সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা
জিয়াউর রহমান । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৪ মার্চ ২০২৫

একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কৃষি খাত শুধু খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য শুধুমাত্র কৃষকদের ওপর নির্ভর না করে দেশের অন্যান্য পেশার মানুষকেও স্বল্প পরিসরে কৃষিকাজে যুক্ত হতে হবে।
ফলে একদিকে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে সিন্ডিকেটমুক্ত একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠবে। যদিও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য কৃষি থেকে সরাসরি লাভ করা প্রধান উদ্দেশ্য নয়, তবে তারা যদি এই কাজে যুক্ত হন এবং কিছুটা লোকসানও মেনে নেন, তাহলে সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ : বর্তমান বিশ্বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পণ্যের মূল্য সিন্ডিকেটের কারণে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে।
সিন্ডিকেট কীভাবে কাজ করে, সেটি বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটি মূল বিষয় বিবেচনা করতে হবে: কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি : কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মজুদদারি করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, যাতে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ চেইনে নিয়ন্ত্রণ : পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যবর্তী স্তরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহকে প্রভাবিত করা হয়। আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো : দেশীয় উৎপাদন সংকুচিত করে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়, যা দেশীয় কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর। বিকল্প উৎস বন্ধ করা : বাজারে বিকল্প উৎস তৈরি না হলে সিন্ডিকেট সহজেই তাদের একচেটিয়া ব্যবসা বজায় রাখতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সাধারণ মানুষকেও কৃষিকাজে যুক্ত করতে হবে, যাতে বাজারে সরবরাহ বাড়ে এবং সিন্ডিকেট তাদের প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কেন সব শ্রেণির মানুষকে কৃষিকাজে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন : বহু উন্নয়নশীল দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়ানো ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কাজ করে।
তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দাম বাড়িয়ে দেয়, ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারে না। অথচ যদি দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষকরাও স্বল্প পরিসরে কৃষিকাজে যুক্ত হন, তাহলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাবে এবং সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়বে। যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, তাদের জন্য কৃষিকাজে লাভ করা মূল লক্ষ্য না হলেও, তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে আসার ফলে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় থাকবে। এমনকি কিছুটা লোকসান হলেও, সেটি জাতীয় অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ইতিবাচক অবদান রাখবে। এতে কম আয়ের মানুষও কম দামে পণ্য ক্রয় করতে পারবে এবং সামগ্রিকভাবে একটি সমবণ্টনের নীতি গড়ে উঠবে। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের বাইরে থাকায় বাজার পুরোপুরি কয়েকটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যদি দেশের অন্যান্য পেশার মানুষও কৃষিকাজে যুক্ত হন, তবে কয়েকটি বড় সুবিধা পাওয়া যাবে
১. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন : দেশের কৃষিজমির সঠিক ব্যবহার না হলে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাড়ে এবং খাদ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পায়। যদি সাধারণ মানুষ নিজের প্রয়োজনে হলেও স্বল্প পরিসরে কৃষিকাজ করে, তবে দেশীয় উৎপাদন বাড়বে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে।
২. বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে : বাজারের নিয়ম অনুযায়ী, যখন কোনো পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, তখন তার মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। যদি স্বল্প পরিসরে হলেও কৃষিকাজ বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়া সহজ হবে এবং সিন্ডিকেটের সুযোগ কমে যাবে।
৩. সিন্ডিকেট দুর্বল হবে : যখন বিকল্প উৎস থাকবে, তখন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তারা যতই মজুদদারি করুক, জনগণের নিজস্ব উৎপাদন থাকলে বাজারে সংকট সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।
৪. সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে : যদি স্বল্প পরিসরে হলেও কৃষিকাজ করা যায়, তাহলে খরচ কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে সাধারণ মানুষ কম দামে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে, যা তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে।
৫. ছাদকৃষি ও নগর কৃষির প্রসার : শহরাঞ্চলে ছাদকৃষির প্রচলন বাড়ানো গেলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও উপকারী হবে। নগর কৃষির মাধ্যমে বাজারে বিকল্প উৎস তৈরি করা সম্ভব, যা বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ : বিশ্বের বহু দেশে সিন্ডিকেট ভাঙা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে এই কঠিন কাজও সম্ভব। কৃষিকাজে সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত হলে বাজারে বিকল্প উৎস তৈরি হবে, ফলে সিন্ডিকেটগুলোর একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ কমে যাবে। এর জন্য সরকারও নীতিগত সহায়তা দিতে পারে। যেমন, নগর কৃষি বা ছাদ বাগান সম্প্রসারণ, কর অবকাশ সুবিধা, বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ, স্বল্পসুদে কৃষিঋণ প্রদান ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, যারা স্বল্প পরিসরে কৃষিকাজ করছে, তাদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। দেশপ্রেমের বাস্তব প্রতিফলন : স্বল্প পরিসরে কৃষিকাজ শুধু একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নয়, এটি একটি দেশপ্রেমেরও বহিঃপ্রকাশ। যদি দেশের সর্বস্তরের মানুষ কৃষিকাজে অংশ নেয়, তাহলে তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, দেশের জন্যও অবদান রাখবে।
সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার তৈরি করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা এবং জনগণের নাগালের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম রাখা সম্ভব হবে। সুতরাং দেশের সব শ্রেণির জনগণ যদি নিজ উদ্যোগে কৃষিকাজে যুক্ত হয়, তাহলে দেশ এক নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে। এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং একটি জাতীয় আন্দোলন, যা দেশকে আরও শক্তিশালী ও স্বনির্ভর করবে।
সাময়িক ক্ষতি হলেও সামগ্রিকভাবে লাভজনক : অনেকেই মনে করতে পারেন, যদি একজন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তি কৃষিকাজে যুক্ত হন এবং সেখানে কিছুটা লস হয়, তাহলে সেটি তার জন্য বিপর্যয়ের কারণ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি সামগ্রিকভাবে সবার জন্য লাভজনক। যখন একজন ব্যক্তি কৃষিকাজে যুক্ত হন, তখন তিনি বাজারে একটি বিকল্প উৎস তৈরি করেন, যা সরবরাহ বৃদ্ধি করে এবং সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে। ফলে সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসে এবং তারা ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং একটি টেকসই অর্থনৈতিক কৌশল ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধও বটে। কীভাবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় :
১. সরকারি নীতি সহায়তা : সরকার যদি কৃষি বিষয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন নগর কৃষি প্রসারের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ। স্বল্পসুদে কৃষিঋণ প্রদান। ছাদকৃষির জন্য বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন। কৃষিপণ্য সরাসরি বিক্রির জন্য ফার্মার্স মার্কেট তৈরি করা।
২. জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে প্রচারাভিযান চালানো যেতে পারে। এটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে করা যেতে পারে।
৩. প্রযুক্তির ব্যবহার: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষিপণ্য বিক্রি ও সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। বর্তমানে অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের সরাসরি ভোক্তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করছে, যা মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।
৪. সম্মিলিত কৃষি উদ্যোগ: যারা ব্যক্তিগতভাবে কৃষিকাজ করতে পারবেন না, তারা সম্মিলিতভাবে একটি প্লট নিয়ে সেখানে উৎপাদন করতে পারেন। এটি একটি সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগ হতে পারে, যা একদিকে ব্যয় কমাবে এবং অন্যদিকে উৎপাদন বাড়াবে। একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য কৃষির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সিন্ডিকেট মুক্ত অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে সব শ্রেণির জনগণের কৃষিকাজে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটি শুধু ব্যক্তিগতভাবে লাভজনক হবে না, বরং জাতীয় স্বার্থেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যদি দেশের মানুষ স্বল্প পরিসরে হলেও কৃষিকাজে যুক্ত হয়, তাহলে বাজারে বিকল্প উৎস তৈরি হবে। এর ফলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে। একইসঙ্গে বিষয়টি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করবে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে।
সুতরাং, এটি শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নয়, বরং একটি জাতীয় আন্দোলন, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময় এসেছে জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে কৃষির প্রসার ঘটানোর, যাতে দেশের সব শ্রেণির মানুষ একত্রে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক: গবেষক ও লেখক