সিরিয়া সংকট ও মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান
ড. সুজিত কুমার দত্ত। সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

একসময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র ছিল সিরিয়া। আজ দেশটি বিশাল সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তার বাবার নেতৃত্বে ১৯৭১ সাল থেকে সিরিয়া শাসিত হচ্ছিল। দীর্ঘকাল ধরে বাথ পার্টির শাসন চলেছিল, যা ২০১১ সালের পর থেকে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে নিপতিত হয়।
বাশার আল-আসাদ, যিনি ২০০০ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এসেছিলেন, এখন আর সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেই। তার শাসনব্যবস্থার পতন ঘটেছে এবং সিরিয়া বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান মূলত দুটি কারণে ঘটেছে—একটি হলো বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ এবং দ্বিতীয়টি হলো স্থানীয় রাজনৈতিক অবস্থা।
এসব বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ শুধু সিরিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে না, বরং পুরো অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ইরান, রাশিয়া ও ইসরায়েলের স্বার্থ এবং পদক্ষেপগুলো সন্ত্রাসবাদের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্য তা একটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১১ সালে সিরিয়ায় বিক্ষোভের সূচনা হয়, যা পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হলেও দ্রুতই তা সহিংসতায় রূপ নেয়।
বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যার মধ্যে রয়েছে সুন্নি, কুর্দি ও ইসলামী গোষ্ঠী। তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তার পরিবারের জন্য রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন ছিল অমূল্য। কিন্তু এবার সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী এক ঐতিহাসিক মাত্রার বিজয় অর্জন করে। মাত্র ১১ দিনের ঝটিকা অভিযানে দামেস্ক দখল করে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা।
এর ফলে বাশার আল-আসাদ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং বর্তমানে রাশিয়ার আশ্রয়ে আছেন। সিরিয়ার বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) অন্যতম। এই গোষ্ঠীটি বর্তমানে সিরিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করেছে এবং তারা সিরিয়ার বাথ পার্টির শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাথ পার্টি দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার শাসনক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এখন তাদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে সিরিয়ার জনগণের জন্য নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাশার আল-আসাদ তার দুই বন্ধু দেশ রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে সিরিয়ার অস্তিত্ব রক্ষায় রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, অন্যদিকে ইরানও তাদের সমর্থন দিতে তৎপর ছিল। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র, সিরিয়ার ভূখণ্ডকে তার সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশলের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে। সিরিয়া ছিল ইরানের জন্য একটি সরবরাহ রুট, যা লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা পৌঁছানোর জন্য অপরিহার্য ছিল। তবে ইরানও এখন আর আগের মতো শক্তিশালী অবস্থানে নেই। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় ইরান ও তার সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর অনেক ক্ষতি হয়েছে। ইরানের সামরিক দুর্বলতা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং হিজবুল্লাহর মজুদ ক্ষেপণাস্ত্রের ৮০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী তাদের বিজয়ের পর একটি নতুন এবং আরো বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দামেস্ক দখলের পর সিরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে। এর মধ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) উল্লেখযোগ্য। সন্ত্রাসবাদীরা সিরিয়ার নানা অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তৎপর হয়ে উঠছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানও সিরিয়াকে সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে দিতে চান না। তিনি ঘোষণা করেছেন যে সিরিয়ার ভূখণ্ডে আইএস এবং পিকেকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এরদোয়ান আরো বলেছেন, ১৩ বছর ধরে সিরিয়ার মানুষ সহিংসতার শিকার হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের যথাযথ সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এখন এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে।
সিরিয়া সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার সরকারবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন শুরুর পর থেকে এটি এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়, যা একদিকে দেশের অভ্যন্তরে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং তাদের কার্যকলাপের তীব্রতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার অস্থিতিশীলতার কারণে আল-কায়েদা, আইএসআইএসসহ (ISIS) অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলেছে। সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলার অভাব, সমাজের দরিদ্রতা এবং বিদেশি শক্তিগুলোর অন্তর্ভুক্তি। বিশেষ করে আইএসআইএসের উত্থান মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক নতুন সন্ত্রাসবাদের মহামারি সৃষ্টি করেছে, যার ফলে এ অঞ্চলের জনগণ এবং বিশ্ব নিরাপত্তা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এটি কোনো সাধারণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা সামরিক সংঘর্ষের বিষয় নয়, বরং একটি গভীরতর সমস্যার সূচনা, যেখানে সন্ত্রাসবাদ শুধু একটি সামরিক বিপদ হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। একদিকে সিরিয়ার জনগণ দুর্ভিক্ষ, শরণার্থী সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছে, অন্যদিকে এই সংকটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই আরো জটিল হয়ে উঠেছে।
সিরিয়ায় বিদ্যমান সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুধু সিরিয়ার জনগণের জন্যই নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান রোধ করা যায় এবং সিরিয়ার পুনর্গঠন সম্ভব হয়। সিরিয়া যদি সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, তবে এর প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি সৃষ্টি করবে। সিরিয়ায় এখন এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান একটি বড় আশঙ্কা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করে সিরিয়াকে সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে না দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপরও। সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে একমাত্র সমাধান হলো সঠিক রাজনৈতিক উদ্যোগ, মানবিক সহায়তা এবং সামরিক প্রতিরোধের সমন্বিত প্রয়োগ।
সিরিয়া সংকটের প্রেক্ষাপটে ইরান, রাশিয়া ও ইসরায়েলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের পদক্ষেপের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান এক আশঙ্কাজনক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত একসঙ্গে কাজ করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শান্তির সন্ধানই হবে সন্ত্রাসবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ।
লেখক : সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়