা জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি, কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও বিদেশী বিনিয়োগে বড় বাধা সৃষ্টি করে। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে জাতিসঙ্ঘের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তানের বিরোধিতার পেছনে সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশের অনুপস্থিতির ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশকে চাপের মুখে ফেলে যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের সময় ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যা একধরনের আধিপত্যমূলক কৌশলের অংশ। ভারত ১৯৭২-১৯৭৫ সময়ে পাকিস্তানের সাথে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আবারো শুরু হয়, যেখানে ভারতের রফতানি বাড়তে থাকে। (India-Pakistan Trade Data, Ministry of Commerce, GOI)।

 

 

 

পাকিস্তানের ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করার কথা ছিল। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের গোপন সমঝোতা ও সিমলা চুক্তির ফলে ভারত একতরফাভাবে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়। ফলে বিচার হয়নি। এই অবিচার বাংলাদেশীদের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করে।

 

 

 

যুদ্ধবন্দী ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের কাছে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও তা কার্যকর হয়নি। পাকিস্তানের স্বীকৃতি ১৯৭৪ সালে আসে, কিন্তু পাকিস্তান যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি; বরং তারা তাদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয়। পাকিস্তানের স্বীকৃতি না পাওয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে বিলম্ব করে। UNDP I World Bank-এর রিপোর্ট (১৯৭৩) অনুসারে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রত্যাশিত বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ৩৫ শতাংশ স্থগিত হয়। শ্রমবাজার ও রেমিট্যান্স প্রবাহে পাকিস্তান ১৯৭২-১৯৭৬ সময়কালে বাংলাদেশী শ্রমিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে সম্ভাব্য ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স ক্ষতি হয়। (Bureau of Emigration, Bangladesh)। এ ছাড়াও চুক্তি থেকে বাদ পড়ার ফলে বাংলাদেশ সার্ক (SAARC) বা বিমসটেক (BIMSTEC) ধরনের আঞ্চলিক উদ্যোগে শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়ে।

 

 

 

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকায় ভারতের লাভ

সিমলা চুক্তির মাধ্যমে ভারত যেসব কৌশলগত সুবিধা অর্জন করে তার মধ্যে অন্যতম ছিল, ভারত যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ে কাশ্মিরকে একটি দ্বিপক্ষীয় ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে কাশ্মির নিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ যেকোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়াও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার বিনিময়ে ৫৩ বছরে ভারত বাংলাদেশ থেকে ন্যায্য ও অন্যায্যভাবে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছে।

 

 

 

মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে। এ সময় ভারতীয় সেনারা শিল্প যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল মিল, নিউজপ্রিন্ট মিল, ইউরিয়া ফ্যাক্টরি, রেল ইঞ্জিন, ব্রডগেজ রেললাইন, বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাদের রেখে যাওয়া বিপুল অস্ত্র, গাড়ি ও যন্ত্রপাতি বিএসএফ ও সেনাবাহিনী ভারতে নিয়ে যায়, যার আনুমানিক মূল্য ছিল ৪০০-৫০০ মিলিয়ন ডলার (CIA Intelligence Report, 1972)।

 

 

 

স্বাধীনতার পর সীমান্ত খুলে দেয়া হলে ভারতীয় নিম্নমানের পণ্য ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যা স্থানীয় উৎপাদনকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। একই সাথে বাংলাদেশের পাট, কাঁচা চামড়া ও কৃষিপণ্য সীমান্ত চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে যায়। ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করে গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিতে থাকে। এতে বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের ফসল উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়াও ভারত পাকিস্তানকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ভারতের কৌশলগত প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

 

 

 

সীমান্তে চোরাচালান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশ যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক তদন্ত না হওয়ায় ঐতিহাসিক তথ্য-সংরক্ষণে শূন্যতা তৈরি করেছে। ভারতের যুদ্ধোত্তর কর্মকাণ্ড থেকে প্রমাণিত হয়, ভারতের সহযোগিতা নিঃস্বার্থ ছিল না। ভারতের পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল ঘাটতি। কেবল ২০২২-২৩ অর্থবছরেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশে চিকিৎসা, পর্যটন বলতে গেলে পুরোটাই ভারতনির্ভর।

 

 

 

ভারতকে দেয়া হয়েছে ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ইত্যাদি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের জন্য সড়ক ও নদীপথ ট্রানজিট সুবিধা (Protocol on Inland Water Transit and Trade, 2015)। বিনিময়ে বাংলাদেশ খুব অল্প পরিমাণ ফি পাচ্ছে; কখনো কখনো ‘নোমিনাল’ পর্যায়ে ফি পাচ্ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশ ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে, যার রেট প্রতিযোগিতামূলক নয়। রামপাল প্রকল্পে ভারতীয় কোম্পানি ৫০ শতাংশ মালিকানা নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে, যদিও প্রকল্পটি পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১১ সালের তিস্তা চুক্তি এখনো ঝুলে আছে, অথচ ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ২০০১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী নিহত (Human Rights Watch) হয়।

 

 

 

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে চায়নার মতো জায়ান্ট অর্থনীতির দেশের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যচুক্তির সময় ভারতের স্বার্থ বিবেচনায় নিতে হয়। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনোভাবেই উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। দেশের বর্ডারে মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ বিভিন্ন নাশকতা কার্যক্রম অবলীলায় চলতে থাকে। দেশের রাজনীতি, গণহত্যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায়। দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করে ভারতের সেবাদাস দলকে ক্ষমতায় রেখে দেশে ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা করে, দেশকে শাসন করছে ভারত অনেক বছর থেকেই। এক কথায় বাংলাদেশ যেন ভারতের একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত।

 

 

 

সিমলা চুক্তি বাতিলের প্রভাব

সদ্যসমাপ্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সিন্ধু নদের পানিচুক্তি স্থগিত করে। এর পাল্টা হিসেবে পাকিস্তান সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিয়েছে। সিমলা চুক্তি বাতিল হলে পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘ বা ওআইসির মতো সংস্থায় কাশ্মির ইস্যু তুলতে পারবে। কারণ সমস্যাটি আর দ্বিপক্ষীয় ইস্যু থাকবে না।

 

 

 

সিমলা চুক্তি বাতিল হলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভারসাম্যে উত্থান ঘটতে পারে। কাশ্মির ইস্যুতে একটি নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে উঠে আসতে পারবে। পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে গ্যাস পাইপলাইন, করিডোর ও ট্রানজিট সুবিধার সম্ভাবনা তৈরি হবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে স্বাধীন কণ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে, যা সৌদি আরব, চীন ও তুরস্কের মতো দেশের সাথে সম্পর্ক জোরদারে সহায়ক হবে। ২০২৪ সালের ESCAP রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য আবারো উন্মুক্ত হলে বাংলাদেশ বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত রফতানি আয় করতে পারবে। পাকিস্তান বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানসহ মুসলিমপ্রধান দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে জনশক্তি বিনিময়, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক পার্টনারশিপ বাড়বে। শরণার্থী ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাকিস্তান বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করতে পারবে।

 

 

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ কৃতজ্ঞও; তবে সেই কৃতজ্ঞতার সীমা ছাড়িয়ে গত ৫৩ বছরে ভারত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত অনেক স্বার্থ হাসিল করেছে। ভারত সিমলা চুক্তির মাধ্যমে সাময়িক জয় অর্জন করলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি একধরনের অপূর্ণতা তৈরি করেছে। এখন সময় এসেছে, দক্ষিণ এশিয়া নতুন এক সংহতির পথে যাক, যেখানে কোনো পক্ষ বাদ না পড়ে, সব রাষ্ট্রের স্বার্থ সম্মান পায়। সিমলা চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নতুন আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে তোলাই হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া গঠনের পূর্বশর্ত। এতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আরো শক্তিশালী ও স্বার্থনির্ভর হবে।

 

 

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট